
আমার দেশ-এ ১৫ সেপ্টেম্বর সরদার আনিসের একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। শিরোনাম ছিল—‘থাকছে জাফর ইকবালসহ ফ্যাসিবাদ-দোসরদের বই’। বিস্ময় ও বেদনা নিয়ে আমি প্রতিবেদনটি পড়লাম। বিশ্বাস করা কঠিন যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় আর শীর্ষ কর্মকর্তারা এটা অনুমোদন করেছেন। এই সিদ্ধান্ত কলঙ্কিত কণ্ঠস্বরকে সামনে নিয়ে এলো। আমাদের শহীদদের অবদানকে এখানে খাটো করা হলো।
২০২৪-এর জুলাই অভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনো ছোট ঘটনা ছিল না। এটি ছিল বড় ধরনের ঝাঁকুনি। জাতির ভবিষ্যৎ বদলে দিয়েছে এটি। এর নেতৃত্বে ছিল সাধারণ মানুষ। অগ্রভাগে ছিলেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষক, পেশাজীবী, শ্রমজীবী—সবাই যোগ দিয়েছেন সেখানে। কঠোর শাসনের বিরুদ্ধে তারা লড়েছেন। লড়াই করে তারা মুক্তি ছিনিয়ে এনেছেন। এটা ছিল সাহস দিয়ে ভয়কে জয় করার সময়। আত্মত্যাগের মাধ্যমে এখানে নতুন শুরুর পথ রচিত হয়েছে।
এখন জাতীয় পাঠ্যক্রমের কথা বিবেচনা করুন, যেখানে এই সংগ্রামকে উপেক্ষা বা খাটো করা হয়েছে। দেশটা যেন তার হৃদয়টাকেই কেটে ফেলছে। কিন্তু সেটাই ঘটতে দেখছি আমরা। জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) বড় পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু চুরি আর ফ্যাসিবাদের সঙ্গে যাদের যোগাযোগ, সেই লেখকদেরও রেখে দেওয়া হচ্ছে। জুলাইয়ের শহীদদের নামমাত্র উল্লেখ করা হচ্ছে এখানে।
এটাকে সামান্য ভুল বলা যাবে না। এটা শুধু স্কুলের দেখভালের সমস্যা নয়। এক অধ্যাপক এটাকে ‘কালিতে লেখা বিশ্বাসঘাতকতা’ বলেছেন।
এই নিবন্ধের একটা সুস্পষ্ট লক্ষ্য আছে। এটা খুবই জরুরি। আমাদের অবশ্যই জুলাই অভ্যুত্থানকে পাঠ্যক্রমের কেন্দ্রে জায়গা দিতে হবে। কোনো প্রান্তিক জায়গায় নয়। যে জাতি তাদের শহীদদের ভুলে যায়, তারা অতীতের সঙ্গে বেঈমানি করে। সেই সঙ্গে ভবিষ্যৎও হারায়।
বৈপরীত্যের পাঠ্যক্রম
পাঠ্যপুস্তকে কথা আর কাজের পার্থক্যটা খুবই প্রকট। কর্মকর্তারা ‘ঐতিহাসিক পুনর্গঠনের’ কথা বলছেন। তারা বলছেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চেতনাকে তারা ধারণ করেন। কিন্তু বইয়ে সেসব ব্যক্তির চিহ্ন এখনো রয়ে গেছে, যারা স্বৈরশাসনকে সমর্থন দিয়েছিল। এই বৈপরীত্যটা ভয়ংকর। আমাদের স্মৃতিতে এখনো শহীদদের রক্তের ছবি ভাসছে। কিন্তু এখনই তাদের আত্মত্যাগকে পাদটীকায় পরিণত করা হচ্ছে। ফ্যাসিবাদের সহযোগীরা প্রথম পাতায় রয়ে যাচ্ছে।
আমান সুলায়মান বলেছেন, ‘প্রথম পাতায় জাফর ইকবালের নাম রেখে জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে পাদটীকায় জায়গা দেওয়ার অর্থ হলো শহীদদের সঙ্গে তামাশা করা।’ তিনি জাতীয় পাঠ্যক্রম সমন্বয় কমিটির (এনসিসিসি) একজন সদস্য।
এটা শুধু নামের বিষয় নয়। এটা বয়ানের বিষয়। জাফর ইকবালসহ অন্যদের বিরুদ্ধে চুরি, সুবিধাবাদী এবং শেখ হাসিনার শাসনের সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগ রয়েছে। তাদের এখনো শিশুদের সামনে বিশেষজ্ঞ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। এই লোকগুলো চুপ করেছিল অথবা স্বৈরশাসনকে সমর্থন জুগিয়েছে। সাংবাদিকতাকে তারা সেন্সর করেছে। ভিন্নমতকে অপরাধে পরিণত করেছে। যে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাদের পতন হয়েছে, সেই অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে তারা লড়েছে।
