‘সেনা কর্মকর্তাদের একটি তালিকা করা হয়েছিল। ২০০৯ সালে পিলখানায় সহকর্মী সেনা কর্মকর্তাদের পরিকল্পিত ও নৃশংসভাবে হত্যার কয়েক দিন পর ওই বছরের ১ মার্চ ঢাকা সেনানিবাসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমরা যাঁরা কিছু প্রশ্ন করেছিলাম, বিচার চেয়েছিলাম, তাঁদের তালিকা। এই তালিকার প্রথম শিকার আমরা ছয়জন। সহকর্মীদের হত্যার বিষয়ে প্রশ্ন তুলে বিচার চাওয়ার অপরাধে চাকরিচ্যুতি গুম নির্যাতনে জীবন তছনছকোনো তদন্ত এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে আমাদের বরখাস্ত করা হয়।
পরে বরখাস্তের আদেশ বাতিল করে পাঁচজনকে অকালীন অবসর দেওয়া হয়। তালিকার অন্যদেরও অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়। তরুণ পাঁচ সেনা কর্মকর্তাকে প্রায় এক বছর আটকে রেখে নির্যাতন এবং পাঁচ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। নষ্ট করে দেওয়া হয় তাঁদের ক্যারিয়ার।
অনেকের পদোন্নতি বন্ধ এবং বেশ কয়েকজনকে জঙ্গি তকমা দিয়ে বরখাস্ত এবং নির্মম নির্যাতন শেষে কারাগারে পাঠানোর ঘটনাও ঘটে।’ কালের কণ্ঠকে এই কথাগুলো বলেন ভুক্তভোগী সেনা কর্মকর্তা লে. কর্নেল (অব.) মো. সামসুল ইসলাম।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি আবার আলোচনায় এসেছে। দাবি উঠেছে ঘটনার পুনঃ তদন্তের।
অন্তর্বর্তী সরকার থেকেও এর আশ্বাস মিলছে। একই সঙ্গে ১৫ বছর আগে সহকর্মীদের ওপর চালানো ওই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার চাইতে গিয়ে চরম আক্রোশের শিকার হয়েছিলেন কিন্তু মুখ খোলার পরিবেশ পাননি, সেই সব সেনা কর্মকর্তাও এখন সরব হয়ে উঠেছেন। বলছেন, আমাদের অনেকের কাছে অনেক প্রমাণ রয়েছে। এটা বিডিআর বিদ্রোহ ছিল না। পরিকল্পিত হত্যা।
সুষ্ঠু তদন্তের আস্থা পেলে সব প্রমাণ বের হবে।
ভুক্তভোগী আরেক লে. কর্নেল (অব.) মাহদী নাছরুল্লাহ শাহীর, বিপি এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘পিলখানার নারকীয় হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে আমরা সেনা সদরের অগ্রযাত্রা ভবনের ১১ তলায় এবং সেনাকুঞ্জে ২৭ ও ২৮ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন সেনাপ্রধান মঈন উ আহমেদের সঙ্গে মিটিং করি। সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সেনা সদরে আসার জন্য বলার প্রস্তাব এবং তাঁকে জিজ্ঞেস করার জন্য কিছু প্রশ্ন নির্দিষ্ট করা হয়। দেশর সব সেনানিবাস থেকেও এ বিষয়ে সেনা কর্মকর্তাদের কাছে বিভিন্ন পয়েন্ট সংগ্রহ করা হয়। প্রধানমন্ত্রীকে কারা এই প্রশ্নগুলো করবেন তা-ও নির্ধারণ করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর কাছে এমআইর (মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স) পরিচালক এই প্রস্তাব ও প্রশ্নগুলো নিয়ে যান। এক পর্যায়ে শেখ হাসিনা সেনানিবাসে আসতে সম্মত হন। কিন্তু ওই সব প্রশ্ন উত্থাপন এবং পিলখানা হত্যাযজ্ঞের প্রকৃত তদন্ত ও বিচার চাওয়ার বিষয়টি তিনি মেনে নিতে পারেননি। আমার ধারণা, ঢাকা ও অন্য সেনানিবাস মিলিয়ে প্রায় ১০০ জনের তালিকা করা হয়েছিল। এঁদের সবাইকে শেখ হাসিনা এবং তাঁর অনুগতদের আক্রোশের শিকার হতে হয়েছে। চাকরিচ্যুত করা ছাড়াও অনেকের প্রমোশন বন্ধ করে দিয়ে চাকরির মেয়াদ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
শেখ হাসিনাকে সরাসরি প্রশ্ন করে চাকরি হারিয়েছিলেন এমন একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘১ মার্চের ঘটনায় যাঁদের তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল, তাঁদের সংখ্যা ১০০ জনের কাছাকাছি বলেই জেনেছিলাম।’
