তারা দেখতে চাইছে, শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি কোন দিকে গড়ায়। যদিও এর মধ্যেই ধর্মভিত্তিক নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত প্রায় সব দলই যে যার মতো করে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। একই সঙ্গে যার যার আঙিনায় দলীয় শক্তি বৃদ্ধির চেষ্টা করছে।
ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন রাজনীতিতে বেশ সক্রিয়। জামায়াত প্রায় দুই যুগ ধরে বিএনপির সঙ্গে আন্দোলন ও নির্বাচন করছে। সম্প্রতি বিএনপি ২০-দলীয় জোট অনানুষ্ঠানিকভাবে ভেঙে দেওয়ার পর জোটবদ্ধ রাজনীতির নতুন যে মেরুকরণ হয়েছে, তাতে জামায়াত বাদ পড়েছে। প্রথম দুটি কর্মসূচির পর তারা যুগপৎ কর্মসূচি থেকে দূরে রয়েছে। এ অবস্থায় চলমান আন্দোলন এবং আগামী জাতীয় নির্বাচনে জামায়াতের ভূমিকা কেমন হবে, তা এখনো চূড়ান্ত নয়। যদিও দলের নেতারা বলছেন, তাঁরা সরকারবিরোধী আন্দোলনে আছেন, থাকবেন।
জামায়াতের দায়িত্বশীল একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আন্দোলন এবং নির্বাচন প্রশ্নে বিএনপির সঙ্গে তাঁদের বনিবনা হবে কি হবে না, সেটি দুই পক্ষের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। তবে একটি বিষয়ে জামায়াত একমত যে বর্তমান সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। সেটি ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে প্রমাণিত হয়েছে।
তাই এই সরকারের কর্তৃত্বে জামায়াতের নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত অনেকটাই চূড়ান্ত। তবে নির্বাচনকালীন সরকারে যদি বড় ধরনের বিশ্বাসযোগ্য পরিবর্তন আসে এবং সেটি যদি বিরোধী দলগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়, সে ক্ষেত্রে জামায়াতও সে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে।
দলের উচ্চপর্যায়ের সূত্রগুলো বলছে, কাঠামোগতভাবেই জামায়াতের এক রকম নির্বাচন প্রস্তুতি এবং প্রার্থী বাছাই করা থাকে। এবার তারা ১০০টি আসন ধরে নির্বাচনের ব্যাপারে মনোযোগী। নির্বাচন কমিশনে (ইসি) জামায়াতের নিবন্ধন নেই। তাই ২০১৮ সালের নির্বাচনে তারা বিএনপির ‘ধানের শীষ’ প্রতীকে প্রার্থী হয়েছিল। এবার বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা হওয়ার সম্ভাবনা কম। তাই স্বতন্ত্রভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছে জামায়াত।
এ বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নায়েব আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান সরকার ২০১৪ ও ২০১৮ সালে জনগণের ভোটে ক্ষমতায় আসেনি। সুতরাং গণতন্ত্র এবং মানুষের অধিকার রক্ষায় জনগণের ভোটে নির্বাচিত একটি সরকার প্রয়োজন। এ জন্য সব বিরোধী দলের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মাধ্যমে একটি দলনিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা জরুরি; যার মাধ্যমে একটি জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকার গঠিত হবে।
অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার চরমোনাইয়ের পীর সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিমের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন। কিন্তু আগামী নির্বাচনে দলটির অবস্থান কী হবে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। যদিও বর্তমান নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে রাষ্ট্রপতির সংলাপ, এরপর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ইসির সংলাপে অংশ নেয়নি ইসলামী আন্দোলন। এখন দলটি বলছে, নির্বাচন কমিশন সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করলে তারা নির্বাচনে অংশ নেবে। একই সঙ্গে তারা একটি নির্বাচনী মোর্চা গঠনেরও চেষ্টা চালাচ্ছে।
ইসলামী আন্দোলনের নেতারা মনে করেন, নির্বাচনকালে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য যথেষ্ট নয়। তাঁরা সর্বদলীয় জাতীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন চান।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আগামী নির্বাচনে দলটি কী করতে চায়, তার স্পষ্ট ইঙ্গিত আছে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি বরিশালের চরমোনাইয়ের বার্ষিক মাহফিলে দলের আমিরসহ দুই নেতার বক্তব্যে।
আমির সৈয়দ রেজাউল করিম বলেছেন, তাঁরা সব ইসলামি দলের সমন্বয়ে মজবুত প্ল্যাটফর্ম গঠনে কাজ করছেন। আর জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান বলেছেন, নির্বাচন কমিশন সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করলে তাঁরা নির্বাচনে অংশ নেবেন। তাঁরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয়, সর্বদলীয় জাতীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন চান।
