বোঝা বাড়াচ্ছে বিলাসী বায়ুবিদ্যুৎ আসছে আরও ১০টি কেন্দ্র

ফেনীর সোনাগাজী ও কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায় বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) দুটি বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। এগুলোর সক্ষমতা যথাক্রমে ৯০০ কিলোওয়াট ও এক মেগাওয়াট। দুই মেগাওয়াটের আরেকটি বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র যমুনার তীর ঘেঁষে নির্মাণ করা হয়েছে, যার পরীক্ষামূলক কার্যক্রম চলছে। তিন কেন্দ্রের মধ্যে গত অর্থবছর একটির উৎপাদন ছিল শূন্য আরেক কেন্দ্রে ঋণাত্মক। শুধু কুতুবদিয়া কেন্দ্রটির সক্ষমতার সাত শতাংশ ব্যবহার হয়েছে। সব মিলিয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছর গড়ে বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় পড়েছে প্রায় ৫৬ টাকা।

যদিও বায়ুবিদ্যুৎ নিয়ে বিলাসিতার এখানেই শেষ নয়। সরকারি ও বেসরকারি খাতে আরও ১০টি বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হবে, যেগুলোর সম্মিলিত সক্ষমতা ৬৬৫ মেগাওয়াট। তবে এগুলো থেকে বিদ্যুৎ কেনা হবে ডলারে। এতে ব্যয় পড়বে ১২ থেকে ১৫ ইউএস সেন্ট। কিছু কেন্দ্রে এ ব্যয় আরও বেশি।

সূত্রমতে, দেশের প্রথম বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয় ২০০৫ সালে। ফেনীর সোনাগাজীতে মুহুরী সেচ প্রকল্পের পাশে সে বছর পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয় কেন্দ্রটি। তবে উৎপাদন শুরুর পরই তা বিকল হয়ে পড়ে। এর প্রায় আট বছর পর ২০১৪ সালে ফেব্রুয়ারিতে কেন্দ্রটি পুনরায় চালু করা হয়। তবে এখনও বছরের প্রায় পুরোটা সময় বন্ধ থাকে কেন্দ্রটি।

৯০০ কিলোওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন এ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে ব্যয় হয় ৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা। ২২৫ কিলোওয়াটের চারটি টারবাইনের সাহায্যে এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার কথা। পুনরায় চালুর পর ২০১৫ সালের ২১ মার্চ থেকে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি অনিয়মিতভাবে চলছে। তবে গত অর্থবছর এ কেন্দ্রে উৎপাদনের পরিমাণ ছিল শূন্য। যদিও এ সময় কেন্দ্রটির পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণে প্রায় ৩৬ লাখ ৩৫ হাজার টাকা ব্যয় করা হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে ৫০ মিটার উঁচু টাওয়ার, জেনারেটর, কন্ট্রোল প্যানেল, সাবস্টেশন, ব্লেড, ম্যাচিং গিয়ার এলিমেন্ট স্থাপনসহ প্রায় ৫০ মিটার উঁচু টাওয়ারের মাথায় দেড় টন ওজনের পাখা বসানো হয়। যাতায়াতের জন্য মুহুরী সেচ প্রকল্প থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্র পর্যন্ত সড়কও নির্মাণ করা হয়। কেন্দ্রটি পরিচালনায় স্থানীয় পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি থেকে ১১/০.৪ কেভি লাইনের একটি সংযোগ লাইন টানার পাশাপাশি টু-ওয়ে মিটারও স্থাপন করা হয় উৎপাদিত বিদ্যুৎ কেনাবেচার জন্য।

বাতাসে বিশাল আকৃতির পাখা ঘোরার মাধ্যমে ৯০০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করার দায়িত্ব ছিল ঠিকাদারের। কিন্তু তা করতে ব্যর্থ হয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। অভিযোগ রয়েছে, চীনের নিম্নমানের যন্ত্রপাতি ব্যবহার ও অদক্ষ ঠিকাদারের কারণে পরীক্ষামূলক প্রকল্পটি সাফল্যের মুখ দেখতে পারেনি। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ঠিকাদার ছিল ভারতের নেবুলা টেকনো সলিউশন্স লিমিটেড।

