ভবিষ্যতে গ্যাস আমদানির আর্থিক চাপ ভোক্তা ও পেট্রোবাংলা নিতে পারবে কি

রাজস্ব আয়-ব্যয়ের হিসাবে ২০২১-২২ অর্থবছরে পেট্রোবাংলার আর্থিক লোকসান হয়েছিল প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে ও সংস্থাটির আর্থিক চাপ কমাতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে দুই দফায় বাড়ানো হয় গ্যাসের দাম। চাপে পড়েন ভোক্তারা। এর পরও গত অর্থবছরে সংস্থাটির লোকসান আরো বেড়েছে বলে পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে। আর্থিক চাপ কমাতে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে গ্যাসের দাম সমন্বয় করা হবে বলে সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলকে (আইএমএফ) জানিয়েছে সংস্থাটি।

দেশে গ্যাসের মজুদ ক্রমেই কমে আসছে। দেশজ অনুসন্ধানে জোর না দিয়ে সরকার ২০১৮ সালে এলএনজি আমদানির পথে হাঁটতে শুরু করে। গ্যাস খাতে আমদানিনির্ভরতা ২০২০-২১ অর্থবছরে ছিল ২৪ শতাংশ। গত পাঁচ বছরে প্রায় এক টিসিএফ গ্যাস আমদানি করতে সরকারের ব্যয় হয়েছে অন্তত ১ লাখ কোটি টাকা। যেভাবে আমদানিনির্ভরতা বাড়ছে পেট্রোবাংলার প্রক্ষেপণ অনুসারে ২০৩০-৩১ সালের দিকে তা ৬৭ থেকে ৭০ শতাংশে পৌঁছবে। সেক্ষেত্রে ভোক্তা ও পেট্রোবাংলা— উভয়ের জন্যই আর্থিক চাপ বেড়ে আরো মারাত্মক আকার ধারণ করার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

গত সপ্তাহে আইএমএফ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে পেট্রোবাংলার একটি বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে আমদানি করা এলএনজি কম মূল্যে বিক্রি করে পেট্রোবাংলার বিপুল পরিমাণ লোকসানের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। পেট্রোবাংলার এ লোকসান থেকে বেরিয়ে আসার পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চায় আইএমএফ। পাশাপাশি সংস্থাটির পক্ষ থেকে পেট্রোবাংলার গ্যাসের মজুদ, সরবরাহ ও উৎপাদনসহ গ্যাস খাতের আর্থিক নিরাপত্তার বিষয়েও জানতে চাওয়া হয়। এ সময় পেট্রোবাংলার পক্ষ থেকে জানানো হয়, লোকসান থেকে বেরিয়ে আসতে হলে আন্তর্জাতিক বাজারদরের সঙ্গে দেশে গ্যাসের দাম সমন্বয় করতে হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) প্রকৌশলী মো. কামরুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে গেলে স্থানীয় গ্যাসের পাশাপাশি এলএনজি আমদানি করতে হবে। আর তা করতে গেলে গ্যাস খাতে চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে এটাই স্বাভাবিক। গ্যাস খাতে লোকসান থেকে বেরিয়ে আসতে হলে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে গ্যাসের মূল্য সমন্বয় করতে হবে। অর্থনীতিতে গ্যাসের মূল্য বিবেচনা করলে এখন দাম অনেক সাশ্রয়ী, এটা সমন্বয় হওয়া প্রয়োজন। লোকসান থেকে বেরিয়ে আসতে সম্প্রতি আইএমএফের প্রতিনিধি দল আমাদের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিল। আমরা আমাদের পরিকল্পনার বিষয়ে জানিয়েছি।’

তবে অস্থিতিশীল বাজার থেকে জ্বালানি পণ্য আমদানি এবং আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে গ্যাসের দাম সমন্বয় করে লোকসান থেকে বেরিয়ে আসা পেট্রোবাংলার জন্য কঠিন বলে মনে করছেন জ্বালানি খাতসংশ্লিষ্টরা। তাদের ভাষ্যমতে, অস্থিতিশীল বাজার থেকে জ্বালানি পণ্যের আমদানিনির্ভরতা বাড়িয়ে লোকসান থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়। এজন্য জ্বীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে গ্যাসের অনুসন্ধান-উত্তোলনে বাড়তি মনোযোগ দেয়ার পাশাপাশি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের নীতিগত ভুলগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক বদরূল ইমাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গ্যাস খাত পরিচালনায় আর্থিক চাপ তৈরি হবে তা আগেই অনুমেয় ছিল। কারণ গ্যাস খাতের মহাপরিকল্পনায় তার পূর্বাভাস ছিল। সরবরাহ ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে এখনই আর্থিক সংকট পেট্রোবাংলার দৃশ্যমান। সামনে কী পরিস্থিতি হবে তা বলা আরো মুশকিল। অথচ আমদানিনির্ভর নীতিতেই এগিয়ে যাচ্ছে জ্বালানি বিভাগ। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার একটাই পথ নিজস্ব গ্যাস-কয়লা অনুসন্ধান ও উত্তোলনে জোর দেয়া। অন্তত ভবিষ্যতে গ্যাসনির্ভর বিদ্যুৎ ও শিল্প প্রকল্পগুলোর জন্য হলেও অনুসন্ধান বহু গুণে বাড়ানো উচিত।’

