জুলাই সনদ বাস্তবায়ন হবে সাংবিধানিক আদেশে

logo

নিজস্ব প্রতিবেদক
মুদ্রিত সংস্করণ
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা অংশ নেন
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা অংশ নেন |নয়া দিগন্ত

রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাবলে একটি সাংবিধানিক আদেশ জারি এবং পরবর্তীতে গণভোটের মাধ্যমে ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’ এর সাংবিধানিক বিধানগুলো কার্যকর করার প্রস্তাব করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। আইন বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সুপারিশের কথা উল্লেখ করে কমিশন বলেছে, আইনি বিশেষজ্ঞদের প্যানেল প্রস্তাব করেছে, অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই সনদের ২২ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে একটি ‘সাংবিধানিক আদেশ’ (কনস্টিটিউশনাল অর্ডার) জারি করতে পারে, যেখানে জুলাই সনদে উল্লেখিত মৌলিক সংস্কারগুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এই আদেশ তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হবে। পরবর্তী সময়ে এই সাংবিধানিক আদেশের ওপর আগামী জাতীয় নির্বাচনের দিনই গণভোট অনুষ্ঠিত হতে পারে। সাংবিধানিক আদেশে গণভোটের বিধানও অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। যদি গণভোটে জনগণের অনুমোদন পাওয়া যায়, তা হলে সাংবিধানিক আদেশ জারির তারিখ থেকে সেটা বৈধতা পাবে।

গতকাল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপের শুরুতে সভাপতির বক্তব্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ এই প্রস্তাব তুলে ধরেন। তবে, প্রস্তাব নিয়ে আলোচনায় জুলাই সনদ বাস্তবায়নে সাংবিধানিক আদেশ ও গণভোট প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিরা ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেনি। এ নিয়ে বৈঠকে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন তারা।

গতকালের বৈঠকে কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার, বিচারপতি মো: এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, সফর রাজ হোসেন ও ড. মো: আইয়ুব মিয়া এবং ঐকমত্য গঠন প্রক্রিয়ায় যুক্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার উপস্থিত ছিলেন।

প্রস্তাবিত জুলাই সনদের ২২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জনগণ বিদ্যমান সংবিধান এবং সব রাষ্ট্র ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের গণতান্ত্রিক সংস্কার আইনসম্মত উপায়ে সম্পন্ন করার অভিপ্রায় প্রকাশ করছে। এর উদ্দেশ্য হলো সুশাসন ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা, ফ্যাসিবাদী শাসনের পুনরাবৃত্তি রোধ, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব এবং সেগুলো বাস্তবায়নের অঙ্গীকারসহ জুলাই সনদের চূড়ান্ত খসড়া তৈরি করে রাজনৈতিক দলগুলোকে পাঠিয়েছে কমিশন। এখন সনদ বাস্তবায়নের পথ খুঁজতে ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনা চলছে। কিন্তু বাস্তবায়ন কৌশল নিয়ে দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও ইসলামী আন্দোলনসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল আগামী নির্বাচনের আগেই সংবিধান সংশোধন করে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পক্ষে। অন্য দিকে বিএনপিসহ সমমনা কয়েকটি দল বলছে, নির্বাচিত সংসদ ছাড়া কেউ সংবিধানে হাত দিতে পারবে না। এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে তৃতীয় দফা সংলাপের দু’টি বৈঠকে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে না পারায় গতকাল আবারো বৈঠকে বসে কমিশন।

বৈঠকে স্বাগত বক্তব্যে আগামী এক মাসের মধ্যে জুলাই সনদ স্বাক্ষরের পাশাপাশি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় শুরু করা সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেন অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, সংবিধানের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ ও গণভোটের মাধ্যমে করতে বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। আর যেগুলো অধ্যাদেশের মাধ্যমে করা যাবে, তা যেন সরকার দ্রুত সম্পন্ন করে, সে পরামর্শও দেয়া হয়েছে। কমিশনের মেয়াদ এক মাস বাড়ানো হয়েছে। আমরা কোনো অবস্থাতেই এক মাস সময় নিয়ে এই আলোচনা অব্যাহত রাখতে উৎসাহী নই। আমরা মনে করি না, আগামী এক মাস ধরে এ বিষয়ে আমাদের আলোচনা করতে হবে। আশা করি রাজনৈতিক দলগুলো আগামী ২১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে একমত হতে পারবে।

