বিস্ময়করভাবে সাম্প্রতিককালে স্বৈরশাসনের সর্বাধিক বিস্তার ঘটছে গণতন্ত্রের লেবাসে। এমনকি যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত নিজেদেরকে যথাক্রমে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে গর্ব করে থাকে সেখানেও গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়েছে। মার্কিন বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদীর আচরণে স্বৈরশাসকের স্পষ্ট ছাপ রয়েছে। যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনী পদ্ধতি এখন অবধি গণতান্ত্রিক, তাই চূড়ান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও ভয়ংকর ক্রোধান্বিত ট্রাম্পও ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন। কিন্তু ভারতে মোদী যেভাবে বিচার বিভাগসহ সকল গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান কট্টর হিন্দুত্বকরণে সক্ষম হয়েছেন তাতে করে অদূর ভবিষ্যতে তাকে ক্ষমতা থেকে সরানোর সুযোগ সংকুচিত হয়ে আসছে বলেই আমার ধারণা। দেশটিতে মোদী ‘কাল্ট’ যে পরিকল্পিত পদ্ধতিতে নির্মাণ করা হচ্ছে তাতে করে ভবিষ্যতে বিশ্বের সফলতম স্বৈরশাসকের মুকুটটি নরেন্দ্র মোদীর মস্তকে শোভা পাওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। আগামী দুই মেয়াদ ক্ষমতা ধরে রাখতে পারলে নিঃসন্দেহে মোদীই হবেন সবচেয়ে সফল এবং ক্ষমতাবান স্বৈরশাসক। তবে এই মুহূর্তে সেই বিশ্বসেরার মুকুট একজন নারী স্বৈরশাসক পরিধান করে রয়েছেন। তার নাম শেখ হাসিনা। পাঠক দয়া করে, অবিশ্বাস কিংবা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসবেন না। আমাকে ব্যাখ্যা করবার সুযোগ দিন।
বাংলাদেশের স্বৈরশাসনের ইতিহাস দিয়ে আমার ব্যাখ্যা শুরু করছি। সাংবিধানিকভাবে এদেশে প্রথম স্বৈরশাসক ছিলেন শেখ মুজিবর রহমান। কিন্তু তার বাকশাল প্রশাসন সাকুল্যে ছয় মাস কুড়ি দিন স্থায়ী হয়েছিলো। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর একাংশের সফল অভ্যুত্থানে সেই স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটেছিল। শেখ হাসিনা সহ আওয়ামী লীগের তাবৎ নেতাকর্মী ও সমর্থকরা জেনারেল জিয়াউর রহমানকেও স্বৈরশাসক আখ্যা দিয়ে থাকেন। তর্কের খাতিরে তাদের যুক্তি মেনে নিলেও সামরিক শাসক রূপে জিয়াউর রহমানের স্বৈরশাসনের মেয়াদ ছিল ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর থেকে ১৯৭৮ সালের ৩ জুন পর্যন্ত, অর্থাৎ সাকুল্যে দুই বছর সাত মাস। এই সময়ের মধ্যে আবার অনেকটা সময় জাস্টিস সায়েম প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ছিলেন। যাই হোক, জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালের ৩ জুন এক অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জেনারেল ওসমানীকে হারিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর তার শাসনকে গণতান্ত্রিক না বলার কোন যৌক্তিক সুযোগ নাই। জন্মগতভাবে ফ্যাসিবাদী সংগঠন আওয়ামী লীগ অবশ্য যুক্তির কোন ধার ধারে না।