যা ঘটেছিল ১ মার্চ : রাজধানীর পিলখানায় বিডিআর সদর দপ্তরে (বর্তমানে বিজিবি) ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ঘটেছিল দেশের ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড। বিডিআরের একাংশের বিপথগামী সদস্যরা বাহিনীর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদসহ ৫৮ জন সেনা সদস্যকে (৫৭ জন কর্মকর্তা এবং একজন সৈনিক) হত্যা করেন। নারকীয় এই হত্যাকাণ্ডে ৫৮টি সেনা পরিবারের মোট ১১০ জন সন্তান পিতৃহীন হয়। চারজনের জন্ম হয় তাদের পিতা নিহত হওয়ার কয়েক মাস পর। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই বছরের ১ মার্চ সেনাকুঞ্জে সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসতে সম্মত হন। সেখানে বিভিন্ন পদমর্যাদার প্রায় দুই হাজার সেনা কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন পিলখানা হত্যাকাণ্ড থেকে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া বেশ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তাও। বৈঠকে শেখ হাসিনার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন তখনকার কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী। সেখানে পিলখানা হত্যাকাণ্ডে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, শেখ ফজলে নূর তাপস, শেখ সেলিম, স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং হুইপ মির্জা আজমের বিতর্কিত অবস্থান নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। অবিলম্বে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী ও হুইপকে বরখাস্ত করার দাবি জানানো হয়।
কেন সেনা কর্মকর্তা এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের দ্রুত উদ্ধারের ব্যবস্থা নেওয়া হলো না, র্যাব ও সেনাবাহিনীকে কেন অভিযান চালাতে দেওয়া হলো না, সেই প্রশ্নও করা হয়। জানানো হয়, সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারের নারী সদস্যরাও সেখানে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
ওই বৈঠকের অডিও ক্লিপ সে সময় প্রকাশ্যে আসে। সেনানিবাস থেকে ফিরে শেখ হাসিনা সংসদে গিয়ে বলেছিলেন, ‘ওরা তো দেখি বিএনপির ভাষায় কথা বলে।’
এ বিষয়ে লে. কর্নেল (অব.) মাহদী নাছরুল্লাহ শাহীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অন্য কয়েকজনের সঙ্গে আমিও সেদিন শেখ হাসিনাকে প্রশ্ন করার দায়িত্বে ছিলাম এবং প্রশ্ন করি। সে সময় সেনা কর্মকর্তারা নারকীয় ওই হত্যাকাণ্ডের বিচার বিভাগ ও সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণে নিরপেক্ষ কমিটির মাধ্যমে সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানান।’
লে. কর্নেল (অব.) মো. সামসুল ইসলাম বলেন, পিলখানা হত্যাকাণ্ড থেকে বেঁচে আসা সেনা কর্মকর্তারা বক্তব্য দেওয়ার সময় কান্না আটকাতে পারেননি। এটি অন্যদের মধ্যেও প্রভাব ফেলে। আবেগতাড়িত ক্ষোভ প্রকাশের ঘটনাও ঘটে। কিন্তু সহকর্মীদের হারানোর বেদনা থেকে স্বাভাবিক এই ক্ষোভ প্রকাশের জন্য সংশ্লিষ্ট সেনা কর্মকর্তাদের চরম মাসুল দিতে হয়।