ইতিহাসে দেখা যাবে শাসকরা পাঠ্যক্রমে পরিবর্তন আনে। তারা মিত্রদের প্রশংসা করে আর সমালোচকদের নিস্তব্ধ করে দেয়। নাৎসি জার্মানিতে বইপুস্তকে ফ্যাসিবাদের প্রশংসা করা হতো। তারা বিরোধীদের মুছে দিয়েছিল। স্ট্যালিনের রাশিয়ায় ইতিহাসের অধ্যায়গুলো নতুন করে লেখা হয়েছিল। নির্যাতিত নেতাদের আখ্যান তারা বাদ দিয়েছিল। সাম্প্রতিককালে তুরস্ক, চীন এবং হাঙ্গেরিও অভ্যুত্থান ও ক্ষমতার বিরুদ্ধে বিক্ষোভের ঘটনাগুলো চেপে যাওয়া হচ্ছে।
একই ঝুঁকিতে পড়েছে বাংলাদেশ। দোসরদের সম্মানিত করে এবং জুলাইকে খাটো করে রাষ্ট্র অন্যায় করছে। ইতিহাস পুনর্লিখনে তারা সাহায্য করছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন বা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে বইয়ে গুরুত্বের সঙ্গে জায়গা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জুলাই আন্দোলনের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে। মনে হচ্ছে এটা যেন একটা সমস্যা। গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের অংশ নয়। এটা কোনো ভুল নয়। পুরোনোদের এখানে সুরক্ষা দেওয়া হচ্ছে। দগদগে স্মৃতিকে নীরবে দমন করা হচ্ছে।
দেশ-বিদেশে অভ্যুত্থানের স্মরণ
বাংলাদেশের পরিচয় এসেছে প্রতিরোধের মাধ্যমে। দেশের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ সব গণঅভ্যুত্থান ঘটেছে। স্কুলগুলোকে কীভাবে সেটা শেখানো হচ্ছে, সেটাই ঠিক করবে শিশুরা মুক্তিকে কীভাবে দেখবে। ইতিহাস মুছে দেওয়ার ঝুঁকি অন্য দেশগুলোর ইতিহাস থেকেও বোঝা যায়। এ ধরনের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যারা গেছে, তারা এই মুহূর্তগুলো জাতির পুনর্জন্মের মুহূর্ত হিসেবে পাঠ্যক্রমে জায়গা দিয়েছে।
* দক্ষিণ কোরিয়ায় ১৯৮০ সালের গোয়াংজু অভ্যুত্থানকে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। এখন সেটাকে গণতন্ত্রের বাঁকবদলের মুহূর্ত হিসেবে শেখানো হচ্ছে। এটাকে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে নাগরিকদের উত্থান হিসেবে পড়া হচ্ছে।
* ২০১১ সালে তিউনিসিয়ায় জেসমিন বিপ্লবের মাধ্যমে আরব বসন্ত শুরু হয়েছিল। সেখানে বইয়ে পড়ানো হয় কীভাবে তরুণদের সাহসিকতা স্বৈরশাসকের পতন ঘটিয়েছিল। সেই সূত্রেই পরিবর্তন এসেছে।
* পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি এবং চেক প্রজাতন্ত্রের মতো পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোয় ১৯৮৯ সালের পর পাঠ্যক্রম বদলে গেছে। শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াইকে তারা সম্মান করে। শিশুদের তারা শেখায় মুক্তি অর্জন করতে হয়, সেটি এমনিতে আসে না।
বাংলাদেশের ধীর গতি চোখে পড়ছে। অন্যরা অভ্যুত্থানকে জাতীয় অহংকারের স্বীকৃতি দিয়েছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ নিজেদের অর্জনকে সংকুচিত করে আনার ঝুঁকি নিয়েছে।
বাংলাদেশের শ্রেণিকক্ষগুলোয় যদি জুলাইকে ভুলিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে শহীদদের সঙ্গে অসম্মান করা হবে। যে লড়াই গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে এনেছে, সেটি তাহলে মুছে যাবে।
কালি রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করতে পারে না