এদিকে ২০০৮ সালে কুতুবদিয়ায় স্থাপিত হয় এক মেগাওয়াটের দ্বিতীয় বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র। উপজেলার আলী আকবর ডেইল ইউনিয়নের তাবলারচর গ্রামের বেড়িবাঁধের পাশে বিস্তীর্ণ এলাকায় প্রায় ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫০টি টারবাইন দিয়ে প্রথমে ১ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন এই কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হয়। কিন্তু প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখার আগেই ২০১০ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর ২০১৬ সালে ২৩ কোটি ৭৭ লাখ টাকা ব্যয়ে নতুন আঙ্গিকে ২০টি টারবাইন দিয়ে বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্রটি পুনঃস্থাপন করা হয়।

২০২২-২৩ অর্থবছর কেন্দ্রটিতে থেকে প্রায় পাঁচ লাখ ৫৫ হাজার ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়, যা সক্ষমতার সাত শতাংশ। জ্বালানি ব্যয় না থাকলেও কেন্দ্রটি পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় অনেক বেশি পড়ছে। এতে কেন্দ্রটির পেছনে গত অর্থবছর মোট ব্যয় হয় এক কোটি ৯ লাখ টাকা। ফলে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় পড়ে ১৯ টাকা ৬১ পয়সা।

অন্যদিকে সিরাজগঞ্জের দুই মেগাওয়াট কেন্দ্রটি এখনও আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়নি। তবে এটি পরীক্ষামূলকভাবে চালানো হচ্ছে। এতে কেন্দ্রটি সচল করতে বাইরে থেকে বিদ্যুৎ নেয়া হয়েছে। ফলে গত অর্থবছর এ কেন্দ্রের নিট উৎপাদন ছিল ২৫ হাজার কিলোওয়াট ঘণ্টা ঋণাত্মক। তবে কেন্দ্রটির জন্য পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় ছিল এক কোটি ৪৯ লাখ টাকা।

বায়ুবিদ্যুতে ব্যাপক সম্ভাবনা থাকার পরও তা কাজে না লাগাতে পারার জন্য অপরিকল্পিত উদ্যোগকে দায়ী করছেন পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী বিডি রহমতউল্লাহ। তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, জলবিদ্যুৎ ও সৌরবিদুতের পাশাপাশি বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির অন্যতম উৎস হতে পারত বায়ুবিদ্যুৎ। এক্ষেত্রে ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমুদ্রসৈকত ও আশপাশের ২৮০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে সহজেই বায়ুচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা যেত। এর মাধ্যমে বিদ্যুতের বড় ধরনের ঘাটতি মেটানো সম্ভব ছিল। তবে এজন্য সঠিক উইন্ড ম্যাপিং দরকার। যত্রতত্র বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করলে এগুলোর উৎপাদন হবে অনেক কম। এতে ব্যয় পড়বে অনেক বেশি।

সূত্রমতে, বায়ুবিদ্যুতে বিপিডিবি সাফল্যের মুখ না দেখলেও সরকারি ও বেসরকারি খাতের কয়েকটি কোম্পানি এ খাতে বড় ধরনের বিনিয়োগ পরিকল্পনা নিয়ে এসেছে। এর মধ্যে কক্সবাজারে ৬০ মেগাওয়াট ও বাগেরহাটের মোংলায় ৫৫ মেগাওয়াটের দুটি বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ চলছে। আর কক্সবাজারের চকরিয়ায় ২২০ মেগাওয়াট ও ফেনীর সোনাগাজীতে ৩০ মেগাওয়াটের দুটি বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে এলওআই/এনওএ ইস্যু করা হয়েছে।

দরপত্র প্রক্রিয়াধীন রয়েছে আরও দুটি বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্রের, যেগুলোর প্রতিটির সক্ষমতা ৫০ মেগাওয়াট। কেন্দ্র দুটি নির্মাণ করা হবে যথাক্রমে কক্সবাজারের ইনানী ও চাঁদপুরে। আর চট্টগ্রামের আনোয়ারার পারকি সৈকতের কাছে রাষ্ট্রায়ত্ত ইলেকট্রিক জেনারেশন কোম্পানি (ইজিসিবি) ১০০ মেগাওয়াট এবং মাতারবাড়িতে কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি (সিপিজিসিবিএল) ৫০ মেগাওয়টের আরও দুটি বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এছাড়া বাংলাদেশ-চায়না রিনিউয়েবল এনার্জি কোম্পানি (বিসিআরইসিএল) পায়রায় ২০ ও ৩০ মেগাওয়াটের দুটি বায়ুবিদ্যুংকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। তবে সক্ষমতার সঠিক ব্যবহার না হলে এসব কেন্দ্র বিদ্যুৎ খাতে বোঝা বাড়াবে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

শেয়ার বিজ