জেনারেল এরশাদ বাংলাদেশের সর্বজন স্বীকৃত স্বৈরাচারী শাসক ছিলেন। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া পর্যন্ত এরশাদ আট বছর আট মাস বারো দিন বাংলাদেশে স্বৈরশাসন চালাতে পেরেছিলেন। এরপর ২০০৭ সালে এক বছর ১১ মাস ১৮ দিনের জন্য ‘আধা’ স্বৈরশাসক জেনারেল মইনের আবির্ভাব হয়েছিলো। তাকে ‘আধা’ বলছি এই কারণে যে সেই সময় প্রকৃত ক্ষমতা ছিল ইন্দো-মার্কিন-ব্রিটিশ বলয়ের হাতে। জেনারেল মইন তাদের হাতের পুতুল ছিলেন মাত্র। ‘আধা’ স্বৈরশাসক মইন ২০০৮ সালের পাতানো নির্বাচনে প্রকৃত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে এখন পর্যন্ত সেখানেই আছেন। বাংলাদেশে শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের টানা এক যুগ অতিক্রান্ত হয়েছে এবং তার আজীবন ক্ষমতায় বহাল থাকার সম্ভাবনা দিন দিন উজ্জ্বল হচ্ছে।
কেবল দীর্ঘ দিন ক্ষমতা ধরে রাখায় সফলতার কারণে আমি শেখ হাসিনাকে বিশ্বের সফলতম স্বৈরশাসক বলছি না। রাশিয়ার পুতিন ২০ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকলেও তাকে আমি সফলতম স্বৈরশাসক মনে করছি না। কারণ রাশিয়া এবং চীনে প্রাতিষ্ঠানিক একনায়কতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় পদ্ধতি থাকায় সেখানে ব্যক্তির সংগে পার্টিও ক্ষমতার অংশীদার হয়ে থাকে। সে সকল রাষ্ট্রে কোন গণতন্ত্রের লেবাসের প্রয়োজন পড়ে না। মধ্য প্রাচ্যের দেশসমূহে রাজতন্ত্রের অধীনে রাজারা আজীবন ক্ষমতায় থাকলেও সেখানেও তাদের কোন ব্যক্তিগত সফলতার প্রশ্ন ওঠে না। রাষ্ট্রীয় পদ্ধতিই তাদের আজীবন ক্ষমতায় থাকার সুযোগ করে দেয়। এশিয়ায় ব্রুনেই এবং ভুটানে এই প্রকৃতির ক্ল্যাসিকাল রাজতন্ত্র রয়েছে। থাইল্যান্ডে রাজতন্ত্র থাকলেও প্রকৃত ক্ষমতা আবার সেনাবাহিনীর হাতে। অপরদিকে শেখ হাসিনা রাজাদের মত উত্তরাধিকারসূত্রে স্বৈরশাসনের অধিকার পাওয়ার পরিবর্তে বাংলাদেশে নিজেই সর্বাপেক্ষা কঠোর এবং নিপীড়নমূলক স্বৈরশাসন পদ্ধতির জন্ম দিয়েছেন। বাংলাদেশের জনগণের সকল অধিকার ছিনিয়ে চিরস্থায়ীভাবে তাদের একনায়কতান্ত্রিক শাসকের অধিনস্ত করবার যে কাজটি শেখ মুজিব সংবিধান পরিবর্তন করে প্রকাশ্যে করতে চেয়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন, গণতন্ত্রের লেবাসে গত এক যুগে সেই একই কাজ সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন তারই কন্যা। শেখ হাসিনা স্বৈরশাসন শুধু প্রতিষ্ঠিতই করেন নাই, ঘরে এবং বাইরে তার স্বৈরশাসনের বৈধতাও আদায় করে নিয়েছেন।
বাংলাদেশের সেনাবাহিনী এবং পুলিশ শেখ হাসিনার ভয়ংকর ও নির্মম ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় সর্বতোভাবে সহযোগিতা করেছে। তার নির্দেশে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা বিরোধী দল এবং ভিন্ন মতের নাগরিকদের নির্বিচারে নির্যাতন করেছে, জেলে নিয়েছে, বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করেছে এবং গুম করেছে। এ সকল অপকর্ম মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং আন্তর্জাতিক আইনে দণ্ডনীয় জানা সত্ত্বেও সেনাবাহিনী এবং পুলিশ সোৎসাহে শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত ‘ডেথ স্কোয়াড’ এর ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশের বিচার বিভাগ ফ্যাসিস্ট সরকারের চাহিদামত সকল অপকর্মের আইনগত বৈধতা দিয়েছে। সেই ২০০৮ সাল থেকে প্রতিটি সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন বিনা বাক্যব্যয়ে প্রশাসনের চাহিদা অনুযায়ী নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করেছে। শামসুল হুদা, রকিবউদ্দিন এবং নুরুল হুদা- ভিন্ন নামে এবং চেহারায় আবির্ভূত হলেও চরিত্রগতভাবে তারা ফ্যাসিবাদেরই অভিন্ন গোলাম।
