বিএনপি’র গন্তব্য কোথায়?

mzamin
facebook sharing button

সাজেদুল হক

whatsapp sharing buttonবাধা-বিপত্তি ডিঙ্গানো জনস্রোত। চিড়া-মুড়ি হাতে ২-৩ দিন আগেই হাজির। ঢাকার বাইরে বিএনপি’র সমাবেশগুলোর চিত্র ছিল এমনই। কিংবা ঢাকায় দলটির সমর্থক রিকশা চালকদের মিডিয়ার সামনে দৃঢ়চেতা বক্তব্য, মিছিল। ‘নীরব সমর্থক’। বিএনপি’র রাজনীতির এটাই ছিল ট্রেড মার্ক। ১৮ বছর ধরে মসনদের বাইরে থাকা দলটির এই চরিত্রে পরিবর্তন দেখা যায় গত কয়েক বছরে। সমর্থকরা অনেকেই পরিণত হন নিবেদিত কর্মীতে। মামলা, কারাভোগ, নির্যাতনেও হাজার হাজার নেতাকর্মী দলের হাল ধরে রাখেন। ১৫ মাস আগে একটি লেখায় বিএনপি’র এমন কর্মী-সমর্থকদের কথা উল্লেখ করেছিলাম।

কিন্তু সে লেখার শেষ দিকে বলা হয়েছিল-‘বিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন হচ্ছে, এই কর্মী শক্তিকে কি বিএনপি কাজে লাগাতে পারবে?  দলটি কি আবার চাপে ভেঙে পড়বে? নাকি খেলার অঙ্ক পাল্টে দিবে?’ 

এ প্রশ্নের উত্তর এরই মধ্যে পাঠক জেনে গেছেন। আরেকটি নির্বাচন। বিএনপি’র জন্য আরেকটি বিপর্যয়। ‘চোকার্স।’ ক্রিকেটে সাউথ আফ্রিকার ক্ষেত্রে এ কথাটি সবসময়ই বলা হয়। নকআউট পর্বে ভেঙে পড়া। ডেটলাইন ২৮শে অক্টোবর। এর আগে বিএনপি’র আন্দোলনে উত্থান-পতন ছিল। যা প্রতিটি আন্দোলনেই থাকে। কিন্তু চূড়ান্ত মুহূর্তে এসে এবারো ভেঙে পড়ে আন্দোলন। সরকার এগিয়েছে চেনা ছকে। বিএনপি’র জন্য নির্বাচনে অংশ নেয়ার কোনো পথই খোলা রাখা হয়নি। স্বতন্ত্র কিংবা কিংস পার্টির ব্যানারে বিএনপি নেতাদের জন্য অবশ্য দরজা খোলা ছিল। দুই একজন সেই টোপ গেলেনও। কেউ কেউ আবার শেষ মুহূর্তে সরে আসেন। শেষ বয়সে ‘বেঈমান’ হতে চাননি। প্রশ্ন হলো, বিএনপি কেন ব্যর্থ হলো। এ নিয়ে দলটির ভেতরে বাইরে নানা আলোচনা চলছে। সম্প্রতি দলটির শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকে এক সিনিয়র নেতা এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। বলা হচ্ছে, নির্বাচন বা কর্মসূচি কোনো ক্ষেত্রেই কার্যকর সিদ্ধান্ত নেয়া যায়নি। আন্দোলনে কোনো প্ল্যান-বি ছিল না। হাজার হাজার নেতাকর্মী রাস্তাঘাটে পালিয়ে বেড়িয়েছে। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে নেতাকর্মীদের মাঠে নামানো যায়নি বা তারা মাঠে নামেননি। সম্ভবত হবিগঞ্জই একমাত্র ব্যতিক্রম। না হয় চাপ তৈরি করতে পারে এমন কর্মসূচি কোথাও পালিত হয়নি। ঢাকার নেতারা যথারীতি এবারো ঘরবন্দি ছিলেন। কিছু কর্মী নামার চেষ্টা করলে ঢাকার এক শীর্ষ নেতা তাদের তীব্র ভাষায় তিরস্কার করেন এমন আলোচনাও সে সময় শোনা গিয়েছিল। পল্টনের হুঙ্কার কিংবা লিফলেট বিতরণ কাজে আসেনি। ১০-১২ জন নেতাকর্মীর হাস্যকর কিছু মিছিলও হয়েছে।