এই ‘জাতীয় সরকার’-এর রূপরেখা কেমন হবে, জানতে চাইলে গাজী আতাউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমাদের (দলের) রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। তবে আমরা একটি পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা দেব। তারা (জাতীয় সরকার) সর্বোচ্চ ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন করবে। এই সরকারে বিএনপি থাকবে, আওয়ামী লীগও থাকবে। সবাইকে সমন্বয় করে সমঝোতায় আসতে হবে।’
বিগত রংপুর ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনসহ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অনেক জায়গায় ভালো ভোট পেয়ে রাজনৈতিক মহলের নজরে আসে ইসলামী আন্দোলন। এখন দলটি চেষ্টা করছে সমমনা এবং কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক মোট আটটি দল নিয়ে নির্বাচনী মোর্চা গড়তে। দলগুলো হলো প্রয়াত শায়খুল হাদিস প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, মুফতি ফজলুল হক আমিনীর ইসলামী ঐক্যজোট, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম (যিয়াউদ্দীন), বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন (আতাউল্লাহ), খেলাফত মজলিস (ইসহাক), নেজামে ইসলাম পার্টি, ফরায়েজি আন্দোলন ও বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (আবুল খায়ের)। প্রায় সব দলের সঙ্গে ইসলামী আন্দোলনের অনানুষ্ঠানিক কথাবার্তাও হয়েছে।
তবে ওপরে উল্লিখিত দলগুলোর মধ্যে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক চারটি দলের দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরা ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে নির্বাচনী জোট গঠনে আগ্রহী নন।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব জালালুদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এই মুহূর্তে জোটের পরিবেশ লক্ষ্য করছি না। তা ছাড়া আমরা নিজেরাও জোটের ব্যাপারে আগ্রহী না। আমাদের মহাসচিব (মাওলানা মামুনুল হক) কারাবন্দী আছেন। তাঁকে মুক্ত করাসহ আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিয়ে আমরা ব্যস্ত আছি।’
নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪০টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ধর্মভিত্তিক ইসলামি দল ১০টি। এর মধ্যে কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক দল আছে ৬টি। সেগুলো হলো ইসলামী আন্দোলন, ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও খেলাফত মজলিস। এর মধ্যে ইসলামী আন্দোলন ছাড়া বাকি পাঁচটি দলই একসময় বিএনপির সঙ্গে জোটে ছিল। এখন মূল দলের কোনোটিই বিএনপির সঙ্গে নেই। তবে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও ইসলামী ঐক্যজোট নামে দুটি খণ্ডিত অংশ বিএনপির সঙ্গে আছে, যাদের নিবন্ধন নেই।
ইসির নিবন্ধিত জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী প্রথম আলোকে বলেন, ‘নির্বাচনে অংশগ্রহণের পূর্বশর্ত হচ্ছে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য পরিবেশ তৈরি করা, যাতে সব দল সমান সুযোগ নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। আমরা সেই দাবিতে অটল আছি। একই সঙ্গে নির্বাচনের প্রস্তুতিও রাখছি, যাতে পিছিয়ে না থাকি।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, মুফতি ফজলুল হক আমিনী প্রতিষ্ঠিত ইসলামী ঐক্যজোট ও আতাউল্লাহ হাফেজ্জীর খেলাফত আন্দোলন সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বজায় রেখে চলছে। তারা শেষ পর্যন্ত সরকারের সঙ্গেই থাকতে পারে বলে দল দুটির শীর্ষ নেতাদের ঘনিষ্ঠরা জানিয়েছেন।
এর বাইরে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশন, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট ও জাকের পার্টি আগে থেকেই সরকারের সঙ্গে রয়েছে। আগামী নির্বাচনে হেরফের হওয়ার সম্ভাবনা কম বলে জানা গেছে।
তবে ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা নির্বাচনে কী করব, সেটা আগামী জুন-জুলাই মাসের আগে বলতে পারছি না।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আগামী নির্বাচনে ইসলামি দলগুলোর মধ্যে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের ভূমিকা কী হয়, সেটি হবে গুরুত্বপূর্ণ। এবার জামায়াতকে দূরে সরিয়ে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলনকে কাছে টানার চেষ্টা করছে বিএনপি। যদিও এখন পর্যন্ত ওই দল থেকেই সাড়া মেলেনি।