দেড় টিসিএফ এলএনজি আমদানিতে ১০ বিলিয়ন ডলার ব্যয়

দেশে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করা হচ্ছে ২০১৮ সালের ২৪ এপ্রিল থেকে। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় ওই বছর কাতার থেকে এলএনজিবাহী প্রথম কার্গো দেশে আসে। এর পর থেকে গত পাঁচ অর্থবছরে ৪৬ দশমিক ১৫ মিলিয়ন ঘনমিটার (১ হাজার ৬২৯ বিলিয়ন ঘনফুট) বা দেড় টিসিএফের বেশি এলএনজি আমদানি হয়েছে, যা দেশে এক বছরের গ্যাস চাহিদার সমান। দেশের জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় গ্যাসের পাশাপাশি এলএনজিকে ভরসা হিসেবে দেখা হলেও পণ্যটির আমদানিতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়কে জ্বালানি খাতের জন্য উদ্বেগের বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ।

তবে জ্বালানি বিভাগের উইং হাইড্রোকার্বন ইউনিটের তথ্যে দেখা গেছে, ২০১৮ সালের আগস্টের পর থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত দেশে ১ হাজার ২ বিসিএফের কিছু বেশি এলএনজি আমদানি হয়েছে। আমদানিনির্ভর এ জ্বালানিটি কিনতে গত পাঁচ অর্থবছরে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি বা ১০ বিলিয়ন ডলার গুনতে হয়েছে পেট্রোবাংলাকে। এলএনজি আমদানি শুরুর পর ২০১৮-১৯ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৮৫ হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা।

সদ্য শেষ হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরে এলএনজি আমদানি ব্যয়ের হিসাব পাওয়া না গেলেও এ খরচ ২৫ হাজার কোটি টাকার কম নয় বলে জানান পেট্রোবাংলার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

জ্বালানি খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমদানিনির্ভর জ্বালানি পণ্যটি কিনতে গিয়ে এরই মধ্যে আর্থিক চাপে পড়েছে পেট্রোবাংলা। ফলে এলএনজি আমদানির ব্যয় কমিয়ে এ অর্থের বড় অংশ স্থানীয় জ্বালানি খাতের অনুসন্ধানে বিনিয়োগ করা গেলে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। এতে রিজার্ভের ওপরও চাপ কিছুটা কমে আসবে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক বদরূল ইমাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বৃহৎ আকারে এলএনজি আমদানি জ্বালানি খাতের জন্য উদ্বেগের। এলএনজি-নির্ভরতা মানেই জ্বালানি খাতকে আর্থিক সংকটের মুখোমুখি করা, যেটি এখন প্রমাণিত। আমদানিনির্ভর জ্বালানি কখনই দেশের গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থার সমাধান হতে পারে না। এটি আমরা বারবার বলে এসেছি। ফলে নীতিনির্ধারকদের উচিত বিদ্যমান সংকটকে আরো বেশি পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত নেয়া।’

দেশে এলএনজি আমদানি কার্যক্রমের সঙ্গে নিয়োজিত রয়েছে পেট্রোবাংলার সাবসিডিয়ারি রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (আরপিজিসিএল)। সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, দেশে গত পাঁচ অর্থবছরে এলএনজি আমদানি হয়েছে ১ হাজার ৬২৯ বিসিএফ বা ৪৬ দশমিক ১৫ মিলিয়ন ঘনমিটার।

আরপিজিসিএলের তথ্য অনুযায়ী, দীর্ঘমেয়াদি দুই উৎস দেশ কাতারের রাশ লাফফান লিকুইফায়েড কোম্পানি (কাতারগ্যাস) এবং ওমানের ওকিউ ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনাল (ওকিউটি) এবং স্পট মার্কেট থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে এলএনজি আমদানি করা হয়েছে ৯ দশমিক ৩০ মিলিয়ন ঘনমিটার। একইভাবে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১১ দশমিক ৫২ মিলিয়ন ঘনমিটার, ২০২০-২১ অর্থবছরে ১০ দশমিক ১৫, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৯ দশমিক ৪৫ এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৫ দশমিক ৫৭ মিলিয়ন ঘনমিটার এলএনজি আমদানি করা হয়েছে।

বিপুল পরিমাণ এলএনজি আমদানি করতে গিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা ও অর্থের সংকটের কারণে পেট্রোবাংলাকে যেমন ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঋণগ্রহণ করতে হয়েছে, তেমনি গ্যাস উন্নয়ন তহবিল (জিডিএফ) এমনকি এলএনজি সরবরাহকারী কোম্পানিগুলোর কাছে বকেয়ায় পড়তে হয়েছে, যা এখনো চলমান রয়েছে।

