দেশী কোম্পানির গ্যাসের মূল্য ১৭৩৫ কোটি টাকা, এলএনজিতে ব্যয় ৩২০০০ কোটি টাকা

দেশে স্থানীয় পর্যায়ে গ্যাস উত্তোলনে নিয়োজিত সরকারি কোম্পানি তিনটি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে কোম্পানিগুলো মোট গ্যাস সরবরাহ করেছে ৮৪১ কোটি ২০ লাখ ঘনমিটার। এ গ্যাস বিক্রি করে মূল্য পাওয়া গেছে ১ হাজার ৭৩৫ কোটি টাকা। অন্যদিকে গত অর্থবছরে আমদানীকৃত এলএনজি সরবরাহ হয়েছে ৫৭৪ কোটি ৫২ লাখ ঘনমিটার। এ অনুযায়ী গত অর্থবছরে এলএনজি আমদানি হয়েছে স্থানীয় সরকারি গ্যাস উত্তোলনকারী কোম্পানিগুলোর মোট সরবরাহের ৬৮ শতাংশের সমান।

এই এলএনজি আমদানির ব্যয়ের হিসাব-সংক্রান্ত চূড়ান্ত তথ্য এখনো প্রকাশ করেনি পেট্রোবাংলা। তবে সংস্থাটির অর্থ ও অপারেশনস বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত অর্থবছরে দেশে এলএনজি আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৩২ হাজার কোটি টাকারও বেশি। সে অনুযায়ী গত অর্থবছরে এলএনজিতে ব্যয় হয়েছে স্থানীয় সরকারি কোম্পানিগুলোর উত্তোলনকৃত গ্যাসের বিক্রয়মূল্যের ১৮ গুণেরও বেশি।

দেশের গ্যাস খাতে এলএনজির অবদান ও এ বাবদ ব্যয়ের অসামঞ্জস্য নিয়ে আপত্তি রয়েছে বিশেষজ্ঞদের। তাদের ভাষ্যমতে, অস্থিতিশীল বাজার থেকে উচ্চ মূল্যের এলএনজি আমদানি করে দেশের জ্বালানি খাতের আর্থিক স্বাস্থ্যকে হুমকিতে ফেলা হয়েছে। বিশেষ করে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কিনতে গিয়ে পেট্রোবাংলার আর্থিক চাপ ও দায়দেনা এখন ক্রমেই বেড়ে চলেছে।

পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, দেশের স্থানীয় তিন গ্যাস কোম্পানি বর্তমান দৈনিক গ্যাস উত্তোলন করছে ১০৯ কোটি ঘনফুট। কোম্পানিগুলো প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের জন্য মূল্য পায় ১০ টাকা। আর বিদেশী উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠানের (আইওসি) কাছ থেকে প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যায় ২ ডলারে। জাতীয় গ্রিডে স্বাভাবিক সময় এলএনজি সরবরাহ হয় ৭৫ থেকে ৮০ ঘনফুট। এখন সরবরাহ হচ্ছে ৫৯ কোটি ৭০ লাখ ঘনফুট। পেট্রোবাংলা গত অর্থবছরে এ এলএনজি কিনতে ব্যয় করেছে প্রতি এমএমবিটিইউতে (হাজার ঘনফুটের সমান) ২৫-৩৫ ডলার পর্যন্ত।

অবদান ও ব্যয় বিবেচনায় গ্যাস খাতে আমদানীকৃত এলএনজির ওপর নির্ভরশীলতা দেশের সার্বিক অর্থনীতিতেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরূল ইমাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এলএনজি জাতীয় গ্রিডে সীমিত অবদান রাখছে। অথচ এটি মোট গ্যাসের আর্থিক ব্যয়ের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায় এ সীমিত পরিমাণ গ্যাস আনতে গিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হচ্ছে। এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে আমদানি সর্বনিম্ন পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। সেই সঙ্গে স্থানীয় পর্যায়ে উত্তোলনকৃত গ্যাসের জোগান বাড়াতে হবে। তাতে অর্থনৈতিকভাবে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের পাশাপাশি গ্যাস খাতের কোম্পানিগুলোর ঝুঁকিও কমে আসবে।’

পেট্রোবাংলার হিসাব অনুযায়ী, দেশের অভ্যন্তরে মোট গ্যাস উত্তোলনে সরকারি তিন কোম্পানির হিস্যা ৩৭ শতাংশ। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে তিনটি কোম্পানির মোট গ্যাস বিক্রির পরিমাণ ছিল ৮৪১ কোটি ২০ লাখ ঘনমিটার, যার মূল্য ছিল ১ হাজার ৭৩৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গ্যাস বিক্রি করেছে বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড (বিজিএফসিএল)। কোম্পানিটির গ্যাস উত্তোলনের পরিমাণ গত অর্থবছরে ছিল ৬১৭ কোটি ৪৩ লাখ ঘনমিটার। বিক্রয়মূল্য ছিল ১ হাজার ৬২ কোটি টাকা। মোট গ্যাস উত্তোলনের ২৭ শতাংশ এসেছে বিজিএফসিএলের গ্যাস ফিল্ডগুলো থেকে।

বিপুল পরিমাণের মজুদ নিয়েও গ্যাস উত্তোলনে সবচেয়ে পিছিয়ে সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড (এসজিএফএল)। সংস্থাটি গত অর্থবছরে ১৫২ কোটি টাকার গ্যাস বিক্রি করেছে। বিক্রি করা গ্যাসের পরিমাণ ছিল ৯০ কোটি ৭৭ লাখ ঘনমিটার। এছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান বাপেক্স এ সময় গ্যাস বিক্রি করেছে ১৩৩ কোটি ঘনমিটার। সংস্থাটি গ্যাস বিক্রি করেছে ৫২১ কোটি টাকার।