সরকার বলছে, পরিবর্তন আসছে। বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক স্টাডিজের বইগুলোয় জুলাই নিয়ে নতুন অধ্যায় যুক্ত হবে। কিন্তু এই কথাগুলো অন্তঃসারশূন্য মনে হচ্ছে। সামান্য সংযোজন দিয়ে চলমান বোঝাপড়াকে লুকানো যাবে না। মুক্তির জন্য আত্মত্যাগের প্রতি যে সত্যিকারের সম্মান, কয়েকটা সামান্য প্যারাগ্রাফ যোগ করে সেটা অর্জন করা যাবে না।
জুলাই কোনো ছোটখাটো বিষয় ছিল না। এটা ছিল সত্য, মর্যাদা ও সত্যিকারের স্মৃতিজড়িত বিষয়। ১৯৫২ সালে ভাষার জন্য শহীদ হওয়ার মতো বিষয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মতো বিষয়। ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মতো বিষয়। এই ধারাবাহিকতাতেই ২০২৪ এসেছে। একে পাশে সরিয়ে রাখার অর্থ হলো এর অসম্মান করা।
জুলাইয়ের শিক্ষা কোনোভাবেই পাদটীকা হতে পারে না। ইতিহাস দেখিয়েছে, অভ্যুত্থানকে মাটিচাপা দিলে বিবেকও মাটিচাপা পড়ে যায়। এখানে সেটা করাটা অকল্পনীয়। ক্ষমার অযোগ্য। কালি দিয়ে হয়তো বোঝাপড়ার চেষ্টা হতে পারে। কিন্তু সেটা কখনো রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করতে পারে না।
১. পাঠ্যক্রমের কেন্দ্রে জুলাই অভ্যুত্থানকে জায়গা দিতে হবে
৩৬ জুলাই নামে পরিচিত ২০২৪-এর জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে অবশ্যই পাদটীকা থেকে তুলে আনতে হবে। ১৯৫২, ১৯৭১, ১৯৯০-এর মতো একই মর্যাদা দিতে হবে। এই আন্দোলনের শুরু, এর সঙ্গে মানুষের অংশগ্রহণ, আত্মত্যাগ ও আন্দোলনের ফল নিয়ে পূর্ণাঙ্গ অধ্যায় যোগ করতে হবে। সেটা করলেই শুধু শিশু শিক্ষার্থীরা এটাকে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে দেখবে।
২. চুরি করা এবং আপসের বিষয়বস্তুগুলো বাদ দিতে হবে
যেসব লেখকের বিরুদ্ধে চুরি ও ফ্যাসিবাদের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার অভিযোগ রয়েছে, তাদের নাম এখনো বইয়ে রয়ে গেছে। এতে আস্থার ক্ষতি হচ্ছে। শহীদদের অবজ্ঞা করা হচ্ছে। পাঠ্যক্রম থেকে কপি করা ক্ষতিকর অংশগুলো বাদ দিতে হবে। পুরোনো শাসনের তাঁবেদার লেখকদের সরিয়ে দিতে হবে। স্বাধীন পাঠ্যক্রম সমন্বয় কমিটি গঠন করতে হবে। সত্যিকারের তথ্য যাচাইয়ের জন্য বিশ্বস্ত একাডেমিক ও ইতিহাসবিদদের কাজে লাগাতে হবে।
৩. জাতীয় সংলাপ ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে
পর্দার আড়ালে বদলে গেলে চলবে না। এই প্রক্রিয়ায় জাতীয় পাঠ্যক্রম সমন্বয় কমিটি, শিক্ষকদের গ্রুপ, ছাত্র সংগঠন, নাগরিক সমাজ, শহীদ পরিবার—সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। প্রক্রিয়া উন্মুক্ত হলে এতে আস্থা জন্মাবে।
৪. শিক্ষায় ‘স্মৃতি রক্ষার’ জন্য জাতীয় নীতি ঘোষণা
ভবিষ্যতে তথ্যবিকৃতি এড়াতে নীতি গ্রহণ করতে হবে। জুলাইয়ের মতো গণঅভ্যুত্থানকে পাঠ্যক্রমের কেন্দ্রে রাখতে হবে। এটাকে কাটছাঁট বা সংকুচিত করা যাবে না। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ শহীদদের মনে রাখবে, শুধু পাথরকে নয়।
পাঠ্যবই নিয়ে লড়াইটা হলো ক্ষমতা আর সত্যের লড়াই। জুলাইয়ে সরিয়ে রেখে ফ্যাসিবাদের দোসরদের রেখে দেওয়ার মাধ্যমে একটা বার্তা দেওয়া হয়েছে। সেটা হলো স্মৃতিকে বেঁচে দেওয়া যেতে পারে। আত্মত্যাগকে মুছে দেওয়া যেতে পারে। শাসকদের জন্য ইতিহাসকে বিকৃত করা যেতে পারে। শহীদরা নীরবতার জন্য প্রাণ দেননি। তারা প্রাণ দিয়েছেন সত্যকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য।
লেখক : যুক্তরাষ্ট্রের সাভানা স্টেট ইউনিভার্সিটির ব্যবসা, সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগের অধ্যাপক।
Source: https://www.dailyamardesh.com/op-ed/amdk0djn5bu1g