দেশে গ্যাসের মজুদ কমে আসার প্রেক্ষাপটে এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। দৈনিক ১০০ কোটি ঘনফুট সক্ষমতার দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনালের মাধ্যমে এ গ্যাস সরবরাহ নিচ্ছে পেট্রোবাংলা। এলএনজি আমদানি বাড়াতে পেট্রোবাংলা আরো ১০০ কোটি ঘনফুট টার্মিনাল নির্মাণে এরই মধ্যে স্থানীয় কোম্পানি সামিট গ্রুপের সঙ্গে চুক্তি করেছে, যা সরকার নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে।

সামিট গ্রুপের এ টার্মিনাল নির্মাণ হবে কক্সবাজারের মহেশখালীতে। এছাড়া মার্কিন জ্বালানি খাতের কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জির সঙ্গে পটুয়াখালীর পায়রায় ৫০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ সক্ষমতার টার্মিনাল নির্মাণের কাজও এগিয়ে নিচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদি এলএনজি কিনতে সম্প্রতি একই কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি সই করেছে পেট্রোবাংলা। এ চুক্তির আওতায় ২০২৬ সাল থেকে ১৫ বছর মেয়াদকাল পর্যন্ত এলএনজি কিনবে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটি।

দেশে দীর্ঘমেয়াদি এলএনজি সরবরাহে ১০০ কোটি ঘনফুটের ল্যান্ডবেজ টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে জ্বালানি বিভাগ। এরই মধ্যে এ উদ্যোগের নির্ধারিত জমি স্থানান্তরের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে বলে জানা গেছে।

দেশে গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় জাতীয় গ্রিডে বর্তমানে দৈনিক ২৫৭ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে। এরই মধ্যে এলএনজি সরবরাহ হচ্ছে দৈনিক ৪৯ কোটি ঘনফুট, যা মোট সরবরাহকৃত গ্যাসের ১৯ শতাংশ। তবে দুটি টার্মিনাল একসঙ্গে চালু থাকলে (একটি টার্মিনাল মেরামতে) দেশে দৈনিক ৭৫ থেকে ৮০ কোটি ঘনফুটের মতো গ্যাস সরবরাহ হয়। সিংহভাগ গ্যাসের জোগান স্থানীয় উৎস থেকে হলেও বিপুল পরিমাণ অর্থ যাচ্ছে পেট্রোবাংলার এলএনজি আমদানির পেছনে।

জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে আমদানীকৃত এলএনজির ১০ শতাংশ স্থানীয় গ্যাস খাতের অনুসন্ধানে যথাযথ বিনিয়োগ করা গেলে তাতে সুফল মিলত বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ম. তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘জ্বালানি সরবরাহ ঠিক রাখতে দেশে আমদানীকৃত এলএনজিতে বিপুল অর্থ ব্যয় হচ্ছে। এ অর্থের অর্ধেকও যদি স্থানীয় জ্বালানি অনুসন্ধানে বিনিয়োগ করা হতো তাহলে অন্তত ৫০ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা যেত। অন্তত ৫ হাজার কোটি টাকা আমরা গ্যাস খাতের অনুসন্ধানে বিনিয়োগ করতে পারতাম। সেখানে একটা ফলাফল আমাদের সামনে পরিষ্কার হতো। কিন্তু সেটি করা যায়নি।’

তবে দেশে গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় গ্যাস অনুসন্ধান ও সরবরাহের পাশাপাশি আমদানিরও প্রয়োজন রয়েছে। সংস্থাটি মনে করছে দেশে গ্যাসের চাহিদা যে হারে বাড়ছে, তাতে এলএনজি আমদানি করতে হবে।

পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) প্রকৌশলী মো. কামরুজ্জামান খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশে শিল্পায়ন হচ্ছে, বিদ্যুৎ চাহিদা বেড়েছে। এসব কারণে জ্বালানি চাহিদাও বাড়ছে। আমাদের গ্যাসের মজুদ ফুরিয়ে আসছে। চাহিদা বিবেচনায় আমদানি করতেই হবে। এটা আমাদের প্রয়োজন। জাপান, ফ্রান্স ও কোরিয়ার মতো দেশ এলএনজি আমদানি করে তাদের জ্বালানি চাহিদা পূরণ করছে। ফলে জ্বালানি খাতে উন্নয়ন করতে হলে পর্যায়ক্রমে আমাদের সেদিকেই যেতে হবে।’

পেট্রোবাংলার কোম্পানিগুলো এখন গ্যাস অনুসন্ধানে জোর দিয়েছে। ২০২৫ সাল নাগাদ দেশে জাতীয় গ্রিডে ৬১৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের জোগান নিশ্চিত করতে পুরনো কূপ সংস্কার, কূপের ওয়ার্কওভার ও নতুন কূপে জোরালো তৎপরতা শুরু করেছে কোম্পানিগুলো।

বনিক বার্তা