অর্থনৈতিক রিপোর্টার
৩০ এপ্রিল ২০২৩
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ বলেছেন, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট ডিজিটাল ইকোনমির সঙ্গে মনস্তাত্ত্বি¡কভাবে সমস্যা তৈরি করছে। ফলে অনেক কথা বলা যাচ্ছে না। এমনকি লেখালেখির ক্ষেত্রেও বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
শনিবার গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ট্যাক্সিং দ্য ডিজিটাল ইকোনমি: ট্রেড-অবস অ্যান্ড অপরচুনিটি শীর্ষক সেমিনারে এসব কথা বলেন তিনি। সেমিনারে সংস্থাটির বিশেষ ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। এ ছাড়া বক্তব্য দেন সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ, সংসদ সদস্য আহসান আদেলুর রহমান, বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) পরিচালক হাবিবুল্লাহ নেয়ামুল করিম, ই-কমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সহ-সভাপতি মোহাম্মদ শাহাব উদ্দিন, বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সার ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যান তানজিবা রহমান।
এনবিআর সাবেক চেয়ারম্যান বলেন, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট অনেকটা বিশেষ ক্ষমতা আইন হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের সংস্কার করা প্রয়োজন, ডিজিটাল কথাটা গুরুত্বপূর্ণ, এটা সাইবার সিকিউরিটি আইন হতে পারে।
কর আদায় নিয়ে আবদুল মজিদ বলেন, আমাদের ট্যাক্স জিডিপি অনুপাত কেন কম হচ্ছে, কোথায় কোথায় লিকেজ সেটা খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের জিডিপি বাড়ছে, কিন্তু রাজস্ব আদায় কেন বাড়ছে না, সেটা জাতীয় সংসদেও আলোচনা হওয়া দরকার। লিকেজগুলো রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে আলোচনা হওয়া দরকার। সিপিডিও এ বিষয়ে গবেষণা করতে পারে।
মূল প্রবন্ধে সিপিডি’র বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ হবে।
আমাদের ইকোনমির বড় অংশ ডিজিটাল ইকোনমি হবে। এই অবস্থায় অভ্যন্তরীণ সম্পদের মাধ্যমে কীভাবে রাজস্ব বাড়াতে পারি, এ বিষয়ে আমাদের পথ নকশা করতে হবে। এটা বাস্তবতা, বরং আরও আগে করার প্রয়োজন ছিল।
এ বিষয়ে আব্দুল মজিদ বলেন, স্মার্ট শব্দটির ভেতরে যদি অস্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, ঠগবাজি থাকে, তবে শব্দটিই পরে দুঃখ করবে। এ কথা এ জন্য বলছি, আমাদের মধ্যে একটি চিন্তা কাজ করে, মানুষ কেন কর দিচ্ছে না। যিনি কর দিচ্ছেন না, তাকে যদি বলি উৎস উল্লেখ করতে হবে না কিংবা কোনো ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই, তবে যিনি কর দিচ্ছেন তার মনে হবে যে, আমি কেন কর দিচ্ছি! আমাকেও তো কোনো প্রশ্ন করা হবে না। তাই আমাদের ধ্যান-ধারণাও পাল্টাতে হবে। তিনি বলেন, আমরা নিজের টাকায় পদ্মা সেতু করলাম। কিন্তু টোল আদায়ের দায়িত্ব দিলাম বিদেশিদের। কেন? আমি খরচ অনেক বৃদ্ধি করেছি, কিন্তু আয়ের উৎস কেন বাড়ছে না, সেই হিসাব মেলাতে হবে।
সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ডিজিটাল ইকোনমিক আমাদের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব ব্যবস্থাপনা ও কর অনুপাত বৃদ্ধির ক্ষেত্রে। আমাদের দেশে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেক বড় বড় কোম্পানি, যাদের উপস্থিতি আছে কিন্তু রাজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে নেই। সে বিষয়টি আমাদের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। কীভাবে যৌক্তিকভাবে ভোক্তাদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে তাদেরকে করের আওতায় আনা যায় সেটাও দেখতে হবে।
