বিএনপিকে ভাঙতে পারছে না ‘কিংস পার্টি’, চাপে ছোট দল

বিএনপিকে ভাঙতে পারছে না ‘কিংস পার্টি’, চাপে ছোট দল 

বিএনপি নেতাদের দলে ভেড়াতে পারছে না ‘কিংস পার্টিগুলো’। কয়েক দিন আগেও গুঞ্জন ছিল– দলটির অনেকে বিএনএম, তৃণমূল বিএনপির হয়ে নির্বাচনে অংশ নেবেন। এ দলগুলোর জোট হবে আগামী সংসদে প্রধান বিরোধী দল। তবে মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় যত ঘনাচ্ছে, ততই স্পষ্ট হচ্ছে কিংস পার্টিগুলো বিএনপিতে ভাঙন ধরাতে পারছে না। তাই নির্বাচনে যেতে চাপ বাড়ছে ছোট নিবন্ধিত দলগুলোর ওপর।

বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার গড়া তৃণমূল বিএনপি গত ফেব্রুয়ারিতে আদালতের আদেশে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পেয়েছে। রাজপথে সক্রিয় দলগুলোকে পেছনে ফেলে আলোচনার জন্ম দিয়ে আগস্টে নিবন্ধন পায় বিএনপির সাবেক নেতাদের দল বিএনএম। এ দল দুটি কিংস পার্টি হিসেবে পরিচিত। তপশিলের পর অবশ্য বিএনএম মহাখালীর খুপরি থেকে গুলশানে আলিশান কার্যালয় সাজাচ্ছে।

বিএনপির অন্তত ৩০ নেতা সমকালকে জানিয়েছেন, দল বদল করে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রস্তাব তারা পেয়েছেন। এমপি পদের প্রলোভনও রয়েছে। তবে তা গ্রহণ করেননি। শেষ পর্যন্ত হাতেগোনা কয়েকজন যেতে পারেন কিংস পার্টিগুলোতে। তাতে জ্যেষ্ঠ পর্যায়ের কোনো নেতার চলে যাওয়া বা দলে ভাঙনের শঙ্কা নেই। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, নানাভাবে সুবিধাবাদী, উচ্ছিষ্টভোগীরা দলে ঢুকে পড়ে। সেই লোকগুলোকেই টানতে পারে।

সপ্তাহখানেক আগেও জোর গুঞ্জন ছিল, সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এহসানুল হক মিলন যাবেন বিএনএমে। তবে তাঁর ঘনিষ্ঠ সূত্র সমকালকে জানিয়েছে, এহসানুল হক মিলনকে বলা হয়েছিল বিএনপিতে কোণঠাসা মেজর হাফিজ বিএনএমের চেয়ারম্যান হবেন। তাঁরা দু’জন নেতৃত্ব দেবেন। দল বদলের চাপ এড়াতে আত্মগোপনে আছেন তিনি।

বিএনপি থেকে নেতা ভাগানোর চেষ্টার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন দলটি থেকে বহিষ্কার হয়ে বছরখানেক রাজনীতির বাইরে থাকার পর তৃণমূলের মহাসচিবের দায়িত্ব নেওয়া তৈমূর আলম খন্দকার। গত সোমবার তিনি গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তৈমূর আলম বলেছেন, সরকার গঠন নয়; তাদের লক্ষ্য আগামী সংসদে প্রধান বিরোধী দল হওয়া।

সূত্রের খবর, তৃণমূল বিএনপির চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী বিরোধীদলীয় নেতা হওয়ার আশ্বাস পেয়েছেন। তবে জাতীয় পার্টির (জাপা) সূত্র সমকালকে জানিয়েছে, একই আশ্বাস পেয়েছেন পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের। তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম এবং সরকার সমর্থক দলের জোটকে আগামী সংসদে প্রধান বিরোধী দল বানানো হবে– এ গুঞ্জনে অনিশ্চয়তায় পড়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রশ্নে ধোঁয়াশা তৈরি করেছিল জাপা। বিএনপিতে ভাঙন ধরাতে ব্যর্থ হওয়ায় কিংস পার্টিকে প্রধান বিরোধী দলের আসনে বসানোর পরিকল্পনায় পরিবর্তন এসেছে। এর পরই গত বুধবার আধা ঘণ্টার মধ্যে অবস্থান বদলে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেয় জাপা।