আলী রীয়াজ বলেন, গত ১১ সেপ্টেম্বরের পরে আপনাদের প্রতি অনুরোধ করা হয়েছিল, নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে আরো সুনির্দিষ্ট করে কিছু প্রস্তাব দিতে পারেন কি না। যাতে বিকল্পগুলো কমিয়ে আনা সম্ভব হয় এবং সম্ভব হলে ঐকমত্যের জায়গায় যেন আমরা আসতে পারি। আপনাদের পক্ষ থেকে আমরা সর্বশেষ যখন মিলিত হয়েছিলাম, তখন আপনারা নিজেদের দলীয় অবস্থান এবং দলীয় অবস্থানের বাইরেও আপনাদের অবস্থানগুলো ব্যাখ্যা করেছেন। বিস্তারিতভাবে তার আগে আপনারা লিখিতভাবে দিয়েছেন। তার সারাংশ আমরা উপস্থাপন করেছি। পাশাপাশি আমরা বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলেছি। আমাদের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের পক্ষ থেকে একটি সুস্পষ্ট মতামত সুপারিশ হিসেবে আমাদেরকে দেয়া হয়েছে। সংবিধান সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো বাস্তবায়নে দু’টি প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। একটি হচ্ছে গণভোট, আরেকটি বিশেষ সাংবিধানিক আদেশের কথা। আমরা সরকারকে একাধিক পরামর্শ দিতে পারি বাস্তবায়নের জন্য, সেটা তুলনামূলকভাবে সরকারের জন্য সহজতর হবে, বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করে এবং প্রয়োজনীয় আইনি ও সাংবিধানিক বিষয়গুলো খতিয়ে দেখে তারা পদক্ষেপ নিতে পারবেন।

আলী রীয়াজ বলেন, প্রধান উপদেষ্টা জাতিসঙ্ঘ অধিবেশনে অংশ নিতে ২১ সেপ্টেম্বর থেকে নিউ ইয়র্কে থাকবেন। ফিরবেন ২ অক্টোবর। আমরা এই প্রক্রিয়াটির পরিণতির জায়গা, অর্থাৎ আমাদের দিক থেকে যে সুপারিশ সেটা পেলে প্রধান উপদেষ্টার উপস্থিতিতে তার সাথে আলোচনা করে দিতে চাই। সনদে সই করার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে দু’জন করে প্রতিনিধির নাম পাঠানোর কথা বলা হয়েছিল। বেশির ভাগ দলই তা পাঠিয়েছে। এ ব্যাপারে সরকার প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নেবে। আশা করি, খুব স্বল্প সময়ের প্রস্তুতিতেই সনদ সইয়ের জায়গায় যাওয়া সম্ভব হবে।

গত ১২ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ৭ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয় এবং ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যক্রম শুরু করে কমিশন। সে সময় কমিশনকে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ছয় মাস সময় দেয়া হয়েছিল, যা গত ১৫ আগস্ট শেষ হয়। সনদ প্রণয়ন কাজ শেষ না হওয়ায় প্রথম দফায় কমিশনের মেয়াদ ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এর পরও রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সমঝোতায় পেঁৗঁছানো সম্ভব না হওয়ায় ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ আরো এক মাস বাড়িয়ে আগামী ১৫ অক্টোবর নির্ধারণ করা হয়েছে।

সাংবিধানিক আদেশ আজ বা কাল চ্যালেঞ্জ হতে পারে : সালাহউদ্দিন আহমদ

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, দলগুলোর সাথে অনুষ্ঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে বিশেষজ্ঞ প্যানেলের অভিমত উপস্থাপন করা হয়েছে। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন সরকার সাংবিধানিক কিনা। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের মতামতের ভিত্তিতেই সংবিধান মেনে এই সরকার গঠিত হয়েছে। তাই সনদের যেসব বিষয় সংবিধান-সম্পর্কিত, তা বাস্তবায়নের আগে বিচার বিভাগের পরামর্শ নেয়া যেতে পারে। সাংবিধানিক আদেশ আজ বা কাল চ্যালেঞ্জ হতে পারে। তাই জাতির সামনে খারাপ উদাহরণ তৈরি করা ঠিক হবে না।

গতকাল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন।

জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ইস্যু নিয়ে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, আমরা আলোচনার টেবিলে আছি। সমাধানের জন্য, এক জায়গায় যাওয়ার জন্য, প্রতিদিন ইনোভেটিভ আইডিয়াস বা জাতির পক্ষে সমাধানের জন্য প্রস্তাব দিয়ে যাচ্ছি। এখন যদি এই আলোচনার টেবিলে সমাধান হয়, আমি আশা করি হবে ইনশা আল্লাহ।