বেসামরিক আমলারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের দলীয় ক্যাডারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। এতো গেল প্রশাসনের ওপর শেখ হাসিনার সর্বাত্মক নিয়ন্ত্রণের প্রমাণ। বাংলাদেশকে তিনি বিরাজনীতিকরণেও সমর্থ হয়েছেন। ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের পেশীশক্তি এবং দিল্লীর কৌশলের কাছে পরাজিত হয়ে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এখন অর্থহীন সব নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে হাসিনার স্বৈরশাসনকেই বৈধতা দিচ্ছে। বেগম খালেদা জিয়াকে শর্তযুক্ত গৃহবন্দিত্বের সুযোগ দিয়ে তার দলকে শেখ হাসিনা সম্পূর্ণরূপে জিম্মি করে ফেলেছেন। অপর বিরোধী দল জামায়াতে ইসলামী অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাকেই প্রাধান্য দিয়ে রাজপথ থেকে সরে গেছে। আলেমরা মাঝেমধ্যে ধর্মীয় বিষয় নিয়ে মাঠে নামছেন বটে, কিন্তু তারা রোগ উপেক্ষা করে উপসর্গের পেছনে ছুটে শক্তিক্ষয় করছেন। বাংলাদেশের অধিকাংশ মিডিয়া দিল্লীর প্রতি অনুগত এবং ইসলামবিদ্বেষী হওয়ায় একই আদর্শের অনুসারী শেখ হাসিনা তাদের অন্ধ সমর্থন পাচ্ছেন। বাংলাদেশে প্রকৃত এবং সৎ সাংবাদিকতা নিশ্চিহ্ন হয়েছে। এদিকে সাধারণ জনগণ দেশের স্বাধীনতা কিংবা আপন সংস্কৃতি এবং ধর্ম উপেক্ষা করে ভোগবাদের প্রতি অধিকতর আকৃষ্ট হচ্ছেন। প্রবাসে থেকে যতটুকু খোঁজখবর পাচ্ছি তাতে মনে হচ্ছে শতকরা আশি ভাগ মানুষ ফ্যাসিবাদী শাসকের পতন চাইলেও সেই মুক্তির জন্য কোনোরকম আত্মত্যাগে প্রস্তুত নয়। বাংলাদেশের জনগণের মনোভাব অনেকটাই হজরত মুসার [আঃ] কওমের মত। আল্লাহ্র তরফ থেকে অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নির্দেশ আসলে সেই উদ্ধত, সুবিধাবাদী ও ভীরু কওম মুসা [আঃ] কেই তার আল্লাহ্কে নিয়ে যুদ্ধ করতে বলেছিল। বাংলাদেশের জনগণের মানসিকতাও অনেকটা সেই রকম। তারাও চায় হাসিনার ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে অন্য কেউ লড়াই করে তাদের মুক্ত করে দিক। বিশ্বে কোথাও রক্ত না ঝরিয়ে মুক্তি মেলেনি এই সত্য তারা বিস্মৃত হয়েছে। সব মিলে শেখ হাসিনা দেশের অভ্যন্তরে একচ্ছত্র স্বৈরতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন।
শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পর্যায়ে প্রধানত ইসলামফোবিয়ায় আক্রান্ত পশ্চিমা সাম্ম্রাজ্যবাদ এবং ভারত তাকে সর্বতোভাবে সমর্থন জানায়। নয়-এগারো পরবর্তী বিশ্ব ব্যবস্থায় মানবাধিকার, গণতন্ত্র, সুশাসন ইত্যাদির পরিবর্তে ইসলাম দমন পশ্চিমাদের মূল লক্ষ্যে পরিণত হলে মুসলিম বিশ্বে শেখ হাসিনার মত ইসলামবিদ্বেষী স্বৈরশাসকদের উত্থান ঘটে। ফলে বিগত বারো বছরে বাংলাদেশের ফ্যাসিস্ট সরকার ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং নজিরবিহীন দুর্নীতিতে লিপ্ত হলেও পশ্চিমা শক্তি দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে রেখেছে। শুধু তাই নয়, শেখ হাসিনাকে রেকর্ড পরিমাণ ঋণ প্রদানের মাধ্যমে তারা ফ্যাসিস্ট শাসকের দুর্নীতির