বিদ্যুতে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বকেয়া ২১,৪৮১ কোটি টাকা

বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এখনও ২০২২-২৩ অর্থবছরের ৩০ হাজার ৫৩২ কোটি টাকার ভর্তুকি বকেয়া রয়ে গেছে। এতে বেসরকারি বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রের বকেয়া বিল নিয়ে বড় ধরনের বিপাকে পড়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। আর নিয়মিত বিল না পাওয়ায় ব্যাংকঋণ পরিশোধ করতে পারছে না রেন্টাল ও আইপিপিগুলো (ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার)।

বেসরকারির পাশাপাশি সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিলও বকেয়া রয়েছে। এছাড়া পিডিবির নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্রের গ্যাস বিল এবং ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির বিল বকেয়া রয়েছে। সব মিলিয়ে গত অর্থবছরের বকেয়ার পরিমাণ ২১ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। ভর্তুকি ও বকেয়া বিলের এ চক্র ভাঙতে বন্ড ইস্যু করতে যাচ্ছে সরকার। তবে এ বকেয়ার বিপরীতে প্রাথমিকভাবে ১৫ হাজার কোটি টাকার বন্ড ছাড়া হবে বলে জানা গেছে।

সূত্রমতে, সারের ভর্তুকি বাবদ বকেয়া দায় পরিশোধে দুই ব্যাংকের অনুকূলে মোট তিন হাজার ১৬ কোটি টাকার বিশেষ বন্ড এরই মধ্যে ইস্যু করেছে সরকার। গত বৃহস্পতিবার (৪ জানুয়ারি) সোনালী ব্যাংকের অনুকূলে দুই হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা এবং আইএফআইসি ব্যাংকের অনুকূলে ৪৫৯ কোটি টাকার বন্ড ইস্যু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগে বন্ড ইস্যু নিয়ে সব পক্ষের মধ্যে সমোঝোতা স্মারক সই হয়।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, এ বন্ডের বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে স্বল্পমেয়াদি ধারের (রেপো) সমান সুদ পাওয়ার পাশাপাশি নিজেদের বিধিবদ্ধ তারল্য সংরক্ষণ (এসএলআর) করতে পারবে ব্যাংক দুটি। সার আমদানি বাবদ সোনালী বাংকের কাছে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) এবং বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) দায় মেটাতে ব্যাংক দুটিকে বিশেষ এ বন্ড দেয়া হয়।

সোনালী ব্যাংকে ৯ বছর মেয়াদি এবং আইএফআইসি ব্যাংকের অনুকূলে আট বছর মেয়াদি বন্ড ইস্যু করা হয়। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছর বিদ্যুৎ ও সারের দায় মেটাতে পর্যায়ক্রমে মোট ২৫ হাজার কোটি টাকার বন্ড ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে সারের ভর্তুকি বাবদ ১০ হাজার কোটি এবং বিদ্যুতের রয়েছে ১৫ হাজার কোটি টাকা। তবে কোনো কোম্পানির বকেয়া ১০ কোটি টাকার নিচে হলে বন্ড দেয়া হবে না।

পিডিবির তথ্যমতে, গত অর্থবছরের ডিসেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত আইপিপি ও রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিল বকেয়া পড়েছে ১৩ হাজার ৯২৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় বকেয়া আট হাজার ৩৬৬ কোটি টাকা, গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বকেয়া তিন হাজার ৯৬৯ কোটি টাকা, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বকেয়া এক হাজার ৪১২ কোটি টাকা এবং সৌরবিদ্যুতের বিল বকেয়া ১৮০ কোটি টাকা। অন্যদিকে সরকারি বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রে জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বিল বকেয়া পড়েছে পাঁচ হাজার ৭৯১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বকেয়া বিল এক হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা, গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বকেয়া চার হাজার ১০৬ কোটি টাকা এবং সৌরবিদ্যুতের বিল বকেয়া দুই কোটি টাকা।