নভেম্বর-ডিসেম্বরে বিএনপি’র শীর্ষ নেতৃত্ব ছিল হতাশ। দলটির নেতাদের ধারণা ছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের কারণে প্রশাসন বা বাহিনী এবার কঠোর অ্যাকশনে যাবে না। কিন্তু অক্টোবরের শেষ প্রান্তে এসে সে হিসাব উল্টে যায়। সরকারের প্রতি দৃঢ় সমর্থন প্রকাশ করে ভারত। বিএনপি’র নেতাকর্মীদের একটি অংশ ধরপাকড়ের শিকার হয়। বড় অংশ নানাভাবে আপসরফার পথ বেছে নেন। যেটা আগেও হয়েছিল। কোনো কোনো জেলা শহরে শাসক দলের নেতাদের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে কয়েক মিনিটের ঝটিকা মিছিল বের করা হয়। ছবি তুলে পাঠানো হয় কেন্দ্রে। এবারের আন্দোলনে জামায়াতও কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখেনি। পাশের বাড়ির মনোভাবের কারণে দীর্ঘদিন ধরেই অবশ্য জামায়াতের সঙ্গে একধরনের দূরত্ব বজায় রেখে আসছিল বিএনপি। আন্দোলনের শেষ দিকে জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনসহ সব বিরোধী দল এক মঞ্চে উঠার একধরনের আলোচনা ছিল। কিন্তু যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দুই একটি দল আপত্তি জানানোতে তা আর এগোয়নি।

জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট। জাগদল। বিএনপি। জিয়াউর রহমানের হাতে সময় ছিল কম। এমনিতে মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন ধীরস্থির। তবে শাসক হিসেবে এগিয়েছেন দ্রুত। সামরিক-বেসামরিক নানা পর্যায়ের লোকদের সাহায্য নেন তিনি। মশিউর রহমান যাদু মিয়া ছিলেন মুখ্য ভূমিকায়। বিএনপিতে সাধারণত সমাবেশ ঘটেছিল সামরিক-বেসামরিক সাবেক আমলা, বিভিন্ন মতাদর্শের রাজনীতিবিদদের। নানা জাতের আম এক বাক্সে নিয়ে এসেছিলেন জিয়াউর রহমান। তার আকস্মিক হত্যাকাণ্ডের পর অনেকেই ভেবেছিলেন বিএনপি আর টিকবে না। কিন্তু গৃহবধূ থেকে রাজনীতির মাঠে নামা বেগম খালেদা জিয়া শক্ত হাতে বিএনপি’র হাল ধরেন। ছুটে বেড়ান দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে অনড় ভূমিকা রাজনীতিতে তাকে প্রতিষ্ঠা এনে দেয়। এরশাদের পতনের পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি’র জয় ছিল বিস্ময়কর। ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি’র রাজনীতি একটি নির্দিষ্ট ধারাতেই চলেছে। আওয়ামী লীগ বিরোধী হিসেবে পরিচিত ভোট নিজেদের বাক্সে নিয়ে দলটি নির্বাচনী রাজনীতিতে বরাবরই ভালো করেছে।

ওয়ান ইলেভেন সবকিছু ওলোট পালোট করে দেয়। নেতাদের দুর্নীতি আর ভুল। দেশি-বিদেশি হিসাব ছিন্নভিন্ন করে দেয় বিএনপি’র রাজনীতি। প্রণব মুখার্জির বই কিছুটা সাক্ষ্য দেয় সে সময় কী ঘটেছিল। সেই বিপর্যয় থেকে বিএনপি আর বের হতে পারেনি। ২০০৮ থেকে ২০২৪। একেকটি নির্বাচন। বিএনপির জন্য একেকটি বিপর্যয়। খালেদা জিয়ার কারাভোগের সময়ও বিএনপি’র নেতাকর্মীরা কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেননি। একপর্যায়ে পরিবারের আবেদনে সরকারের নির্বাহী আদেশে মুক্তি পান খালেদা জিয়া। শুরুতে অবশ্য এ ব্যবস্থায় তার সায় ছিল না। ভাই ও বোন তাকে বুঝিয়ে রাজি করান। এখন বাসা এবং হাসপাতালে একধরনের বন্দি জীবনই কাটাচ্ছেন তিনি। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশের বাইরে। মামলা, কারাদণ্ডের ভারে ন্যুব্জ লাখ লাখ নেতাকর্মী।

বিএনপি এবং কিংবা যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোর নেতারা আন্দোলনে ব্যর্থতা মানতে রাজি নন। শাসক দল এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর যে ভূমিকার কথা তারা বলেন তার সত্যতা বিশ্লেষকরাও স্বীকার করেন। বিরোধী নেতাদের দাবি হচ্ছে, নির্বাচনে বেশিরভাগ জনগণ ভোট দিতে যাননি এটিই তাদের বিজয়। তবে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা একটি দলের শীর্ষ নেতা এটি স্বীকার করেন যে, তাদের আন্দোলন সরকারের ওপর কোনো চাপ তৈরি করতে পারেনি। তার কথার বটম লাইন হচ্ছে- ‘সরকারের দমনপীড়ন উপেক্ষা করে সরকার হটাতে পারবে এমন শক্তি বিএনপি বা বিরোধীদলগুলোর নেই।’

আরেকটি নির্বাচন হয়ে গেছে। কোনো ধরনের চাপ ছাড়াই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। অর্থনীতি একধরনের চাপে রয়েছে সেটা সত্য। কিন্তু এর সঙ্গে রাজনীতির কোনো যোগ নেই। আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো নীরব হয়ে গেছে। পশ্চিমা দেশগুলো যার যার হিসাব দেখছে। ভারত, রাশিয়া, চীনের অবস্থান একেবারেই স্পষ্ট। এটা সত্য দেশে দেশে গণতন্ত্র এখন ভেঙে পড়ছে। এটি বিশ্বব্যাপীই চ্যালেঞ্জের মুখে। কেউ বলেন, গণতন্ত্র এখন লাইফ সাপোর্টে। কারও মতে এটি আইসিইউতে।

