ফিরোজ মাহবুব কামাল 20 October 2022
ব্যর্থতাটি মানবিক গুণে বেড় উঠায়
বাংলাদেশীদের ব্যর্থতার তালিকাটি বিশাল। সে ব্যর্থতাগুলি ভয়াবহ রূপ নিয়ে বিপন্ন করছে দেশটির স্বাধীন ও সভ্য অস্তিত্বকে। তবে দেশবাসীর মূল ব্যর্থতাটি কৃষক, শ্রমিক, ব্যবসায়ী, ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ার এবং আনান্য পেশাদার রূপে বেড়ে উঠায় নয়, বরং সেটি হলো মানবিক গুণে সভ্য মানব রূপে বেড়ে উঠায়। এ ব্যর্থতা থেকেই জন্ম নিয়েছে নৈতিক, চারিত্রিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ব্যর্থতার ন্যায় নানারূপ ব্যর্থতা। বাঙালির এই ব্যর্থতার রূপটি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৃষ্টিতে প্রায় শত বছর আগেই ধরা পড়েছিল। তিনিও তাঁর এক কবিতায় বাঙালির ব্যর্থতাকে মানব রূপে বেড়ে উঠার ব্যর্থতা রূপে চিত্রিত করেছিলেন।
মনের ক্ষেদে বিধাতার কাছে প্রশ্ন রেখে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “সাত কোটি বাঙালিরে হে মুগ্ধ জননী রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করনি।”
লক্ষণীয় হলো, বাঙালি কেন মানুষ হতে ব্যর্থ হলো -তা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ কিছুই লেখেননি। তবে সেটি না লেখার কারণও রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ কবি ছিলেন, সমাজ বিজ্ঞানী ছিলেন না। ফলে তাঁর দৃষ্টিতে বাঙালির ব্যর্থতাগুলি ধরা পড়েছে, কিন্তু তার কারণগুলো ধরা পড়েনি। তবে বাঙালির ব্যর্থতা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ যে সময়ে লিখেছিলেন –সে সময়ের ব্যর্থতার স্তর থেকে বাঙালি, বিশেষ করে বাংলাদেশের বাঙালিগণ আরো বহুদূর নীচে নেমেছে। যেমন, এ শতাব্দীর শুরুর দিকে বাংলাদেশ দুর্নীতিতে পর পর ৫ বার সমগ্র বিশ্বে প্রথম হয়েছে। বিশ্বের প্রায় দুইশত দেশের মধ্যে দুর্নীতিতে ৫ বার প্রথম হওয়ার এই কদর্যকর রেকর্ডাটি একমাত্র বাংলাদেশীদের। বিশ্বের আর কোন দেশই নৈতিকতার বিচারে এতো তলানীতে নামেনি।
দুর্নীতি হলো মানবতার বিপন্ন রূপ। এরূপটি শুধু ঈমানশূণ্যতার নয়, বরং বিবেকশূণ্যতার। বিবেকশূণ্য মানুষ মুসলিম বা ঈমানদার হওয়া দূরে থাক, স্বাভাবিক মানবও হতে পারেনা। এরা জালেম, ফাসেক ও মুনাফিক হয়। অধিকাংশ মানুষ জাহান্নামে যাবে মানুষ খুন ও নারী ধর্ষণের কারণে নয়, যাবে দুর্নীতির কারণে। এটি যে কোন বিবেকবান ও দেশপ্রেমিক বাংলাদেশীর বিবেককে কাঁপিয়ে দেয়ার মত বিষয়।
মানবতার মানদন্ডে বিশ্বমাঝে বাংলাদেশীদের অবস্থান যে ৫ বার সর্বনিম্মে পৌঁছেছে -সে প্রমাণটি পেশ করেছে ট্রান্সপ্যারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের মত একটি নিরপেক্ষ ও বেসরকারী আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশীদের বিরুদ্ধে এ প্রতিষ্ঠানটির কোন যুদ্ধ নাই, শত্রুতাও নাই।
বিভিন্ন দেশের দুর্নীতির উপর মনিটরিং করাই এই প্রতিষ্ঠানটির কাজ। তবে ট্রান্সপ্যারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল যাই বলুক, বাংলাদেশে যেরূপ গুম, হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, অর্থপাচার, শেয়ার মার্কেট লুট, ব্যাংক লুট, চুরিডাকাতি, ভোটডাকাতির ন্যায় দুর্বৃত্তির প্লাবন -তা থেকে একজন সাধারণ মানুষও সহজে বুঝতে পারে দেশ কতটা দুর্নীতির গভীরে ডুবেছে।