সহযোগীতেও পরিণত হয়েছে। সেই ঋণের দায় অবশ্য বাংলাদেশের জনগণকেই বহন করতে হবে। এর ফলে শেখ হাসিনা বিশ্বকে এমন একটি বার্তা দিতে সক্ষম হয়েছেন যে তার কোন বিকল্প বাংলাদেশে নাই। একই ধরনের প্রচারণা ভারতে চালিয়ে বলা হচ্ছে যে, ‘গুজরাটের কসাই’ মোদীর কোন বিকল্প ভারতে নাই। দুই দেশে প্রচারণার এই মিল যে মোটেই কাকতালীয় নয় সেটি বুঝতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় হয় ব্যর্থ হয়েছেন অথবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বুঝতে চাচ্ছেন না।
হাসিনা নিজের অপরিহার্যতার প্রচারে সফল হওয়ায় এমনকি চীন-পাকিস্তান-তুরস্ক বলয়ভুক্ত পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী রাষ্ট্রগুলো পর্যন্ত বাংলাদেশী ইসলামোফোবিক স্বৈরশাসককে মেনে নিয়েছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। কিছুদিন আগে বাংলাদেশে নবনিযুক্ত পাকিস্তানী হাই কমিশনার অনেক চেষ্টার পর শেখ হাসিনার সাক্ষাৎ পেলে বাংলাদেশী স্বৈরশাসক ১৯৭১ সালের প্রসঙ্গ তুলে পাকিস্তানের তীব্র সমালোচনা করলেও তাকে নীরব থাকতে হয়। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠন অব্যাহত পাকিস্তান বিরোধী প্রচারণা চালালেও পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ তার কোন প্রতিবাদ না করায় মনে হচ্ছে, ইমরান খান সরকার যে কোন মূল্যে শেখ হাসিনার সংগে সুসম্পর্ক গড়তে চায়। পাকিস্তান সরকারের সেই প্রত্যাশা শেখ হাসিনা পূর্ণ করবেন কিনা সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। বিগত দশ বছরে পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠতম মিত্রদেশ চীনের বাংলাদেশে বৃহত্তম একক বিনিয়োগকারী রাষ্ট্রে পরিণত হওয়াটাও তাৎপর্যপূর্ণ। তুরস্ক এবং বাংলাদেশের মধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রি পর্যায়ে পারস্পরিক সফর চলছে। বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ থেকে প্রচারণা চালানো হচ্ছে যে বর্তমান মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে সাহসী কণ্ঠ তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান আগামী বছর বাংলাদেশ সফর করবেন। তাছাড়া উভয় দেশ নাকি ইসলামের একেশ্বরবাদের বিপরীতে শেখ মুজিব এবং কামাল আতাতুর্কের মূর্তিও বিনিময় করবে। শেষোক্ত প্রচারণা অবশ্য একপাক্ষিক। মূর্তি বিনিময় হোক আর না হোক, একসময়ের চরম তুরস্কবিরোধী শেখ হাসিনা যে কোন কারণেই হোক না কেন তুরস্কের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী বলেই মনে হচ্ছে। অপরদিকে তুরস্কও ইতিবাচক সাড়া দিচ্ছে।
আজকের সম্পাদকীয় বিষয়ের ব্যাপকতার কারণে বেশ দীর্ঘ হয়ে গেল। এবার উপসংহার টানার চেষ্টা করছি। পুলিশ, সেনাবাহিনী এবং নির্বাচন কমিশনের সহায়তায় শেখ হাসিনা ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে দুটো নির্বাচনী তামাশা করে পার পেয়েছেন। পরাশক্তিরা এসব তামাশা শুধু মেনেই নেন নাই, বাংলাদেশের জনগণকে উপেক্ষা করে স্বৈরশাসক হাসিনাকে নানারকম পুরস্কারেও ভূষিত করেছেন। শুনতে পাই আজকাল এসব পুরস্কার প্রদানে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার লেনদেনও চলে। এই কিছুদিন আগে ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত বিশ্বের নিকৃষ্টতম ফ্যাসিস্ট সরকারের অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম করোনায় মারা গেলে তাকে ‘চ্যাম্পিয়ন অফ রুল অব ল’ অভিহিত করে বাংলাদেশের জনগণকে রীতিমতো অপমান করেছেন। ওদিকে শেখ হাসিনার সংগে ভারতের বিশেষ সম্পর্কের কথা জেনেও চীন তাকে উজার করে অর্থ দিয়ে চলেছে। বাংলাদেশ সরকারের অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে গুরুতর সন্দেহ থাকলেও অর্থ প্রদানের ক্ষেত্রে বিশ্ব ব্যাংক এবং এডিবি জাতীয় অর্থলগ্নীকারী প্রতিষ্ঠানও পিছিয়ে নেই। বিগত এক যুগে শেখ হাসিনা হাজার হাজার মানুষকে বিচারবহির্ভূতভাবে এবং গুম করে হত্যা করে যে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কোন কার্যকর প্রতিবাদ জানাচ্ছে না। সৌদি আরবের নাগরিকদের হত্যা অথবা হত্যা চেষ্টার অপরাধে যুক্তরাষ্ট্রে যুবরাজ এমবিএস এর বিরুদ্ধে মামলা হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের ক্ষমা পাওয়ার জন্য সৌদি আরব সরকার বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের রীতিমতো হাতেপায়ে ধরছেন। অথচ, সৌদি যুবরাজের চেয়ে অনেক গুণ বেশি বাংলাদেশী নাগরিককে হত্যা করেও শেখ হাসিনা বহাল তবিয়তে এবং নিশ্চিন্তে আছেন। তাকে কোন পশ্চিমা দেশে মামলার মুখোমুখি হতে হচ্ছে না।
অতএব, শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসন অবসানের কোন লক্ষণ কোন দিক দিয়েই দেখা যাচ্ছে না। ২০০৮ সালে আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত এক মন্তব্য-প্রতিবেদনে শেখ হাসিনার স্বৈরশাসন দীর্ঘায়িত হওয়ার আশংকা থেকে বাংলাদেশের জনগণের উদ্দেশ্যে লিখেছিলাম,
“তবে দেশপ্রেমিক, স্বাধীনতাকামী জনগণকে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য দীর্ঘস্থায়ী প্রতিরোধ সংগ্রামের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে এবং তা এখনই”।
আমার সতর্কবাণী অথবা ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধের আহবানে কোন কাজ হয় নাই। হাসিনার স্বৈরশাসন দীর্ঘস্থায়ী হয়ে জনগণের কাঁধে চেপে বসেছে। বারো বছর আগের আমার করা ভবিষ্যৎ বাণী সত্য হওয়ার চাইতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হোল, শেখ হাসিনা গত এক যুগে বিশ্বের সফলতম স্বৈরশাসকে পরিণত হয়েছেন। সেদিন অতি সীমিত সামর্থ্য নিয়ে তার স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই শুরু করার সময়ই জানতাম যে সেই অসম লড়াইয়ে আমার সফল হওয়ার কোনই সম্ভাবনা নাই। তবু অন্যায়ের কাছে বিনা প্রতিবাদে পরাভব মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলাম। আজও স্বদেশের সবকিছু ত্যাগ করে প্রবাস জীবনের অনিশ্চয়তা্র মধ্যে বসবাস করেও বিশ্বের সফলতম স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে একই লড়াই অব্যাহত রেখেছি। মুসা [আঃ] এর কওম শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন এবং অবিশ্বাসীদের পরাজিতও করেছিলেন। তবে নবী মুসা তার আগেই ইন্তিকাল করায় সেই বিজয় দেখে যেতে পারেন নাই। বাংলাদেশের জনগণও একদিন জানমালের পরোয়া না করে শেখ হাসিনার স্বৈর শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হবে সেই প্রত্যাশা নিয়ে আজকের সম্পাদকীয় শেষ করলাম।