বিএনপির অন্যতম এই নীতিনির্ধারক বলেন, আমরা যেকোনো অসাংবিধানিক প্রক্রিয়াকে বন্ধ করতে পারব। এবং যেটা আমি আশঙ্কা প্রকাশ করি এবং অনেকেই শঙ্কা প্রকাশ করেছে, যদি এটা আমরা ঝুলিয়ে রাখি, যদি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে আমরা অনিশ্চিত করি, বাধাগ্রস্ত করি বা বিলম্বিত করি, তাহলে সেটার বেনিফিশিয়ারি কে হবে? পতিত ফ্যাসিবাদ হবে। সেটার বেনিফিশিয়ারি কি হবে? কোনো রকমের কোনো অসাংবিধানিক শক্তি হবে। তাহলে সেটার পরিণতি কি হবে- এই জাতি অনেকবার সে পরিণতি ভোগ করেছে, সেই পরিণতিকে আমরা আবার আহ্বান জানাতে পারি না, সুতরাং আমরা আলাপ আলোচনার মধ্য দিয়ে আগাই এবং একটা সমাধানের দিকে যাই।

অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন প্রসঙ্গে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, এক বছর হয়ে গেল ইন্টারিম গভর্মেন্টের, সুপ্রিম কোর্টের মতামতের ভিত্তিতে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় সাংবিধানিক নিয়মে অন্তর্বর্তী সরকার নামে প্রধান উপদেষ্টা এবং অন্যান্য উপদেষ্টাদের শপথ নেয়ার জন্য রাষ্ট্রপতিকে যে মতামত দিয়েছে, সুপ্রিম কোর্ট রাষ্ট্রপতির রেফারেন্স অনুসারে পাঠানোর প্রেক্ষিতে সেটা কি অকার্যকর হয়ে গেল? এটা কি জুডিশিয়ারিতে অথবা সুপ্রিম কোর্টে এখনো পর্যন্ত এর বিপরীতে কোনো সিদ্ধান্ত এসেছে? আসেনি। সুতরাং এই ব্যাপারে প্রশ্ন তোলাটা এটা আমি মনে করি অনেকটা রাজনৈতিক বক্তব্যের মতো। এটার কোনো লিগালিটি নেই।

তিনি বলেন, কনস্টিটিউশনাল অর্ডার ইস্যু করে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে, এখনই সেটা কার্যকর হবে, সেটা কি আগামীকালকে বা পরশু চ্যালেঞ্জ হবে না? তো সেরকম একটা খারাপ নজির কি আমরা জাতির সামনে উত্থাপন করতে পারি? অবশ্যই পারি না। কিন্তু আমরা সমাধান চাই। সমাধান চাই বলেই আমরা কিছু বিকল্প প্রস্তাব উত্থাপন করেছি। যেগুলো বিবেচনায় নেয়ার জন্য সবাইকে আহ্বান জানাব।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনার চলছে, এর বাইরে একটি দল পিআর পদ্ধতি বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে এটি কিভাবে দেখছেন এমন প্রশ্নে বিএনপির এই নেতা বলেন, রাজনৈতিক দলের দাবি নিয়ে আন্দোলন করার অধিকার আছে। পিআর বিষয়টি নির্বাচনে জনগণের কাছে নিয়ে যাক। দিন শেষে জনগণই তো সিদ্ধান্ত নেবে। আমরা রাস্তায় কে কয়টা জনসভা করলাম, কে কয়টা মিছিল দিলাম তার ওপর কি পিআর নির্ধারিত হবে? সেটার জন্য তো একটা প্রক্রিয়া আলোচনার টেবিলে আসতে হবে। সে আলোচনার টেবিলে আমরা আছি। সেটা এখনো অব্যাহত আছে।

তিনি বলেন, পিআরের মাধ্যমে সবসময় একটা অনিশ্চিত সরকার ব্যবস্থা থাকে এবং ঝুলন্ত পার্লামেন্ট থাকে এবং কখনো মেজরিটির ভিত্তিতে সরকার গঠন করার মতো মেজরিটি পাওয়া যায় না এবং সেই রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সরকার ব্যবস্থায় সংসদ ব্যবস্থায় তখন রাষ্ট্রের আকাক্সক্ষা জনগণের আকাক্সক্ষা পূরণ করা যায় না । তার উদাহরণ তো আমাদের পার্শ্ববর্তী অন্য একটা দেশে এরই মধ্যে আমরা দেখেছি। আমরা সেরকম একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের অঙ্গীকার করতে পারি না । জনগণ হচ্ছে সুপ্রিম অথরিটি। তারপরও এ দেশের জনগণ তো মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে, স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রকে এস্টাবলিশ করেছে। এ দেশের জনগণ বারবার গণতন্ত্রহীন অবস্থা থেকে গণতন্ত্রকে উদ্ধার করেছে। বারবার এই দেশে গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, বিভিন্ন সময় সেখান থেকে এই জাতি উদ্ধার হয়েছে।