জাতীয় গ্রিডে স্থানীয় পর্যায়ে উত্তোলিত গ্যাসের অবদান প্রায় ৭৫ শতাংশ। বাকি ২৫ শতাংশের সংস্থান হয় এলএনজি আমদানির মাধ্যমে। স্থানীয় গ্যাসের সরবরাহ কমায় ২০১৮ সাল থেকে আমদানি করা হচ্ছে এলএনজি। শুরুতে পণ্যটি কম মূল্যে পাওয়া গেলেও ২০২২ সালে ব্যাপক মাত্রায় অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে এলএনজির আন্তর্জাতিক বাজার। এতে এ বাবদ পেট্রোবাংলার ব্যয়ও আকস্মিকভাবে বেড়ে যায়। গত পাঁচ অর্থবছরে এলএনজি আমদানি করতে গিয়ে সংস্থাটিকে ব্যয় করতে হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার কোটিরও বেশি টাকা। বর্তমানে এলএনজি আমদানি আরো বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। গত জুনে কাতার ও ওমানের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি দুটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে জ্বালানি বিভাগ। এছাড়া স্পট মার্কেট থেকেও আমদানি হচ্ছে এলএনজি।

রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (আরপিজিসিএল) তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট ৫৭৪ কোটি ৫২ লাখ ঘনমিটার এলএনজি সরবরাহ হয়েছে জাতীয় গ্রিডে। দেশে এলএনজি ক্রয় করে জ্বালানি বিভাগ। আর জ্বালানি বিভাগের হয়ে এলএনজি আমদানির প্রাক্কলন ও ব্যয় হিসাব করে পেট্রোবাংলা। সংস্থাটি এখনো তাদের ২০২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি।

বিষয়টি নিয়ে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে পেট্রোবাংলার দুই কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেছেন, গত অর্থবছরের মধ্যে বড় একটি সময় পেট্রোবাংলাকে এলএনজি কার্গো আনতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে।

সুনির্দিষ্টভাবে হিসাব না দিতে পারলেও এ ব্যয়ের পরিমাণ ৩২ হাজার কোটি টাকার কম নয় বলে জানিয়েছেন তারা।

পেট্রোবাংলার আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রিগ্যাসিফিকেশন চার্জসহ সংস্থাটির এলএনজি আমদানি বাবদ ব্যয় হয় ১১ হাজার ৮১২ কোটি ৫২ লাখ টাকা। এরপর ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৬৬টি কার্গো এলএনজি আমদানি করে পেট্রোবাংলা। এর জন্য সংস্থাটিকে গুনতে হয় ১৭ হাজার ৫০২ কোটি ৬২ লাখ টাকা। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে ৭২টি কার্গো আমদানির বিপরীতে ২০২০-২১ অর্থবছরেও ব্যয় হয় সাড়ে ১৭ হাজার কোটি টাকারও বেশি। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে জ্বালানি পণ্যটি আমদানিতে পেট্রোবাংলার ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩৮ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা। গত দুই অর্থবছরের চূড়ান্ত আর্থিক প্রতিবেদন এখনো প্রকাশ করেনি পেট্রোবাংলা। তবে গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) এলএনজিতে আমদানি ব্যয় ৩২ হাজার কোটি টাকার কম হবে না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে।

এলএনজি আমদানির শুরুতে আর্থিক ব্যয় বাড়ার পাশাপাশি গত পাঁচ অর্থবছরে পেট্রোবাংলার এলএনজি আমদানির পরিমাণও হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পেট্রোবাংলার এলএনজি আমদানির পরিমাণ ছিল ৩২৮ কোটি ২০ লাখ ঘনমিটার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা বেড়ে হয় ৫৭৪ কোটি ৫০ লাখ ঘনমিটার। ২০২০-২১-এ আমদানি হয় ৬১১ কোটি ৯০ লাখ ঘনমিটার আর ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ৬৮১ কোটি ঘনমিটার।

নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে পেট্রোবাংলার অপারেশনস বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এলএনজি আমদানি আমাদের প্রয়োজন। স্থানীয়ভাবে আমাদের চাহিদার বড় সরবরাহ এখন নেই। আর বিদেশ থেকে আমদানি করতে হলে যখন যে দাম পড়বে, তখন সে মূল্য দিয়েই তো কিনতে হবে। আমরা স্থানীয় পর্যায়ে গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর চেষ্টা করছি। এরই মধ্যে বেড়েছেও।’

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ম. তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘স্থানীয় গ্যাস কোম্পানি ও আইওসির গ্যাস আমরা খুব স্বল্প দামে কিনি। কিন্তু সেই দামের সঙ্গে এলএনজির হিসাব মেলানো যাবে না। প্রভাবটা যেখানে পড়ছে, স্বল্প দামের গ্যাসের সঙ্গে এলএনজি মেশালে গড় দাম অনেক হচ্ছে। ফলে তা ট্যারিফে প্রভাব ফেলছে। এখন এটা থেকে বের হতে হলে গ্যাসে বিনিয়োগ দরকার। স্থানীয় গ্যাসের মজুদ যে পরিমাণ দেখানো হচ্ছে, সেটি উত্তোলন করতে যদি তৃতীয় পক্ষকে ব্যবহার করতে হয়, উচিত হবে তা-ই করা। তাহলে গ্যাস খাতের এ সংকট থেকে বের হওয়া যেতে পারে।’