শেষ বাঁশি বাজতেই স্তব্ধ দশরথের গ্যালারি। মাঠে ফুটবলের আলপনা আঁকা বাংলাদেশের মেয়েরা ততক্ষণে দখলে নিয়েছেন কাঠমান্ডুর সবুজ গালিচা। লাল-সবুজের পতাকা হাতে নিয়ে স্টেডিয়ামের চারপাশে প্রদক্ষিণের সঙ্গে ঋতুপর্ণা চাকমা-মারিয়া মান্ডারা গ্যালারিকে ইঙ্গিত করে মুখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন ‘চুপসে যাও’!
রাতের কালো আঁধারের মতো বিমর্ষ চেহারায় নেপালিরা যখন মাঠ ছাড়ছেন, সাবিনা খাতুন-তহুরা খাতুনরা তখন সেলফিতে নিজেদের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন। এই উচ্ছ্বাস হিমাদ্রির শিখরে ওঠার। এই উচ্ছ্বাস বাংলাদেশের ফুটবলের পুনর্জাগরণের। হিমালয়ের কোলে আবারও ফুটল বাংলাদেশের ফুটবলের ফুল। বুধবার নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে অনিন্দ্যসুন্দর ফুটবলে স্বাগতিক নেপালকে ২-১ গোলে হারিয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মতো শিরোপা জিতেছেন বাংলাদেশের বীরকন্যারা।
২০২২ সালে এই কাঠমান্ডুতে প্রথমবার ট্রফি জিতে ইতিহাসের যে গল্প লিখেছিলেন বাংলার মেয়েরা, দুই বছর পর একই ভেন্যুতে সেই মুকুট ধরে রেখেছেন তারা।
বাংলাদেশের ফুটবলে এ যেন অনন্য এক অর্জন। অতীতে পুরুষ কিংবা নারী সিনিয়র কোনো দলই টানা দু’বার সাফের শিরোপা জিততে পারেনি। এবার সাফল্যের গল্পে নতুন পাণ্ডুলিপি; টানা দু’বার ট্রফি নিয়ে উদযাপন। যে উদযাপনের ভিত গড়ে দিয়েছিলেন মনিকা চাকমা, আর শেষটা তো ঋতুপর্ণার চোখ ধাঁধানো গোলে। স্বপ্ন পূরণ করা এই মেয়েদের বরণ করে নিতে বাফুফে প্রস্তুত রেখেছে ছাদখোলা বাস। গত আসরে শিরোপা জেতা দল যেভাবে ছাদখোলা বাসে চড়ে সমর্থকদের ভালোবাসায় আপ্লুত হয়েছিল, এবার সেই সংবর্ধনার আওয়াজটি সেভাবে না উঠলেও বীরকন্যাদের জন্য এই ব্যবস্থাটুকু করেছে দেশের ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা। আজ দুপুরে ঢাকায় আসার কথা সাফজয়ী মেয়েদের।
ছাব্বিশে যেন ফিরে এলো বাইশের স্মৃতি। ২৫ মাস আগে প্রথমবার যেভাবে শিরোপা জিতেছিলেন মেয়েরা, এবারের গল্পটা একই। কিন্তু এই আসরে চ্যালেঞ্জটা বেশিই ছিল। প্রস্তুতির ঘাটতি, ফুটবলারদের বেতন বাকি– সবকিছু মিলিয়ে এই দলকে নিয়ে প্রত্যাশার রেণু ওড়াননি কেউই। তার ওপর গ্রুপ পর্বে পাকিস্তানের সঙ্গে ড্রয়ের পর তো বিদায়ের সুর বেজেছিল বাংলাদেশ শিবিরে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বের খবর। সব বিতর্ক আর চাপ পেছনে ফেলে এই মেয়েরা এর পরই লিখেছেন ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প। রেকর্ড পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ন ভারতকে ৩-১ গোলে হারানোর পর সেমিফাইনালে ভুটানকে উড়িয়ে দিয়েছেন ৭-১ গোলে।
গতকাল ফাইনালের মঞ্চে নেপালের ১৬ হাজার দর্শক আর মাঠের ১১ যোদ্ধার বিপক্ষে খেলা পিটার বাটলারের দল হিমালয়ের চূড়ায় ওঠার মিশনে নামে। ৪-৩-৩ ফরমেশনে মাঠে নামা বাংলাদেশ শুরু থেকেই ছিল আক্রমণাত্মক। আর এই আক্রমণ করতে গিয়ে অনেক সময় রক্ষণ এলোমেলো হয়ে যায় বাংলাদেশের। প্রথমার্ধে আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে চলা লড়াইয়ে দু’দলই গোল করার সুযোগ পেয়েছে। এই অর্ধে ম্যাচের সেরা সুযোগটা দুই মিনিটেই পান তহুরা খাতুন। গোল কিক নিতে গিয়ে পিছলে পড়ে যান নেপালের এক খেলোয়াড়। তাঁর দুর্বল শট চলে যায় তহুরা খাতুনের কাছে।
