গাজায় স্থল অভিযানের প্রস্তুতি : লেবানন সীমান্তে তীব্রযুদ্ধ

 

বাংলাদেশ ক্রনিক্যাল ডেস্ক : 

অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় সর্বাত্মক বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। যে কোনো মুহুর্তে শুরু হতে পারে স্থল অভিযান। গাজা সীমান্তে প্রায় ১ লাখ সেনা সমাবেশ করেছে ইসরাইল। অপরদিকে লেবানন সীমান্তে হিজবুল্লাহর সাথে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। হিজবুল্লাহর হামলায় ইসরাইল আর্মির একজন ডেপুটি কমান্ডার নিহত হয়েছে। ৭ অক্টোবরের পর এ পর্যন্ত ৮৬ জন ইসরাইলি সেনা নিহত হলো। হামাস জানিয়েছে গাজায় সাধারন মানুষের ওপর হামলা বন্ধ না হলে আটক বন্দিদের তারা হত্যা করবে। হামাসের কর্মকর্তারা আভাস দিয়েছেন ইসরাইলি বাহিনী গাজায় প্রবেশ করলে তারা পুরোপুরি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। এর আগে গাজায় স্থল অভিযানে ইসরাইলের বিপুল ক্ষয়ক্ষতির মুখে সৈন্য সরে নিতে বাধ্য হয়। তবে স্থল অভিযানে বিপুল সংখ্যক সাধারন মানুষের প্রানহানির আশংকা করা হচ্ছে।

তেল আবিরসহ ইসরাইলের বিভিন্ন শহর লক্ষ্য করে গাজা থেকে রকেট হামলা অব্যাহত রয়েছে। এসব হামলায় কয়েকজন আহত হয়েছে বলে জানিয়েছেন ইসরাইলি স্বাস্থ্য কর্মকর্মকর্তারা। জেরুসালেমেও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যাচ্ছে বলে টাইমস অব ইসরাইলের কবরে বলা হয়।

লেবানন সীমান্তে হিজবুল্লাহ গেরিলাদের সাথে যুদ্ধে ইসরাইলি সেনাবাহিনীর ৩০০ তম ব্রিগেডের ডেপুটি কমান্ডার আলিম আব্দুল্লাহ নিহত ও ৫ সেনা সদস্য আহত হয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স এ দেয়া এক পোষ্টে এ তথ্য জানিয়েছে ইসরাইলি সেনাবাহিনী। অন্যদিকে লড়াইয়ে হিজবুল্লাহর ৪ সদস্য নিহত হয়েছেন বলে স্বীকার করেছে লেবাননেন এই সামরিক গোষ্ঠিটি। ।

২.
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের নিকটবর্তী এলাকায় তার বিমানবাহী রণতরী পাঠানোর পর হিজবুল্লাহ হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছে, ইসরাইল-হামাস সংঘাতে হস্তক্ষেপ করলে মধ্যপাচ্যে মার্কিন অবস্থানগুলোতে হামলা চালানো হবে। এক বিবৃতিতে হিজবুল্লাহর মুখপাত্র বলেছেন, ফিলিস্তিন ইউক্রেন নয়। যুক্তরাষ্ট্র যদি ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে, তাহলে এ অঞ্চলের সব মার্কিন অবস্থান প্রতিরোধ বাহিনীর লক্ষ্যে পরিণত হবে এবং আমাদের আক্রমণের মুখোমুখি হবে। সেদিন কোনো রেড লাইন থাকবে না। অন্যদিকে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এক বিবৃতিতে হিজবুল্লাহকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, হামাস-ইসরাইল সংঘাতে জড়িত হলে লেবাননের এই সংগঠনটিকে পরিণতি ভোগ করতে হবে।

ইসরাইলি সামরিক বাহিনী ঘোষণা করেছে, তারা বন্দী হওয়া ইসরাইলি নাগরিকদের জীবনের বিনিময়ে হলেও গাজায় হামলা চালিয়ে যাবে। ইসরাইলি মিডিয়ার খবরে বলা হয়েছে, যুদ্ধবিমানগুলো গাজায় এ পর্যন্ত ১ হাজার লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করেছে। বিমান হামলায় গাজায় উচু আবাসিক ভবন, মসজিদ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল এবং টেলিযোগাযোগ কোম্পানির অফিসসহ প্রায় সব কিছুই ধ্বংস হয়েছে। ধ্বংসস্তুপ থেকে ধোঁয়া উঠছে। ইসরাইলি ড্রোনগুলি গাজার আকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ৬৮০ জন নিহত হয়েছে। এরমধ্যে ১৪০ জন শিশু রয়েছে।

গাজা উপত্যকায় স্থল অভিযানের প্রস্তুতি হিসেবে ইসরাইল সরকার ৪৮ ঘন্টার মধ্যে তিন লাখ রিজার্ভ সেনা সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে। ইসরাইলের ইতিহাসে সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে এটিই হচ্ছে বৃহত্তম সেনা সমাবেশ। গাজায় স্থল অভিযান চালানোর জন্য প্রাথমিক ভাবে এক লাখ সেনা পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। টাইমস অব ইসরাইলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গতকাল নেতানিয়াহ বলেছেন, হামাসের বিরুদ্ধে এবারের যুদ্ধ ইসরাইলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার যুদ্ধ। যেকোন মূল্যে এই যুদ্ধে জিততে হবে।