বাংলাদেশে গত চারটি নির্বাচন ছিল চার মডেলের। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে বিস্ময়কর ভোটার উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয় নির্বাচন। ২০১৪ সালের নির্বাচন ছিল শাসক দলের জন্য সবচেয়ে কঠিন। দেশের একটি বড় অংশে বিরোধী দলের দাপট ছিল। তবে সে আন্দোলনের ড্রাইভিং সিটে ছিল জামায়াত। যুদ্ধাপরাধের মতো স্পর্শকাতর ইস্যু সামনে থাকার কারণে বিএনপি তখন সর্বশক্তি নিয়োগ করেনি।  ২০১৮ ও ২৪ জাস্ট কৌশলের খেলা। ২০১৮ সালে পাশের বাড়ির একধরনের মধ্যস্থতা ছিল যা অবশ্য শেষ পর্যন্ত কাজে আসেনি। সে নির্বাচনে শাসক দল ঘনিষ্ঠ আলোচিত এক ব্যবসায়ীর হাত বিরোধী শিবিরেও প্রসারিত হয়েছিল এমন গুঞ্জন রয়েছে।

এই যখন অবস্থা তখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপির গন্তব্য কোথায়? বেগম খালেদা জিয়া রাজনীতি করতে পারবেন না কাগজে-কলমে এমন কোনো শর্ত নেই। পাকিস্তানে ইমরান খানকে কারাগারে থেকেই রাজনীতি করতে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু গ্রেপ্তারের পর থেকে অনেকটাই রাজনীতির বাইরে খালেদা জিয়া। কারাগারে থাকা অবস্থায় দুই একটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতেন। কিন্তু এখন তিনি রাজনীতি থেকে পুরোদস্তুর দূরে। যদিও শরীরটাও তার বেশ খারাপ। তারেক রহমান বিদেশ থেকে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। তৃণমূল পর্যায়ে দল গোছাতে তিনি অনেক দিন ধরেই কাজ করছেন। স্থায়ী কমিটির সদস্যদের বেশিরভাগই বয়সের ভারে ন্যুব্জ। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আর দায়িত্বে থাকতে চান না এমন খবর মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। যদিও এর সত্যতা পাওয়া যায়নি। ঈদের পর আলমগীর আবারো সরব হবেন এমনটাই শোনা যাচ্ছে। মধ্যম সারির নেতাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ কারাদণ্ডপ্রাপ্ত।
১৮ বছর ধরে নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে যাচ্ছে বিএনপি। ঐক্য ধরে রাখা দলটির বড় সফলতা। যদিও এ ঐক্য অনেক ক্ষেত্রে কসমেটিকস্‌। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়া বিএনপি’র বাকি সংসদ সদস্যরা শপথ নিয়েছিলেন। দল কি চাইলেই তাদের দায়িত্ব নেয়া আটকাতে পারতো? পরে উকিল আবদুস সাত্তারের ঘটনায় সে প্রশ্নের উত্তর মেলে। আইনজীবী ফোরামের মতামত উপেক্ষা করে সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতির দায়িত্ব নিয়েছেন ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন। তিনি আবার বিএনপি’র যুগ্ম মহাসচিব। দুটি প্রশ্ন এখানে ওঠে। দলের যুগ্ম মহাসচিব আইনজীবী সংগঠনের মতামত কীভাবে উপেক্ষা করেন। আবার এ প্রশ্নও উঠেছে যে তাকে দায়িত্ব না নেয়ার অনুরোধ কি যৌক্তিক? দল কি তাকে আস্থায় নিয়ে তার সঙ্গে আলোচনা করেছিল। সিদ্ধান্তটা কি সঠিক? না একটি পক্ষের চাপিয়ে দেয়া?

বিএনপি নেতাদের একটি অংশ গুরুত্বপূর্ণ সময়ে কোনো ভূমিকাই রাখেন না। আন্দোলনের সময় তারা চলে যান পর্দার আড়ালে। কারও কারও বিশ্বাসযোগ্যতাও প্রশ্নবিদ্ধ। দলের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও পাস হয়ে যায় ক্লাব আড্ডায়। দেশ এবং ভূ-রাজনীতির পরিস্থিতিতে আগামীদিনে বিএনপি’র রাজনীতি বড্ড কঠিন। প্রশ্ন হলো বিএনপি কি বসে বসে পরিস্থিতি দেখবে। নাকি ঘুরে দাঁড়ানোর চমকপ্রদ নজির তৈরি করবে। ঢাকার এক রাজনৈতিক বিশ্লেষক অবশ্য এটা বলেছেন, বিএনপি বা দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে আমাদের নিকোলো ম্যাকিয়াভেলিকে স্মরণ রাখতে হবে। যিনি বলেছেন, ‘ইতিহাস বিজয়ীরা লিখে থাকেন।’

manabzamin