বাংলাদেশের এ ফরোয়ার্ডের উড়ন্ত শট ক্রসবারে লেগে ফিরে আসে। তহুরার ফিরতি হেড নেপাল গোলরক্ষক আনজিলা টুম্বাপো সুব্বা গ্লাভসে বল জমান। ১০ মিনিটে তহুরার মতো ভাগ্য মেনে নিতে হয় নেপালের আমিশা কার্কিকে। দলের সেরা ফরোয়ার্ড সাবিত্রা ভান্ডারির অসাধারণ পাস খুঁজে নেয় আমিশাকে। ডি বক্সের বাইরে থেকে তাঁর নেওয়া ডান পায়ের বুলেট গতির শট ক্রসবারে লাগলে হতাশা নেমে আসে নেপাল শিবিরে। তাদের সেই হতাশাটা বিরতির পর দ্বিগুণ হয়ে যায়। ৫৩ মিনিটে পাদপ্রদীপের আলোয় মনিকা চাকমা।
যার এক মন্তব্যেই বাংলাদেশের ঘরে দ্রোহের আগুন লাগে। সেই মনিকা যেন ফাইনালে নিজেকে আলাদা করে চেনালেন। বক্সের মধ্যে ঢুকে পড়া সাবিনা খাতুনের ছোট পাস নেপালের এক খেলোয়াড়ের পায়ে লেগে দিক পাল্টায়। গায়ে লেগে থাকা দুই খেলোয়াড়ের মধ্য থেকে ডান পায়ের দারুণ শটে গোল করেন মনিকা। কিন্তু উচ্ছ্বাসটা বেশিক্ষণ ছিল না বাংলাদেশের। ৫৬ মিনিটে সমতা আনে নেপাল।
প্রীতি রায়ের পাস বাংলাদেশের দুই ডিফেন্ডার মাসুরা পারভীন ও আফিদা খন্দকারের মাঝ দিয়ে চলে যায়। দৌড়ে বলের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ঠান্ডা মাথায় প্লেসিং শটে জাল কাঁপান নেপালের আমিশা কার্কি। জেগে ওঠে গ্যালারি।
স্বাগতিকরা সমতা এনেছে ঠিকই; বাংলাদেশের মেয়েদের মনোবল ভাঙেনি। বরং পাসিং ফুটবলের সঙ্গে ব্যক্তিগত স্কিলে ঋতুপর্ণা চাকমা-তহুরা খাতুনরা প্রতিপক্ষকে চাপে রাখেন। ৬৮ মিনিটে তো মারিয়া মান্ডার কোনাকুনি শট চলেই যাচ্ছিল নেপালের জালে। কিন্তু দলটির গোলরক্ষক কর্নারের বিনিময়ে ফেরালে এগিয়ে যাওয়া হয়নি লাল সবুজের দলটির। আক্রমণের সঙ্গে মধ্য মাঠ এবং রক্ষণভাগও বেশ গোছালো ছিল বাংলাদেশের।
নেপালের সেরা ফুটবলার সাবিত্রা ভান্ডারিকে দারুণ মার্কিংয়ে রাখেন মাসুরা-আফিদারা। মাঝে আতঙ্ক ছড়ালেও লক্ষ্যে বল রাখতে পারেননি ফ্রান্সের লিগে খেলা এ ফরোয়ার্ড। তাঁকে বোতলবন্দি করা মাসুরার উড়ন্ত পাস ছিল অবিশ্বাস্য। আর মধ্য মাঠে অধিনায়ক সাবিনা খাতুন ছিলেন নিজের সেরা রূপে। পুরো টুর্নামেন্টে বাঁ পায়ের সুন্দর শটে যেভাবে সবাইকে মোহিত করেছেন, ম্যাচের ৮১ মিনিটে ঋতুপর্ণা যেন শেষ ড্যান্স দিয়েছেন এদিন।
শামসুন্নাহার সিনিয়রের থ্রোয়ে বল পেয়ে ঋতুপর্ণার বাঁ পায়ের বাঁকানো শট নেপালের গোলরক্ষকের হাত ছুঁয়ে দ্বিতীয় পোস্টের মাঝামাঝি ভেতরের অংশে লেগে চলে যায় জালে। হাজারো দর্শককে স্তব্ধ করে সাবিনাদের উচ্ছ্বাসের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে হিমালয়ের রাজধানীতে। রোমাঞ্চকর নানা বাঁক পেরিয়ে বাংলাদেশ ট্রফি নিয়ে মেতে ওঠে আনন্দে। গোলাম রব্বানী ছোটনের পর ইতিহাসের পাতায় ইংলিশ কোচ পিটার বাটলার।
সংবর্ধনা দেবেন প্রধান উপদেষ্টা
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপাজয়ী বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। গতকাল অভিনন্দন বার্তায় বলেন, ‘এটা আমাদের নারী ফুটবল দলের বিরাট অর্জন।’
তিনি বলেন, ‘আমি তোমাদের নিয়ে গর্বিত। গোটা জাতি তোমাদের নিয়ে গর্বিত। অভিনন্দন সেই সব খেলোয়াড়কে, যারা আমাদের এই গৌরব এনে দিয়েছো।’
সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় নারী ফুটবল দলকে সংবর্ধনা দেবেন প্রধান উপদেষ্টা। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে এসব তথ্য জানানো হয়।
samakal