প্রতিটি কদর্য ব্যর্থতাই –সেটি নৈতিক, অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক হোক, জাতির জন্য তা অতি বলিষ্ঠ বার্তা দেয়। সেটি নৈতিক অসুস্থতার। সে সাথে এটি সিম্পটম সভ্যতার বিচারে দ্রুত নীচে নামার। বাংলাদেশের ইতিহাসে সেই নীচে নামাটি বেগবান হয় ১৯৭১ সাল থেকে। পাকিস্তানী ২৩ বছরে কখনোই ভোটডাকাতি হয়নি। গণতন্ত্র কবরে যায়নি। একদলীয় স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা পায়নি। রাজপথে বা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মহিলারা ধর্ষিতা হয়নি। ১৯৫৪ সালে ও ১৯৭০ সালে সরকারের অধীনে দুইটি বহুদলীয় নির্বাচন হয়েছে। দেশটিতে গুম, খুন, সন্ত্রাস, অর্থপাচার, শেয়ার মার্কেট লুট ও ব্যাংক লুটের তান্ডবও ঘটেনি। পাকিস্তান আমলে এমনকি মুজিবও শত শত মিটিং-মিছিল করতে পেরেছেন। অথচ বহুদলীয় গণতন্ত্র কবরে গেছে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর।
এই বাংলাদেশেই ১৯৭১’য়ে লক্ষাধিক অবাঙালিকে –যারা বিহারী নামে পরিচিত, স্রেফ তাদের মুখের ভাষা ভিন্ন হওয়ার কারণে হত্যা করা হয়েছে। ধর্ষণ করা হয়েছে বহু হাজার অবাঙালি নারীদের। দখল করে নেয়া হয়েছে প্রায় ৬ লাখ অবাঙালিদের সবগুলি গৃহ এবং তাদের সকল দোকানপাট। গৃহ থেকে উচ্ছেদ করে তাদেরকে বস্তিতে পাঠানো হয়েছে। এমন কান্ড কি কোন সভ্য দেশে ঘটে? কিন্তু বাংলাদেশে সেটি মহা ধুমধামে হয়েছে এবং সে অসভ্যতার প্রতিরোধে কোন চেষ্টাই হয়নি।
মায়ানামারের রোহিঙ্গা মুসলিমদের সাথেও এরূপ নৃশংস ও বীভৎস অপরাধ ঘটেনি –যা হয়েছে বিহারীদের সাথে। বাঙালি মুসলিমদের ইতিহাসে এ নৃশংস অসভ্যতার ইতিহাস হাজার হাজার বছর বেঁচে থাকবে -যতদিন এদেশে বেঁচে থাকবে পদ্ম-যমুনা-মেঘনা। ১০ লাখ রোহিঙ্গাদের নিজ গৃহ থেকে উচ্ছেদ করা হলেও এখনো মায়ানমারে বহু লাখ মুসলিম নিজ ঘরে বসবাস করছে। অথচ বাংলাদেশে সে সৌভাগ্য একজন বিহারীর কপালেও জুটেনি। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালির বেড়ে উঠা নিয়ে যখন ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন তখন পচন এতোটা গভীর ছিল না। বাঙালিদের দ্বারা এতোবড় নৃশংস অপরাধ তাঁর চোখের সামনে ঘটেনি। প্রশ্ন হলো, বাঙালির বর্তমানের নৈতিক পচনটি দেখলে তিনি কি বলতেন? বাঙালির সমগ্র ইতিহাসে এরূপ নৃশংস ও অসভ্য কর্ম পূর্বে কখনোই ঘটেনি। তবে যারা চোর-ডাকাত, ভোটডাকাত, ধর্ষক ও গুম-খুন-অপহরণের নায়ক –এরূপ কুকর্ম তাদের বিবেকে নাড়া দেয় না। সভ্য ও ভদ্র হওয়া সাধও জাগে না। তারা বরং অন্য দেশ ও অন্য ভাষার মানুষের মাঝে দোষ খুঁজে এবং নিজেদের নৃশংসতা নিয়ে গর্ব করে। তাই ২০১৮ সালে সফল ভোটডাকাতি নিয়ে হাসিনা ও তাঁর অনুসারীদের কত বিজয়ের উল্লাস! অপরাধ যে অপরাধ –সে ধারণা যখন বিলুপ্ত হয়, একমাত্র তখনই অপরাধীগণ নিজেদের অপরাধ নিয়ে এরূপ উল্লাস করে।
