মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধে প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগে ভারত, সুবিধাজনক অবস্থানে চীন


রাখাইনসহ বিভিন্ন প্রদেশে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে লড়াইয়ে এরই মধ্যে বিপুল পরিমাণ এলাকার ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী (তাতমাদো)। রাখাইনে আরাকান আর্মির সাম্প্রতিক বিজয়ে সেখানে ভারতীয় একটি কানেক্টিভিটি প্রকল্পের কাজ এরই মধ্যে থমকে গেছে। সংশয় রয়েছে অন্যগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়েও। এ অবস্থায় ভারতের পক্ষ থেকে বিদ্রোহীদের সঙ্গে আলোচনা চালানোর উদ্যোগ নেয়া হলেও প্রকল্পগুলোর নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কা কাটিয়ে উঠতে পারছে না ভারত।

সেদিক থেকে তুলনামূলক সুবিধাজনক অবস্থানে আছে চীন। মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী ও সামরিক জান্তা—উভয় পক্ষ থেকেই চীনা প্রকল্পগুলোর নিরাপত্তা নিয়ে নিশ্চয়তা দেয়া হচ্ছে বেইজিংকে। এমনকি চীনকে পাশে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছে উভয় পক্ষই। আহ্বান জানানো হচ্ছে নতুন বিনিয়োগেরও।

চলতি বছরের শুরুর দিকে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ চিন প্রদেশের পালেতওয়া এবং রাখাইন প্রদেশের পাউকতাও শহরের দখল নেয় স্থানীয় বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি। সামরিক জান্তা কালাদান নদীর তীরবর্তী ও ভারত সীমান্তের কাছাকাছি শহর দুটির দখল হারানোয় ঝুঁকিতে পড়ে যায় কালাদান মাল্টি-মোডাল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট (কেএমএমটি)।

ভারতের অ্যাক্ট ইস্ট (পুবে চলো) নীতি বাস্তবায়নে প্রকল্পটিকে দেখা হচ্ছিল কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে। প্রায় ৩ হাজার ২০০ কোটি রুপির উচ্চাভিলাষী প্রকল্পটির লক্ষ্য ছিল মিয়ানমারের সিত্তে বন্দরকে নৌ ও সড়কপথে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হুগলি বন্দরের সঙ্গে সংযুক্ত করা। একই সঙ্গে কলকাতার সঙ্গে ভারতের মিজোরামের দূরত্বও অনেক কমিয়ে আনার কথা প্রকল্পটির। ব্লুপ্রিন্ট অনুযায়ী, এটি বাস্তবায়ন হলে কলকাতা থেকে রাখাইনের সিত্তে বন্দরে পাঠানো পণ্য কালাদান নদী হয়ে খালাস হবে পালেতওয়া বন্দরে। এরপর সেখান থেকে তা সড়কপথে পরিবাহিত হবে মিজোরামে। সে ক্ষেত্রে শিলিগুড়ি করিডোর বা চিকেনস নেকের ওপর ভারতের নির্ভরতাও অনেকখানি কমে আসবে।

ভারতীয় কর্মকর্তারা গত নভেম্বরে দাবি করেছিলেন, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই প্রকল্পটির কাজ হয়ে যাবে। যদিও ভারতের মিজোরাম রাজ্যের সীমান্তবর্তী জরিনপুই থেকে মিয়ানমারের পালেতওয়া পর্যন্ত ১০৯ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি সড়কের নির্মাণকাজ বাকি ছিল। কিন্তু প্রকল্প এলাকায় তাতমাদোর সঙ্গে বিদ্রোহীদের সংঘাত তীব্র হওয়ার পর প্রকল্পের কাজ থমকে যায়। বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রকল্পের কাজ পুনরায় শুরু হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।

রাখাইন ও চিন প্রদেশের বড় একটি অংশে এরই মধ্যে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে আরাকান আর্মি। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে দেশটির নাগরিকদের জন্য সংঘাতপ্রবণ রাখাইন ভ্রমণ এড়িয়ে চলার নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। কালাদান প্রকল্পের কাজ থমকে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গে আলোচনার জন্য ভারত সরকারের পক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধি দলও পাঠানো হয়েছে।

সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টে প্রকাশিত এক সংবাদের তথ্য অনুযায়ী, ভারতীয় পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার সদস্য এবং মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের নেতা কে ভানলালভেনার নেতৃত্বে গত ২৯ ফেব্রুয়ারি একদল প্রতিনিধি মিয়ানমারে আরাকান আর্মির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। প্রতিনিধি দলের সদস্য এবং মিজোরাম রাজ্যের সেন্ট্রাল ইয়ং লাই অ্যাসোসিয়েশনের (সিওয়াইএলএ) জেনারেল সেক্রেটারি জোসেফ লালমিংথাঙ্গা চিনজা জানিয়েছেন, প্রকল্পের কাজ এখন পুরোপুরি থমকে গেছে।

তিনি বলেন, ‘মিজোরাম রাজ্যে প্রকল্পের কাজ ২০২৩ সালেই শেষ হয়েছে এবং সেখানকার জনগণ তা কার্যকরভাবেই ব্যবহার করছে। কিন্তু সীমান্তের ওপারে (মিয়ানমারে) কোনো কাজ হয়নি। কাজের অগ্রগতি দেখে আমরা প্রতিনিধিরা খুবই হতাশ হয়েছি। এ গতিতে প্রকল্পের কাজ আগামী পাঁচ বছরের আগে শেষ হবে না। সড়কটির কাজ সম্পূর্ণ হলে আমরা মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও সিঙ্গাপুরের বাজারে প্রবেশাধিকার পেতাম। এর মাধ্যমে দেশগুলোয় আমাদের কৃষিপণ্য রফতানির পথ তৈরি হতো, যা ভারতের অর্থনীতির উন্নতিতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারত।’

জোসেফ লালমিংথাঙ্গা চিনজা বলেন, ‘‌আরাকান আর্মিও চায় সড়কটির নির্মাণকাজ শেষ হোক। কারণ সীমান্ত পেরিয়ে আসা দ্রব্যসম্ভারের ওপর তারাও নির্ভরশীল। মিয়ানমারের নিয়ন্ত্রণ যার হাতেই থাকুক না কেন, সংঘাতে জড়িত উভয়পক্ষেরই ভারত থেকে সরবরাহ আনার প্রয়োজন পড়বে।’

যদিও আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় বাস্তবায়ন হলে প্রকল্পটির আইনি সত্তা কেমন হবে তা নিয়েও রয়েছে সংশয়। কারণ বিদ্রোহী গোষ্ঠীটি এখনো কোনো রাষ্ট্রীয় পক্ষ হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি।

মিয়ানমারে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত গৌতম মুখোপাধ্যায় মনে করছেন, এ অবস্থায় ভারতের এখনই উচিত হবে ভবিষ্যতে কী হবে তা নিয়ে নতুন করে ভাবতে বসা। তিনি বলেন, ‘‌আরাকান আর্মি ও এর সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক সংগঠন এবং চিন প্রদেশভিত্তিক রাজনৈতিক ও সশস্ত্র গ্রুপগুলো মনিপুর ও মিজোরামের সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের এলাকাগুলোয় আরো শক্তিশালী হতে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। আমাদের উচিত হবে প্রতিবেশী দেশ, আসিয়ান এবং আন্তর্জাতিক মহলের সঙ্গে মিলে মিয়ানমারের জনগণের ইচ্ছার সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে দেশটির সামরিক শাসন থেকে গণতান্ত্রিক ফেডারেল ইউনিয়নে রূপান্তরের বিষয়ে কাজ করার মতো পরিস্থিতি তৈরিতে উদ্যোগী হওয়া।’

তার ভাষ্যমতে, প্রকল্পটি ভারতের মিজোরাম ও এর আশপাশের এলাকাগুলোর জন্য দীর্ঘমেয়াদে গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে যাওয়া বিকল্প রুটটি কোনো কারণে বন্ধ হয়ে গেলে বঙ্গোপসাগরে প্রবেশাধিকারের জন্য এলাকাগুলোকে এর ওপরেই নির্ভর করতে হবে। তবে যতক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে এবং রুটটির (কালাদান প্রকল্প) অর্থনৈতিক উন্নয়ন পুরোপুরি সম্পন্ন না হচ্ছে, ততক্ষণ এর প্রভাব অনুধাবন করা কিছুটা সময়সাপেক্ষ হতে পারে।

মিয়ানমারে নেয়া প্রকল্পগুলোর নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ বিবেচনায় এখন আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের তুলনায় বেশ সুবিধাজনক স্থানে রয়েছে চীন। দেশটির কর্মকর্তাদের সামনে চীনা প্রকল্পগুলোর নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়া নিয়ে বিদ্রোহী গোষ্ঠী ও সামরিক জান্তার মধ্যে এখন রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলছে। মিয়ানমারের স্থানীয় সংবাদমাধ্যম দি ইরাওয়াদ্দিতে গতকাল প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, রাখাইনের কিয়াকফিউয়ে চীনের বাস্তবায়নাধীন একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প এলাকায় জান্তা বাহিনীর অবস্থানকে ঘিরে রেখেছে আরাকান আর্মি।