সিপিডি’র বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির মাধ্যমে আমরা অন্তত কিছু নীতি সার্বভৌমত্বের ক্ষেত্রে আত্মসমর্পণ করেছি। আমরা তাদের শর্ত মেনে অর্থ নিয়েছি। তিনি বলেন, আইএমএফের অন্তত তিনটি শর্ত আজকের আলোচনার সঙ্গে মিল আছে। প্রথমত, কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে হবে। প্রতিবছর জিডিপি’র দশমিক ৫ শতাংশ হারে অতিরিক্ত কর আদায় করতে হবে। দ্বিতীয়ত, কর ছাড় যৌক্তিক করা। এই দু’টি শর্ত আদেশ দিয়ে করা যাবে। তৃতীয় শর্তটি হলো, কর আদায়ে প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধি। এটা আদেশ দিয়ে হবে না। এটা বিদ্যুতের দাম নয়, এটি সারের দাম নয়, আদেশ দিলাম, আর বেড়ে গেল। এসব কাজ করাতে দেশের অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, পেশাজীবীরা চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এখন করতে হবে, এটাই বাস্তবতা। দেবপ্রিয় বলেন, আইএমএফের ঋণ নেয়ার বিষয়টি সরকার অনুমোদন দিলো। কিন্তু এ নিয়ে সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা হলো না। এমনকি মন্ত্রিসভার অর্থনীতিবিষয়ক উপ-কমিটিতে আলোচনা হয়নি। স্থায়ী কমিটি কিংবা কেবিনেট সম্পৃক্ত ছিল না। জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তারা সই করলেন।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, রাজস্ব আদায়ে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা আনতে হবে। এ খাতে কর আদায়ে সাম্যতা রাখতে হবে, কর আদায়ে দক্ষতা বাড়াতে এবং কর আদায় খুবই সহজ করতে হবে।
ফেসবুক, গুগল, ইউটিউব থেকে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর সুযোগ কাজে লাগানোর আহ্বান জানিয়ে মূল প্রবন্ধে বলা হয়, ফেসবুক, ইউটিউব, গুগলে বাংলাদেশ থেকে বিজ্ঞাপন যাচ্ছে। তবে কী পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে, তার সঠিক হিসাব নেই। এসব কোম্পানি আয়কর দেয় না। বাংলাদেশে এসব প্রতিষ্ঠানের অফিস না থাকায় তাদের কাছে থেকে রাজস্বও আদায় করা যাচ্ছে না।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ বলেন, সরকার স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে কাজ করছে। স্মার্ট বাংলাদেশে হলে শতভাগ ডিজিটাইজড করে। রাজস্ব আদায় থেকে প্রশাসনিক কার্যক্রম পর্যন্ত সব কিছু অটোমেশন হবে। এরফলে প্রযুক্তি খাতে কর্মসংস্থান যেমন বাড়বে, ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডকে কাজে লাগিয়ে প্রশিক্ষিত জনশক্তি তৈরি হবে। রাজস্ব আদায়েও কাক্সিক্ষত ফল আসবে। গুগল, ফেসবুক, টুইটারের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানকে পুরোপুরি রাজস্বের আওতায় আনা না গেলেও আগামীতে আনা যাবে।
বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সার সোসাইটির চেয়ারম্যান তানজীবা রহমান বলেন, প্রতি জন ফ্রিল্যান্সার আসলে দেশের ডিজিটাল রেমিট্যান্স যোদ্ধা। একটা ফ্রিল্যান্সারকে নিজেকে প্রমোশন করে কাজ পেতে হয়। সেখানে ডেবিট বা ক্রেডিট থাকতে হয়, যার মাধ্যমে টাকাটা খরচ হয়। সেখানে ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ট্যাক্স ব্যাংকগুলো অটো পায়। ফেসবুক বা গুগল থেকে আয় করার পর আরও ১৫ শতাংশ যোগ হয়। তার মানে একজন ফ্রিল্যান্সার প্রকৃতপক্ষে করের ভেতরে থাকেন। আয়ের মধ্যে মাত্র ৩০ শতাংশ আমরা দেশে নিয়ে আসতে পারি। তিনি বলেন, কষ্ট করে খেটে ১০০ টাকা আয়ের মধ্যে মাত্র ৩০ টাকা ঘরে নিয়ে আসতে পারি। তারপর আর কতো টাকা ট্যাক্স, ভ্যাট দিলে বলবো আমরা প্রপার চ্যানেলে আছি সেটা জানি না। আমাদের ওপর আরও কর চাপিয়ে দেয়া হলে তরুণরা এতে আগ্রহী হবেন না।