প্রথমে যাঁদের বরখাস্ত করা হয়েছিল : প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা ২০০৯ সালের ৭ জুনের প্রজ্ঞাপন (নং প্রম/সাঃস/বর/০৯/ডি-১৮/১৫৩) থেকে জানা যায়, ২০০৯ সালের ১ মার্চের ঘটনায় বাংলাদেশ আর্মি অ্যাক্ট সেকশন-১৬, আর্মি অ্যাক্ট (রুলস) ৯এ, আর্মি রেগুলেশনস (রুলস) ৭৮(সি), ২৫৩(৩), ২৫৪ অ্যাপেনডিক্স জি, ২৬৯-এ এবং ২৬১ ধারা মোতাবেক ছয়জনকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। প্রজ্ঞাপনে তাঁদের পরিচয় জানানো হয়—(১) বিএ-৩১৩২ লে. কর্নেল মো. সামসুল ইসলাম, পিএসসি, আর্টিলারি, (২) বিএ-৩৩৬০ লে. কর্নেল মাহদী নাছরুল্লাহ শাহীর, বিপি, পদাতিক, (৩) বিএ-৩৫৬৩ লে. কর্নেল মো. শফিউল হক চৌধুরী, পিএসসি, সিগন্যালস, (৪) বিএ-২৬১৭ মেজর মো. মোহসিনুল করিম, পদাতিক, (৫) বিএ-৬৪১১ ক্যাপ্টেন হাবিবা ইসলাম ইঞ্জিনিয়ার্স এবং (৬) বিএ-৬৫৬০ ক্যাপ্টেন এ কে এম আন্নুর হোসেন, ইঞ্জিনিয়ার্স।
পরে ২০১০ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ও ২ মে বরখাস্তের প্রজ্ঞাপন বাতিল করে পাঁচজনকে অকালীন অবসর দেওয়া হয়।
এই বরখাস্তের ঘটনাটি সে সময় উইকিলিকসের ফাঁস করা ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের তারবার্তাগুলোর একটিতে উল্লেখ করা হয়েছিল। ওই তারবার্তায় সাতজনকে বরখাস্ত করার কথা বলা হয়।
বিষয়টি সম্পর্কে লে. কর্নেল (অব.) মাহদী নাছরুল্লাহ শাহীর বলেন, ‘প্রথমে আমাদের ছয়জনকেই বরখাস্ত করা হয়েছিল। আমরা পাঁচজন আমাদের বরখাস্তের বিষয়টি পুনর্বিবেচনার আবেদন করেছিলাম। কিন্তু মোহসিনুল করিম স্যার সম্ভবত আবেদন করেননি।’
কথিত হত্যাচেষ্টায় পাঁচজনের সশ্রম কারাদণ্ড : ২০০৯ সালের ২১ অক্টোবর সন্ধ্যায় মতিঝিলে বাংলার বাণী কার্যালয়ের সামনে শেখ ফজলে নূর তাপসের গাড়িতে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। প্রচার হয়, গাড়িতে দূরনিয়ন্ত্রিত (রিমোট কন্ট্রোলড) বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে এবং তাতে ১৩ জন আহত হয়েছেন। ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন তাপস। এ ঘটনায় বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে মেজর ডালিমের ভাই কামরুল হক স্বপন, মেজর (অব.) বজলুল হুদার ভাতিজা আতাউল হুদা, লে. কর্নেল (অব.) মহিউদ্দিনের দুই ছেলে নাজমুল হাসান সোহেল ও মাহাবুবুল হাসান ইমরান, কর্নেল (অব.) আবদুর রশিদ খন্দকারের মেয়ে মেহেনাজ রশিদ এবং ফ্রিডম পার্টির সদস্য আবদুর রহিমসহ মোট আটজনকে গ্রেপ্তার ও এজাহার নামীয় আসামি করা হয়। পরে ডিবি পুলিশ ওই ঘটনা পিলখানা হত্যাকাণ্ডের জেরে ঘটে থাকতে পারে বলে তাদের সন্দেহের কথা জানায়। এরপর কর্তব্যরত অবস্থায় উঠিয়ে নেওয়া হয় সেনাবাহিনীর পাঁচ কর্মকর্তা মেজর হেলাল, মেজর রেজাউল করিম, ক্যাপ্টেন রাজিব, ক্যাপ্টেন ফুয়াদ ও ক্যাপ্টেন খান সুবায়েল বিন রফিককে। ভুক্তভোগীরা জানান, প্রায় এক বছর আটক অবস্থায় রেখে তাপসকে হত্যাচেষ্টায় তাঁদের সংশ্লিষ্টতার স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা চালানো হয়। এরপর তাঁদের বরখাস্ত করে সামরিক আদালতে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়ে ২০১০ সালের ৪ নভেম্বর তাঁদের কারাগারে পাঠানো হয়। কারাভোগ শেষে এই পাঁচ সেনা কর্মকর্তা মুক্তি পান ২০১৪ সালের এপ্রিলে। শুরু হয় একেবারে নিঃস্ব অবস্থায় জীবন-জীবিকার প্রাণান্তকর লড়াই। এদিকে তাপসকে হত্যাচেষ্টার মামলায় পুলিশ কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। পুলিশ আদালতে দাখিল করা তদন্তের অগ্রগতি প্রতিবেদনগুলোতে বহু বছর ধরে বিষয়টি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সঙ্গে সম্পর্কিত বলে এলেও গত ১৮ সেপ্টেম্বর এই মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে। এতে এজাহার নামীয় আটজন আসামিকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন জানিয়ে বলা হয়েছে, তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করার মতো পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সাব-ইন্সপেক্টর মো. স্বপন মিয়া এই চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।