দেশে গ্যাস সংকট মোকাবেলায় ২০১৮ সাল থেকে এলএনজি আমদানি করছে জ্বালানি বিভাগ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে ব্যবহৃত (১ হাজার ৭৮ বিলিয়ন ঘনফুট বা বিসিএফ) গ্যাসের মধ্যে ১১ দশমিক ৭০ শতাংশ ছিল এলএনজি (১১৩ বিসিএফ)। এছাড়া মোট ব্যবহৃত গ্যাসের মধ্যে ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রায় ২৩ শতাংশ, ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৪ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ২৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ ছিল আমদানীকৃত এলএনজি। এছাড়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে ব্যবহৃত গ্যাসের প্রায় ২১ শতাংশ ছিল এলএনজি। এ এলএনজি আমদানিতে ২০১৮-১৯ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত অন্তত ৮৫ হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা ব্যয় করেছে জ্বালানি বিভাগ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ বাবদ অন্তত ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয়ের প্রাক্কলন করা হয়েছে।

বড় এ আর্থিক চাপ সামাল দিতে গ্যাসের দাম বাড়িয়েও লোকসান কমাতে পারছে না পেট্রোবাংলা। বর্তমানে গ্যাস বিতরণ কোম্পানি তহবিল এবং গ্যাস উন্নয়ন তহবিল অর্থ ব্যবহার করে গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখার চেষ্টা করছে সংস্থাটি।

খাতভিত্তিক গ্যাস ট্যারিফে পেট্রোবাংলার হিসাবে দেখা গেছে, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিদ্যুতে এক মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের দাম ছিল ৮৯ টাকা ৪৮ পয়সা, ২০২২ সালের জুনে তা বেড়ে ১৪২ টাকা ১৫ পয়সা হয়ে যায়। এছাড়া সার কারখানায় ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ৭৬ টাকা ৭৪ পয়সা থেকে বেড়ে ৪৫৩ টাকা ৭ পয়সা, বৃহৎ শিল্পের গ্যাসের দাম ২১৯ টাকা ৭৪ পয়সা থেকে বেড়ে ৩৩৯ টাকা ২৪ পয়সা, মাঝারি শিল্পের গ্যাসের দাম ২১৯ টাকা ৭৪ পয়সা থেকে বেড়ে ৩৩৩ টাকা ৫৭ পয়সা, ক্ষুদ্র শিল্পের গ্যাসের দাম ২১৯ টাকা ৭৪ পয়সা থেকে বেড়ে ৩৩৭ টাকা ৮২ পয়সা, বাণিজ্যিক গ্যাসের দাম ৪৮২ টাকা ৫২ পয়সা থেকে বেড়ে ৭৫৪ টাকা ৩৬ পয়সা আর ক্যাপটিভ বিদ্যুতের দাম ২৭২ টাকা ৪১ পয়সা থেকে বেড়ে ৪৫৩ টাকা ৭ পয়সা হয়।

ওই সময়ের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় সব শ্রেণীর গ্যাসের দাম গ্রাহক পর্যায়ে আরো দুই দফা বাড়িয়েছে সরকার। এ সময়ে সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের গ্যাসের দাম বেড়েছে ৪৯৭ দশমিক ৬ শতাংশ, ক্যাপটিভে সাড়ে ৮৭ শতাংশ, বৃহৎ শিল্পে ১৫০ দশমিক ৫১ শতাংশ, মাঝারি শিল্পে ১৫৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ এবং ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে ১৭৮ দশমিক ২৯ শতাংশ। বারবার দাম বাড়ায় বিদ্যুৎ থেকে শুরু করে গৃহস্থালি পর্যন্ত প্রতিটি খাতেই ব্যয় বেড়েছে ভোক্তাদের।

এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে জ্বীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভরতা কমিয়ে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ানোর পরামর্শ দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা। অতিমাত্রায় জ্বীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভরতা দেশে গোটা জ্বালানি সরবরাহ কার্যক্রমকেই হুমকিতে ফেলেছে বলে মনে করছেন তারা।

অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘জ্বালানি খাতের লোকসান থেকে বেরিয়ে আসতে হলে জ্বীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভরতা কমাতে হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ বাড়ছে। এ প্রেক্ষাপটে এখন নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে যেতে হবে। বিশেষ করে শিল্পগুলো এখন ধীরে ধীরে এদিকে এগোতে পারে। বিশ্ববাজারে জ্বালানির মূল্য অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে সরকার ভর্তুকি দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে না। তার চেয়ে বরং নবায়নযোগ্য খাতে ভর্তুকি ও প্রণোদনা দিতে পারে। এতে করে একদিকে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি ব্যয় কমানো যাবে, পাশাপাশি ডলারের ওপরও চাপ কমবে।’

দেশে প্রতি বছর এক ট্রিলিয়ন ঘনফুটের কিছু বেশি গ্যাস ব্যবহার হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৪০ শতাংশ গ্যাস ব্যবহার হয় বিদ্যুতে, ১৭ শতাংশ ক্যাপটিভে, ১৯ শতাংশ শিল্পে, আবাসিকে ১৩ শতাংশ ও সার কারখানায় ৬ শতাংশ। গত কয়েক বছরে গ্যাসের চাহিদা ও জোগানের তারতম্যের কারণে এসব খাতকে বিভিন্ন সময় রেশনিংয়ের মুখে পড়তে হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে আমরা যে মডেল অনুসরণ করছি সেটি ভুল। বিদ্যুতের অতিরিক্ত সক্ষমতা, গ্যাসে পর্যাপ্ত মাত্রা অনুসন্ধান না চালানো ও আমদানিনির্ভরতা— মোটা দাগে এ বিষয়গুলোই আমাদের জ্বালানি খাতের নিরাপত্তাকে ঝুঁকিতে ফেলেছে। আর এ ঝুঁকি মোকাবেলা করতে গিয়ে খাতটিতে বাড়তি ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। একটি ভ্রান্ত মডেলের ওপর ভিত্তি করে খাতটি পরিচালিত হচ্ছে। এ খাতের গ্রাহকরা এখন সবচেয়ে বেশি জিম্মি হয়ে পড়েছে। এসব লোকসান সামাল দিতে দফায় দফায় গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে।’

দেশের গ্যাস খাতের মহাপরিকল্পনাটি প্রণয়ন করানো হয়েছিল ডেনমার্কের প্রকৌশল ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান র‍্যাম্বলকে দিয়ে। সে সময় বাংলাদেশে গ্যাসের চাহিদা ও সরবরাহের ওপর মধ্যম মেয়াদি এক প্রক্ষেপণে সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ২০২১ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর বাংলাদেশের চাহিদা পূরণে গ্যাস আমদানিতে ব্যয় করতে হবে ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি।

এ বিষয়ে র‍্যাম্বলের সুপারিশ ছিল, আন্তর্জাতিক জ্বালানি কোম্পানির বিনিয়োগের অপেক্ষায় না থেকে এ অর্থ স্থানীয় পর্যায়ে গ্যাস অনুসন্ধান-উন্নয়নে কাজে লাগানো হলে এখান থেকে প্রত্যাশিত মাত্রায় সুফল পাওয়া যাবে। গ্যাস খাতের মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে র‍্যাম্বলের করা ওই সুপারিশ গত পাঁচ বছরে বাস্তবায়ন করা যায়নি বলে মনে করেন জ্বালানিসংশ্লিষ্টরা। বরং স্থানীয় গ্যাসের সরবরাহ সংকটে আমদানির যে প্রক্ষেপণ করা হয়েছিল, সেটিকেই সমাধান হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে। যদিও মূল্যের অস্থিতিশীলতা ও ডলার সংকটের কারণে আন্তর্জাতিক জ্বালানি বাজার থেকে প্রয়োজনীয় মাত্রায় গ্যাস আমদানি করতে পারছে না বাংলাদেশ।

এসব সুপারিশের সিংহভাগই বাস্তবায়ন হয়নি। বরং আমদানিনির্ভরতার সহজ সমাধান আনতে গিয়ে জটিল পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়েছে জ্বালানি বিভাগকে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সুপারিশগুলো কাজে লাগানো গেলে এখনকার এ সংকটপূর্ণ পরিস্থিতি অনেকটাই এড়ানো সম্ভব হতো।

দেশে গ্যাসের দৈনিক চাহিদা ৪২০ কোটি ঘনফুটের মতো। এর মধ্যে সরবরাহ হয় ২৭০-২৮০ কোটি ঘনফুট। এলএনজি কমে গেলে কখনো কখনো তা ২৫০-২৬০ কোটি ঘনফুটে নেমে আসে। দেশে গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় সবচেয়ে বেশি সংকট ছিল ২০২২ সালের প্রথমার্ধে (জানুয়ারি-জুন)। ওই সময় আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম আকাশচুম্বী হয়ে উঠলে পণ্যটি আমদানি বন্ধ করে দেয় পেট্রোবাংলা তথা জ্বালানি বিভাগ। প্রায় ছয় মাস পর গত বছরের জুলাই থেকে পুনরায় এলএনজি আমদানি শুরু হয়।

বনিক বার্তা