সালাহউদ্দিন বলেন, আগামী সংসদে কিছু মৌলিক বিষয় এমেন্ডেড হবে যেগুলোতো আমরা এখন সম্মত হয়েছি। ঐকমত্য কমিশনের সনদের মধ্যে সেই বিষয়গুলো পরিবর্তনে অবশ্যই রেফারেন্ডাম নিতে হবে।

জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ১৮ কোটি মানুষের দাবি : রফিকুল ইসলাম খান

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান বলেছেন, পরিষ্কারভাবেই বলেছি, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি এখন বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের দাবি। এটি দাবি করার কথা ছিল না। তবে অনেকেই রাস্তায় মিছিলের উদাহরণ দিচ্ছেন, সবার জানা আছে রাস্তার মিছিলের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদী সরকারের বিদায় হয়েছে। সুতরাং জুলাই সনদের যদি বাস্তবায়ন করতে সরকার দেরি করে অথবা অন্য কিছু হয় তাহলে আবার জনগণ রাস্তায় নামবে এটা খুবই স্বাভাবিক। এ ব্যাপারে এর বাইরে যাওয়ার তো কোনো সুযোগ নেই। এ সময় তিনি উদাহরণ হিসেবে কেয়ারটেকার সরকারের প্রথম দিকের কথা তুলে ধরেন। সে সময় অনেকে বলেছেন, কেয়ারটেকার ফর্মুলা পার্লামেন্ট কী বলে সংবিধানে সংযোজন হবে?

গতকাল বুধবার রাজধানী ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জামায়াতে ইসলামীর আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ড. এ এইচ এম হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, জুলাই সনদের ভিত্তিতেই নির্বাচনটা করলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। সাংবিধানিক বিষয়গুলো এখানে স্থান পাবে। যারা বলছেন সাংবিধানিক বিষয়গুলো এখানে স্থান পাবে না। শুধু অমৌলিক বা যেগুলো জেনারেল আছে, কম গুরুত্বপূর্ণ আছে, সেগুলো অধ্যাদেশের মাধ্যমে হচ্ছে হবে। মৌলিকগুলো পার্লামেন্টে যাবে। আমরা সেখানে বলেছি যে, পার্লামেন্টের কোনো এখতিয়ার নাই- কনস্টিটিউশনাল বেসিক স্ট্রাকচার অ্যামেন্ডমেন্ট করে চেঞ্জ করতে পারে না পার্লামেন্ট। এটার জবাব কিন্তু উনারা ( বিএনপি) দিতে পারেন নাই।

তিনি বলেন, ‘আজকের ঐকমত্য কমিশন যে প্রস্তাবটা দিয়েছে সেই জায়গায় যদি আমরা একমত হয়ে যাই, তাহলে দেশ আগামীতে সুন্দর একটি নির্বাচন পাবে, ফেব্রুয়ারিতে যথাসময় নির্বাচন হবে। ঐকমত্যের ভিত্তিতে আমরা নতুন বাংলাদেশ, নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থার ভিত্তিতে দেশটাকে এগিয়ে নিতে পারব, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে।’

হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, জুলাই সনদকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ এখানে আছে বলে আমি মনে করি না। যারা এই পথে হাঁটবেন আমার মনে হয় জনগণ তাদের ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে। ইতোমধ্যেই কিন্তু ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ফলাফল এটা প্রমাণিত হয়েছে। আমরা জনমতকে ও জন অভিপ্রায়কে প্রাধান্য দিয়ে এগোতে চাই।

এনসিপিসহ অন্য দলগুলো যা বলছে

জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ইস্যুতে এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে আমরা ১০৬ ধারা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত চাই না। আমরা গণপরিষদ নির্বাচন চাই। তা এই সরকারের মাধ্যমেই করতে হবে। বিষয়টি নিয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনার পর আমাদের মতামত জানাবো।

আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) সভাপতি মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, সাংবিধানিক আদেশ বা গণভোটের প্রস্তাবকে আমরা ইতিবাচকভাবেই দেখতে চাই। বিশেষ করে আমরা আগে থেকেই গণভোটের কথা বলেছি। সেটি নির্বাচনের আগে হোক বা পরে হোক। গণভোট হতে হবে। জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি না হলে হবে না। কারণ যেখানে এখনই বিষয়টি নিয়ে মতবিরোধ, সেখানে পরবর্তী সরকার করবে কি না সেই প্রশ্ন উঠতেই পারে। তিনি মনে করেন, নির্বাচন যত দেরি হবে- বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি ততই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এলডিপি) মহাসচিব অ্যাডভোকেট রেদোয়ান আহমেদ বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে কমিশন বিশেষজ্ঞদের মতামত বিষয়ে কথা বলেছেন। নতুন করে জুলাই ঘোষণার ২২ নম্বর অনুচ্ছেদ সামনে আনা হয়েছে। অথচ এর কোনো সাংবিধানিক স্বীকৃতি নেই। তিনি বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হয়েছে ১০৬ অনুযায়ী আদালতের নির্দেশনার ভিত্তিতে। এটি আমাদের সংবিধানকে পাশ কাটানোর চেষ্টা। এটার পক্ষে আমরা নেই। পরবর্তী নির্বাচন হবে, আমরা সেটাই চাই। নতুন কোনো আদেশের বিষয় চাই না। যেসব প্রস্তাব সাংবিধানিক না, তা সরকার আদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে পারে। সাংবিধানিক বিষয়গুলো পরবর্তী সংসদে কার্যকর হতে পারে।

গণ অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে আবারো বিভাজনের দিকে উসকে দিয়েছে। সরকার নিজেরা সিদ্ধান্ত না নিয়ে আবারো দলগুলোর দিকে বল ঠেলে দিয়েছে। দায় নিতে চাচ্ছে না। তিনি বলেন, গণভোট ও সাংবিধানিক আদেশের প্রস্তাব দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে এটি সরকারের কথা নয়। এ নিয়ে হয়তো রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সরকারের আলোচনা হবে। তিন প্রশ্ন রেখে বলেন, যদি জনগণ এটি না মানে তাহলে কী হবে। আওয়ামী লীগের যারা ভোট দেবে তাদের ঠেকানোও কঠিন। সর্বসম্মতিক্রমে যা বাস্তবায়ন হয়, তাতে আমাদের আপত্তি নেই। সরকার আবার দলগুলোর মধ্যে বিভাজন উসকে দিচ্ছে। সরকার দায় নিতে চায় না। তিনি মনে করেন, এভাবে সময় বাড়তে থাকলে আওয়ামী লীগের ফিরে আসা সহজ হবে। তাই সবাইকে ছাড় দিতে হবে। সংস্কার ও বিচার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত। বিষয়গুলো সরকারকে দেখতে হবে।

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে নতুন প্রস্তাব অনুযায়ী বিশেষজ্ঞদের মতামতে সাংবিধানিক আদেশ ও গণভোটের কথা বলা হচ্ছে। বলা হয়েছে জুলাই ঘোষণার ২২-এর ধারা অনুযায়ী এটি করা হবে। অথচ ২৫-এর ধারা অনুযায়ী এটি স্ববিরোধিতা। আবার গণভোটের কথা বলা হচ্ছে। আমরা মনে করি, বিদ্যমান সরকার যেভাবে ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ক্ষমতায় আছেন, সে রকম একটি সিদ্ধান্ত নেয়া যায় কি না। এরপর একটি অধ্যাদেশ হতে পারে। তিনি বলেন, এমন কোনো পথ নেয়া উচিত নয়, যাতে বুঝা যায় তা কোনো কর্তৃত্বের মাধ্যমে হচ্ছে। এ বিষয়ে ঐকমত্য হওয়া দরকার।

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সাধারণ সম্পাদক শহিদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন বলেন, আইনি ভিত্তি না দিয়ে করলে সনদ বাস্তবায়ন কঠিন হবে। এ ক্ষেত্রে ১০৬ অনুসরণ করা যেতে পারে। তবে এর সুরক্ষার জন্য যে পদ্ধতির কথাই বলা হোক আমরা সেটির পক্ষে।

জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দি বলেন, সংবিধান সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলো আগামী সংসদে পাস করতে হবে। আর একমত হওয়া বিষয়গুলো অধ্যাদেশের মাধ্যমে করতে হবে। তা ছাড়াও সংবিধানের ১০৬ অনুযায়ী প্রয়োজনে সনদ বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। আমরা মনে করি গণভোট সমস্যা আরো বাড়াবে।

বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল বাসদ (মার্কসবাদী) সমন্বয়ক মাসুদ রানা বলেন, গণভোটের বিষয়টি সংবিধানে নেই। এটি নির্বাচিত সংসদ করবে। আমরা সনদ বাস্তবায়ন চাই। তবে সুরক্ষার জন্য এমন ব্যবস্থা করতে হবে যেন কেউ চ্যালেঞ্জ করতে না পারে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here