এ ঘটনার ভুক্তভোগী সেনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন খান সুবায়েল বিন রফিক বর্তমানে মালয়েশিয়াপ্রবাসী। এরই মধ্যে তিনি ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পিলখানা হত্যাযজ্ঞের তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর অনুগতদের অন্যায় আদেশ না মানার কারণেই আমাকে ও আমার সহকর্মীদের তাপসের ওপর কথিত বোমা হামলার দায় চাপানো হয়।
আরেক ভুক্তভোগী রেজাউল করিম বলেন, ‘আমাকে যখন তুলে নেওয়া হয়, সে সময় আমি সদ্য মেজর পদে পদোন্নতি পেয়েছি, কিন্তু র্যাংক ব্যাজ পরার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়নি। আটকে রেখে আমাকে এই স্বীকারোক্তি দিতে চাপ প্রয়োগ করা হয় যে তাপসের ওপর বোমা হামলা হয়েছে তারেক রহমানের পরিকল্পনায়। শেখ হাসিনার নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসান, পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম—এঁরা এ বিষয়ে তৎপর ছিলেন। কিন্তু আমি রাজি হইনি।’
তদন্ত প্রতিবেদন বিষয়ে খান সুবায়েল বিন রফিক বলেন, ‘পিলখানা হত্যাকাণ্ডের চার মাস পর বিডিআরে আমার পোস্টিং হয়। সে সময় ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করে বিচারের লক্ষ্যে একাধিক তদন্ত চলমান ছিল। সেনাবাহিনী ও র্যাবের পক্ষ থেকেও তদন্ত চলে। পুলিশের পক্ষ থেকে চলা তদন্তের দায়িত্বে ছিলেন আবদুল কাহার আকন্দ ও মনিরুল ইসলাম। আর বিডিআরের অভ্যন্তরীণ তদন্তের দায়িত্বে ছিলেন সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ। আমার দায়িত্ব ছিল সব তদন্ত কমিটির মধ্যে সমন্বয় করা। সে কারণে আমার কাছে বিভিন্ন প্রতিবেদন আসে। ২০০৯ সালের ১৪ অক্টোবর বিডিআরের তৎকালীন ডিজি মইনুল ইসলাম ও আমাকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর কার্যালয়ে ডাকেন। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে তদন্তের রিপোর্ট পেশ করি। এতে ব্যারিস্টার তাপস, শেখ সেলিম, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজম—এঁদের নাম ছিল। উনি রিপোর্টটি ছুড়ে ফেলে দিয়ে বিশেষ ইনস্ট্রাকশন অনুসারে কাজ করতে বলেন। মইনুল ইসলাম আমাকে বলেন, রিপোর্টে যেন কোনো রাজনৈতিক নেতার নাম না আসে, পুলিশের রিপোর্টের ভিত্তিতেই সব কিছু করতে হবে, সেনাবাহিনী ও র্যাবের রিপোর্টের ভিত্তিতে কিছু করা যাবে না। এরপর আবারও আমাদের দুজনকে প্রধানমন্ত্রী ডাকেন। সেদিনও ‘ইনস্ট্রাকশন’ অনুসারে কাজ না হওয়ায় তিনি ক্ষুব্ধ হন। এরপর আমাকে পিলখানা থেকে তুলে নেওয়া হয়। ৩৬১ দিন ডিজিএফআইয়ে রাখা হয় আমাকে। পরে কারাগারে। ওই বছরের ১ মার্চও সেনা সদরে শেখ হাসিনাকে যাঁরা প্রশ্ন করেন, সহকর্মীদের নির্মমভাবে হত্যার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন, তাঁদের তালিকায়ও আমাদের নাম ছিল।’
তাপসের ওপর বোমা হামলা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ঘটনার সময় আমরা আমাদের কর্মস্থলে দায়িত্ব পালন করছিলাম। আমাদের তিনজনের পোস্টিং ছিল পিলখানায় বিডিআর হেডকোয়ার্টার্সে। পরে জেনেছি, গাড়ির এসি বিস্ফোরণকে বোমা বিস্ফোরণ বলে চালানো হয়।’