কিংস পার্টিগুলো বিএনপি নেতাদের নির্বাচনে নিতে না পারায়, ভোটে যেতে চাপ বেড়েছে নিবন্ধিত ছোট দলগুলোর ওপর। নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে বিএনপির সঙ্গে আন্দোলন থেকে সরে নির্বাচনে যাচ্ছে কল্যাণ পার্টি ও মুসলিম লীগ। তাদের সঙ্গে জোট বেঁধেছে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (মতিন)। এই দলের মহাসচিব জাফর আহমেদ জয় গত সপ্তাহে সমকালকে জানিয়েছিলেন, নির্বাচনে যাবে তাঁর দল।

পাঁচটি নিবন্ধিতসহ ছয় দল ‘সমমনা ইসলামী দলসমূহ’ নামে জোট করেছিল। গত মঙ্গলবার খেলাফত আন্দোলনের আমির আতাউল্লাহ ইবনে হাফেজ্জির সভাপতিত্বে জোটের সভায় সিদ্ধান্ত হয়, নির্বাচনে অংশগ্রহণের পরিবেশ নেই। কিন্তু ৪৮ ঘণ্টা পার না হতেই আতাউল্লাহ হাফেজ্জি এবং জোটের শরিক বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (বিএমএল) মহাসচিব কাজী আবুল খায়ের গণভবনে গিয়ে ভোটে যাওয়ার কথা জানান। তাদের সঙ্গে যান জোটের শরিক জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সহসভাপতি শাহীনুর পাশা চৌধুরী। তিনি বিএনপি জোটের সুনামগঞ্জ-৩ আসনের এমপি ছিলেন। ২০২১ সালে হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচিতে সহিংসতার মামলায় কারাগারে যান। জমিয়তের মহাসচিব মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দি সমকালকে বলেছেন, শাহীনুর পাশা ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন। জমিয়ত নির্বাচনে যাচ্ছে না। শাহীনুর পাশাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

জমিয়ত ছাড়াও ‘সমমনা ইসলামী দলগুলো’র অপর দুই নিবন্ধিত দল বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস এবং খেলাফত মজলিস গতকাল শুক্রবারও জানিয়েছে, নির্বাচনে যাবে না। একটি দলের যুগ্ম মহাসচিব সমকালকে বলেছেন, নির্বাচনে অংশ নিতে চাপ ও প্রলোভন রয়েছে। এ নেতা জানান, শোনা যাচ্ছিল, বিএনপি থেকে ভাগিয়ে আনা নেতারা কিংস পার্টির হয়ে নির্বাচনে যাবেন, প্রধান বিরোধ দল হবেন এবং ছোট দলগুলোকে ভোটে অংশ নিতে ‘পরামর্শ’ দিলেও খুব একটা চাপ দেয়নি বিভিন্ন সংস্থা। বিএনপিকে ভাঙার চেষ্টা ব্যর্থ হতেই এমপি বানানো এবং মামলা তুলে নেওয়ার প্রলোভন দেওয়া হয়, যা এখন চাপে রূপ নিয়েছে।

সূত্র জানিয়েছে, কল্যাণ পার্টিকে নির্বাচনে আনতে তিনটি আসন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। জমিয়তকে ছয়টি আসনের আশ্বাস দেওয়া হয়। জাতীয় পার্টির (মতিন) চেয়ারম্যান ডা. এম এ মুকিতকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে সিরাজগঞ্জের একটি আসনের। কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমকে চট্টগ্রাম-৫ আসন দেওয়া হবে। ওই আসনের এমপি জাপার সিনিয়র মহাসচিব ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ।

নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেওয়া চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলনের নেতারা জানিয়েছেন, তাদের ওপরও চাপ বেড়েছে। সূত্র জানিয়েছে, নিবন্ধন না থাকলেও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের গণঅধিকার পরিষদকে তৃণমূল বিএনপির হয়ে নির্বাচন করার ‘প্রস্তাব’ রয়েছে। সভাপতি নুরকে পটুয়াখালী-৩ আসনে ছাড় দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনে থাকা এনডিপি নামের অনিবন্ধিত দলকেও তৃণমূল বিএনপিতে ভিড়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