ডাকাতদের মহল্লায় তাদের নিজস্ব রীতি-নীতি ও সংস্কৃতি থাকে। ডাকাতদের হাতে সংঘটিত নৃশংসতা নিয়ে সেখানে কখনো আলোচনা হয় না। নিজেদের নৃশংসতা তাদের কাছে কোন ইস্যুই নয়। বরং তাদের ভাবনা ভবিষ্যতের নৃশস ডাকাতির স্থান-কাল নিয়ে। নিজেদের সভ্যতর করা নিয়ে যারা ভাবে -একমাত্র তারাই নিজেদের কদর্য অভ্যাসগুলি দূর করায় উদ্যোগী হয়। অতি বিস্ময়ের বিষয়, বাঙালি সেক্যুলারিস্টদের রচিত ইতিহাসের বইয়ে একাত্তরে বাঙালিদের হাতে সংঘটিত নৃশংসতা নিয়ে কোন আলোচনা নাই। যেন একাত্তরে সকল হত্যা, সকল ধর্ষণ ও সকল নৃশংসতা কেবল পাকিস্তান আর্মী ও বিহারীদের হাতে সংঘটিত হয়েছে। লক্ষাধিক বিহারী নারী-শিশু-পুরুষ মারা গেল, হাজার হাজার বিহারী ধর্ষিতা হলো এবং তাদের ঘরবাড়ী ও দোকানপাট জবর দখল হলো যেন অন্য কোন গ্রহের লোকদের হাতে।
প্রতিটি মৃত্যুই অতি দুঃখজনক ঘটনা। নিহত হলে, মৃতরা যে পক্ষেরই হোক, তারা আর কোন পক্ষেরই দুশমন থাকে না। মৃতের দাফন ও তার নাম ও পরিচিতিটি ধরে রাখার মধ্যেই মানবতা। দায়িত্ব হলো, লাশ আপনজনদের হাতে তুলে দেয়া। এটিই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন। সভ্য মানুষদের শুধু জীবিতদের অধিকার নিয়ে ভাবলে চলে না, নিহতদের অধিকার নিয়েও ভাবতে হয়। নিজেদের ইচ্ছার কথাটি বলার নিহতদের থাকে না। সেটি জীবিতদের বুঝতে হয়। সে বোধ ও ভাবনাটি না থাকাটিই হলো অসভ্যতা ও পশুত্ব। পশুদের সে ভাবনা থাকে না।
প্রতিটি নিহত ব্যক্তিই চাইবে সে যেন মৃত পশু বা গাছের ঝরে পড়া পাতার ন্যায় পৃথীবীপৃষ্ঠ থেকে হারিয়ে না নায়। তার নামটি অন্তত নিহতের তালিকায় বেঁচে থাক। আপনজনেরা যেন তার সন্ধান পায়। ইউরোপের দেশগুলিতে শত শত বছর ধরে সেরূপ তালিকা তৈরীর ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। ফলে বহুশত বছর আগে কোথাও কেউ নিহত হলে তার আপনজন মৃতদের রেজিস্ট্র থেকে তার নামটি সহজেই বের করতে পারে। নিহতদের অধিকার তারা এভাবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে আজও সে সভ্য রীতি গুরুত্ব পায়নি। ফলে একাত্তরের নিহতরা মৃতের তালিকা থেকে হারিয়ে গেছে। বাঙালি হোক, অবাঙালি হোক –নিহতদের তালিকায় কারোই কোন তথ্য নাই। যেন তারা কোন জঙ্গলে মারা গেছে। এ থেকে বুঝা যায়, মানবের অধিকার বাংলাদেশে কত গুরুত্বহীন।
একাত্তরে কত জন মারা গেল –সে তালিকা বানালে ৩০ লাখের সংখ্যা মিলতো না। তখন প্রমাণিত হতো, মুজিব কীরূপ মিথ্যাবাদী ছিল। তখন রচিত হতো দেশের সত্য ইতিহাস। মুজিবের ইজ্জত বাঁচানোর স্বার্থে এতো বড় একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করা হলো না। মুজিবের মিথ্যাচার গুরুত্ব পেল, কিন্তু গুরুত্ব পেলে না একাত্তরের মৃতরা। নিহতদের সাথেও কত শত্রুতা! ফ্যাসিস্টগণ ইতিহাসের বয়ানকে সত্য ও সঠিক করা নিয়ে ভাবে না। তারা ভাবে নেতার ইমেজ ও মিথ্যাচারীতা বাঁচানো নিয়ে। এজন্যই একাত্তরের ইতিহাস মিথ্যাচারে ভরপুর। অথচ নিহতদের তালিকা বের করার কাজটি কোন রকেট সায়েন্সের ন্যায় জটিল ছিল না। একাত্তরে কেউ মারা গেলে শুধু আপনজনেরা নয়, গ্রামের লোকেরাও সেটি ভূলতে পারে না। অতএব সে তথ্য সংগ্রহ করা এখনো সম্ভব। কিন্তু অভাব এখানে আগ্রহের।