খান সুবায়েল বিন রফিকদের ওপর অমানবিক আচরণের বিবরণ বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের কাছে একাধিকবার তুলে ধরেন তাঁদের স্বজনরা। সর্বশেষ ২০১১ সালের ৯ মে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানকে লিখিতভাবে তাঁরা জানান, তদন্তের নামে ২০১০ সালের ২৭ এপ্রিল থেকে ইন্টারোগেশন সেলে নিয়ে এই সেনা কর্মকর্তাদের দীর্ঘ এক মাস চোখ ও হাত বেঁধে অমানবিক শারীরিক নির্যাতন ও প্রাণনাশের ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করা হয়। এ অবস্থায় তাঁদের উত্কণ্ঠিত পরিবারের সদস্যরা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করে জানতে পারেন, তাঁদের ওপর আনা বোমা হামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ স্বীকার না করা পর্যন্ত বিশেষ সেলে তদন্ত অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত চলবে। এদিকে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, ব্যারিস্টার তাপসের ওপর কথিত বোমা হামলার ঘটনা দেখিয়ে ২০১০ সালে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার জাতীয় সংসদে শেখ পরিবারের জন্য আজীবন এসএসএফ নিরাপত্তা বিল পাস করে।
প্রতিকার চেয়ে আবেদন : সাবেক সেনা কর্মকর্তা রেজাউল করিম ও ড. খান সুবায়েল বিন রফিক শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত আগস্টেই সেনাপ্রধানের কাছে পৃথকভাবে তাঁদের প্রাপ্য সুবিধা ও সম্মান পুনরুদ্ধার চেয়ে আবেদন করেছেন। অন্যরাও এই আবেদন করেছেন বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান। ড. খান সুবায়েল বিন রফিক বলেন, ‘বর্তমান সেনাপ্রধান সব তথ্য-প্রমাণ যাচাই করে সামরিক আদালত থেকে আমাদের যে দণ্ড দেওয়া হয়েছিল, তা পুনর্বিবেচনা করবেন বলে আশা করছি।’
গত ১৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীর রাওয়া ক্লাবে আয়োজিত এক সেমিনারে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সশস্ত্র বাহিনী থেকে চাকরি হারানো ২৩০ জন কর্মকর্তার পক্ষে তাঁদের চাকরি ফিরিয়ে দেওয়া অথবা ক্ষতিপূরণের দাবি জানানো হয়। রাওয়া রিসার্চ অ্যান্ড স্টাডি ফোরাম (আরআরএসএফ) আয়োজিত ‘জুলাই-আগস্ট-২০২৪ বিপ্লবে সশস্ত্র বাহিনীর অবদান এবং বিপ্লবোত্তর ভূমিকা’ শীর্ষক ওই সেমিনারে জানানো হয়, এ বিষয়ে আবেদনকারী ২৩০ জন কর্মকর্তার মধ্যে সেনাবাহিনীর ১৮৫ জন এবং নৌবাহিনীর ৪৫ জন কর্মকর্তা রয়েছেন। তাঁদের আবেদন ও তালিকা গত ১ সেপ্টেম্বর সেনা সদরের সেন্ট্রাল রেকর্ড অফিসে জমা দেওয়া হয়েছে। একই আবেদন ও তালিকা গত ৫ সেপ্টেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বরাবরও জমা দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া গত রবিবার আওয়ামী লীগ শাসনামলে অবৈধভাবে চাকরিচ্যুত সশস্ত্র বাহিনীর (সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী) সদস্যদের প্ল্যাটফরম ‘সহযোদ্ধা’র পক্ষ থেকে চাকরিতে বহাল অথবা ক্ষতিপূরণসহ তিন দফা দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হয়। সংগঠনটির প্রধান সমন্বয়ক সাবেক সেনা কর্মকর্তা নাইমুল ইসলাম বলেন, ‘সশস্ত্র বাহিনীর প্রায় ৩০০ সদস্যকে বিগত সরকার অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত করেছে। সে কারণে প্রধান উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি দিয়েছি। আমরা চাই আমাদের যৌক্তিক এই দাবিগুলো মেনে নেওয়া হোক।’