আদালতের রায়ে নিবন্ধন বাতিল হওয়া জামায়াতে ইসলামীর নেতারা জানিয়েছেন, তাদেরও স্বতন্ত্র বা অন্য দলের প্রার্থী হতে চাপ দেওয়া হয়েছে। তা সফল না হওয়ায় জামায়াত যেসব এলাকায় শক্তিশালী সেখানে ধর্মভিত্তিক ও দরবার ঘরানার দলগুলোকে ছাড় দিতে পারে আওয়ামী লীগ। এমন ৮ দলের নেতারা গত বৃহস্পতিবার রাতে গণভবনে যান।

ওয়ান-ইলেভেনের জরুরি অবস্থার সময়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি থেকে নেতা ভাগানোর চেষ্টা করেছিল সেই সময়ের কিংস পার্টিগুলো। পরে দলগুলো টেকেনি। এবার একই কায়দায় নেতা ভাগানোর চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ বিএনপির। নির্বাহী কমিটির সদস্য আবু নাসের মোহাম্মদ রহমাতুল্লাহ সমকালকে বলেন, ‘আমাকে এমপি বানানোর প্রলোভন দেখানো হচ্ছে ওপরের মহল থেকে। তবে আমি স্পষ্ট করে বলেছি,  জাতীয়তাবাদী আদর্শের বাইরে আমার ঠিকানা নেই।’

গত নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী হওয়া খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক শহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া ফরহাদ জানান, দল বদলে নির্বাচনে যেতে গত ৭ নভেম্বর থেকে চাপ শুরু হয়েছে। চাপের কারণে এলাকা ছেড়ে আত্মগোপনে আছেন জানিয়ে এ নেতা বলেছেন, ‘আদর্শের বাইরে যাব না, মরলে মরব। বেইমান হতে পারব না।’

রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি ইসফা খায়রুল হক শিমুল ২০১৮ সালে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। তিনি জানান, বিভিন্ন জায়গা থেকে যোগাযোগ করা হয়েছে। তবে তিনি এসবের মধ্যে নেই।

বিএনপি সূত্র জানিয়েছে, দলে নিষ্ক্রিয়, বহিষ্কৃত এবং কোণঠাসা নেতাদের টোপ দেওয়া হচ্ছে। রাজশাহীর সাবেক মেয়র মিজানুর রহমান মিনু, খুলনার মঞ্জুরুল ইসলাম মঞ্জু, পাবনার সাবেক এমপি সিরাজুল ইসলাম সরদার, কুমিল্লার আনোয়ারুল আজিম, মঞ্জুরুল আহসান মুন্সী, রাঙামাটির দীপেন দেওয়ান, টাঙ্গাইলের লুৎফর রহমান খান আজাদ, লুৎফুর মতিন, নারায়ণগঞ্জের কাজী মনির, রাজবাড়ীর আলি নেওয়াজ খৈয়াম, নেত্রকোনার আশরাফউদ্দিন খান, নওগাঁর আনোয়ার হোসেন বুলু, বরিশালের মেজবাহ উদ্দিন ফরহাদ, আব্দুস সাত্তার খান, বরগুনার নুরুল ইসলাম মনিসহ শ’খানেক নেতা দল বদলের প্রস্তাব পেয়েছেন। দলে প্রভাবশালী এমন নেতাদের মধ্যে বরকত উল্লাহ বুলু, নিতাই রায় চৌধুরীসহ আরও কয়েকজনকে একই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তবে বহিষ্কৃত নেতারাও সাড়া দিচ্ছেন না। কুমিল্লার সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কুসহ বহিষ্কৃত আড়াইশ নেতাকর্মী এরই মধ্যে দলে ফিরতে আবেদন করেছেন।

রুহুল কবির রিজভী বলেন, রাষ্ট্রীয় অর্থ লোপাট করে দলছুটদের দিয়ে সরকার নতুন দল বানাচ্ছে। জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল কখনও এমন কাজ করে না। এগুলো করে গ্রাম্য মোড়ল, টাউট, বাজে লোকরা। তা এখন সরকার করছে।

সমকাল