এর বাইরে পিডিবির নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহƒত গ্যাসের বকেয়া বিল রয়েছে চার মাসের। এর পরিমাণ এক হাজার ৩০৯ কোটি টাকা। এছাড়া ভারত থেকে আমদানিকৃত বিদ্যুৎ বিল বকেয়া রয়েছে (আদানিসহ) শুধু জুনের, যার পরিমাণ ৪৫৪ কোটি টাকা। যদিও ভারত থেকে আমদানিকৃত বিলের বিপরীতে কোনো ধরনের বন্ড ইস্যু করা হবে না। এ বিল সরাসরি ব্যাংকের মাধ্যমে ডলারে পরিশোধ করতে হবে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, গত জুন শেষে বিদ্যুৎ ও সারে ভর্তুকি বাবদ সরকারের বকেয়া দাঁড়ায় প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে নগদ অর্থে এ বকেয়া পরিশোধ কঠিন হয়ে পড়ায় বন্ডের মধ্যমে দায় পরিশোধের উদ্যোগ নেয়া হয়। ব্যাংক ঋণের সমপরিমাণ বন্ড সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের অনুকূলে ইস্যুর সিদ্ধান্ত হয়। তবে ব্যাংকঋণ সরকারের কাছে পাওনার চেয়ে বেশি হলে ভর্তুকির সমপরিমাণ বন্ড দেয়া হবে।

পিডিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে গত ডিসেম্বরের গ্যাসের কয়েকটি কেন্দ্রের ১২৯ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। একইভাবে জানুয়ারির বিল বকেয়া রয়েছে ৩৪৫ কোটি টাকা। ফেব্রুয়ারির বিলের মধ্যে গাসের কেন্দ্রে বকেয়া ৫০২ কোটি ও ফার্নেস অয়েলের বকেয়া ৬৫০ কোটি টাকা। একইভাবে মার্চে এ দুই জ্বালানির কেন্দ্রগুলোয় বকেয়া যথাক্রমে ৬৮৭ কোটি টাকা এবং এক হাজার ৪২৯ কোটি টাকা। আর এপ্রিল-জুন সময়ের চার ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্রের বকেয়ার পরিমাণ যথাক্রমে তিন হাজার ৯২ কোটি টাকা, তিন হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা এবং তিন হাজার ৪৯৯ কোটি টাকা।

এদিকে সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ফার্নেস অয়েল ও গ্যাসচালিত উভয় কেন্দ্রের বকেয়াই রয়েছে। এর মধ্যে ডিসেম্বরের বকেয়া ৩৫৯ কোটি টাকা, জানুয়ারির ৬২০ কোটি, ফেব্রুয়ারির ৭৬১ কোটি, মার্চের ৮৯৭ কোটি, এপ্রিলের এক হাজার ৯৮ কোটি, মে মাসের ৮৬৮ কোটি এবং জুনের এক হাজার ১৮৮ কোটি টাকা। এছাড়া পিডিবির নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্রের গ্যাসের বিল বকেয়া মার্চের (আংশিক) ৭৯ কোটি টাকা, এপ্রিলের ৩৮৮ কোটি, মে মাসের ৪৩০ কোটি ও জুনের ৪১২ কোটি টাকা।

সব মিলিয়ে বকেয়া ২১ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। তবে বিদ্যুৎ খাতের ১০ কোটি টাকার নিচের দায়ের ক্ষেত্রে বন্ড দেয়া হবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ কারণে বিদ্যুতের ভর্তুকি বাবদ চলতি অর্থবছর ১৫ হাজার কোটি টাকার বন্ড জারির প্রয়োজন হবে বলে জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।

প্রসঙ্গত, এর আগেও সরকারের এ ধরনের বন্ড ইস্যুর নজির রয়েছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) দায়ের বিপরীতে একসময় ব্যাংকের অনুকূলে বিশেষ ট্রেজারি বন্ড ইস্যু করা হয়েছিল। যদিও বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের রাজস্ব আহরণ যদি কাক্সিক্ষত হারে না বাড়ে এবং পাশাপাশি ব্যাংক খাতের অনাদায়ী ঋণ পরিস্থিতি ও সরকারের ব্যয় দক্ষতার উন্নতি না হলে এ ধরনের পদক্ষেপ সরকারকে আরও সমস্যায় ফেলতে পারে।

শেয়ারবিজ