৮ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্পটিকে এখন বেইজিং ও নেপিদোর মধ্যে সম্পর্কের মূল কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দেখা হচ্ছে। রাখাইন উপকূল থেকে চীনের দক্ষিণাঞ্চল পর্যন্ত ৯৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ জ্বালানি তেল ও গ্যাস পরিবাহী পাইপলাইনের মূল হাবও ধরা হয় কিয়াকফিউকে। ওই এলাকায় এখন গভীর সমুদ্রবন্দরের পাশাপাশি একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলও নির্মাণ করা হচ্ছে।

গত মাসেই বন্দরটির নিকটবর্তী রামরি শহরের দখল নেয় আরাকান আর্মি। এরপর ২৫ মার্চ ইউনাইটেড লিগ অব আরাকান (ইউএলএ) বর্মি, চীনা ও ইংরেজি ভাষায় একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। বিদেশী বিনিয়োগকারীদের রাখাইনে বিনিয়োগ ও ইউএলএর নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহী সরকারের সঙ্গে একযোগে কাজ করার অনুরোধ জানানো হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘‌আরাকান ও এর উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে এমন সব বিদেশী বিনিয়োগকে আমরা স্বাগত জানাই।’

একই সঙ্গে এতে বিদেশী বিনিয়োগ ও সংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলোয় কর্মরত বিদেশীদের নিরাপত্তা বিধানেরও নিশ্চয়তা দেয়া হয়।

আরাকান আর্মির মতো সামরিক জান্তাও প্রকল্পের নিরাপত্তা নিয়ে চীনকে আশ্বস্ত করার বিষয়ে এখন জোর তৎপরতা দেখাচ্ছে বলে দাবি করছে মিয়ানমারের বিদ্রোহীদের সমর্থন জানানো সংবাদমাধ্যমগুলো। গত ২৮ মার্চ চীনের মিয়ানমারে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত চেন হাইয়ের সঙ্গে জান্তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী থান সোয়ের মধ্যে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এরপর গত সোমবার জান্তাপ্রধান মিন অং লাইং সোমবার চীনের এশিয়াবিষয়ক দূত দেং শিজুনের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। এসব বৈঠকে প্রকল্পটি নিয়ে আলোচনা হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে।

রাখাইনের কিয়াকফিউয়ে নির্মীয়মাণ বন্দরটি যৌথভাবে নির্মাণ করছে চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান সিআইটিআইসির বার্মায় প্রতিষ্ঠিত সাবসিডিয়ারি মিয়ানমার পোর্ট ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড এবং জান্তা সমর্থিত কিয়াকফিউ এসইজেড ম্যানেজমেন্ট কমিটি।

শহরটিকে কয়েক মাস ধরেই দুর্ভেদ্য দুর্গ হিসেবে গড়ে তোলায় মনোনিবেশ করেছে সামরিক জান্তা। এলাকাটি ঘিরে রাখলেও এখনো সেখানে আক্রমণ শুরু করেনি আরাকান আর্মি। তবে এখানকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে লড়াই শুরু হলে তা দীর্ঘস্থায়ী ও তীব্র হতে পারে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। এজন্য উভয় পক্ষই কিয়াকফিউকেন্দ্রিক চীনা প্রকল্পগুলোর নিরাপত্তা নিয়ে চীনকে জোর নিশ্চয়তা দিয়ে চলেছে বলে অভিমত তাদের।

বর্তমানে আকাশ ও নৌপথ ছাড়া কিয়াকফিউয়ে জান্তা বাহিনীর রসদ ও অতিরিক্ত সৈন্য পাঠানোর আর কোনো উপায় নেই। এখানকার সঙ্গে সড়কপথে যোগাযোগের সর্বশেষ মাধ্যমটি ছিন্ন হয়ে যায় গত ১৬ ফেব্রুয়ারি। ওইদিন প্রতিবেশী একটি শহর থেকে পিছু হটার সময় কিয়াকফিউর সঙ্গে সংযোগ স্থাপনকারী সর্বশেষ সেতুটি উড়িয়ে দেয় জান্তা বাহিনী।

bonik barta