ইসরাইলের হামলায় গত দুই দিনে গাজা উপত্যকায় লক্ষাধিক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। সংস্থার এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বিমান হামলায় বাস্তুচ্যুত হয়েছেন অন্তত দেড় লাখ ফিলিস্তিনি। এর মধ্যে প্রায় ৭৪ হাজার ফিলিস্তিনি গাজার জাতিসংঘ পরিচালিত স্কুলগুলোতে আশ্রয় নিয়েছেন বলে বিবৃতিতে জানানো হয়।

৩.
অধিকৃত পশ্চিমতীরেও ফিলিস্তিনিদের চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছে ইসরাইলি সেনাবাহিনী। সেখানে প্রায় ২৮ লাখ ফিলিস্তিনি বসবাস করেন। পশ্চিমতীরের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, লোহার গেট, সিমেন্টের ব্লক এবং মাটির ঢিবি দিয়ে বিভিন্ন শহরের প্রবেশ পথগুলো বন্ধ করে দিয়েছে সেনারা। ইসরাইলি দখলদারিত্ব ও গাজা উপত্যকায় সামরিক আগ্রাসনের প্রতিবাদে গত ৭ অক্টোবর পশ্চিমতীরে সর্বাত্মক ধর্মঘট ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করার পর এই পদক্ষেপ গ্রহন করে ইসরাইল।

ইসরাইলের দক্ষিণাঞ্চলে হামাসের ৭ অক্টোবরের হামলায় নিহতদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিকরাও রয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলে তাদের ১১ নাগরিক নিহত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। এক বিবৃতিতে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ‘আমরা নিহতদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই এবং আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করি। অন্যদিকে, যুক্তরাজ্যের একটি সরকারি সূত্র থেকে বিবিসি জানতে পেরেছে যে, ইসরাইলে হামাসের হামলার পর ১০ জনেরও বেশি ব্রিটিশ নাগরিক নিহত বা নিখোঁজ হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এছাড়া হামাসের হামলায় নেপালের অন্তত ১০ শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন। সিএনএনকে নিশ্চিত করেছেন ইসরাইলে নিযুক্ত নেপালি রাষ্ট্রদূত কান্ত রিজাল। অরো এক শিক্ষার্থী নিখোজ রয়েছেন বলে তিনি জানিয়েছেন। অন্যদিকে, থাইল্যান্ড সরকার জানিয়েছে, হামাসের হামলায় তাদের ১২ নাগরিক নিহত ও ৮ জন আহত হয়েছেন। এছাড়া হামাস সদস্যরা ১১ জনকে ধরে নিয়ে গেছে বলে জানিয়েছে থাইল্যন্ডের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়। ফ্রান্সের ২ জন নিহত ১১ জন নিখোজ রয়েছে।

৪.
ইসরাইলে হামাসের হামলার পর ফিলিস্তিনে আর্থিক সহযোগিতা প্রদান স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন । জার্মানী এবং অষ্ট্রিয়াও একই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এদিকে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান গাজা উপত্যকা ও ইসরাইলে সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। জেরুসালেমকে রাজধানী করে স্বাধীন ও ভৌগোলিকভাবে একীভূত ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন তিনি। গত রোববার তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় এফ্রেম সিরিয়াক প্রাচীন অর্থোডক্স চার্চ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এ আহ্বান জানান।

দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে যুদ্ধ নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন তুরস্ক। এ অঞ্চলে শান্তি পুনঃ:প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সহিংসতা যাতে না বাড়ে তা নিশ্চিত করতে অবদান রাখতে প্রস্তুত তুরস্ক। উভয়পক্ষকে শক্তির ব্যবহার বন্ধ এবং দেরি না করে শান্তির স্থায়ী সমাধানে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছে দেশটি। চলমান উত্তেজনা প্রশমনে ইসরাইলের প্রেসিডেন্ট হারজগের সঙ্গেও কথা টেলিফোনে কথা বলেছেন এরদোয়ান। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ও মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সঙ্গে চলমান উত্তেজনা নিয়ে আলোচনা করেছেন।

ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে চলমান যুদ্ধে সিরিয়া হামাসের সাথে যোগ দিলে তার পরিনতি সিরিয়ার জন্য ভালো হবে না বলে দেশটিকে সতর্ক করেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। এছাড়া আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ মিসরের প্রেসিডে›ট্ট আবদেল ফাতাহ আল সিসির সঙ্গে টেলিফোনে আলাপকালে হামাস-ইসরাইল যুদ্ধ বন্ধে দ্রুত কুটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহনের প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন বলে আলজাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়।

আল জাজিরার অন্য এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্কিন সশস্ত্র বাহিনীর জয়েন্ট চীফস অব ষ্টাফের চেয়ারম্যান জেনারেল চার্লস কিউ ব্রাউন ইরানকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, পারস্য উপসাগরীয় দেশটি যেন হামাসের পক্ষে যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়ে। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র চায় না হামাস-ইসরাইলের যুদ্ধ বিস্তৃত পরিসরে ছড়িয়ে পড়–ক।

৫.
কাতারের মধ্যস্থতায় ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে বন্দি বিনিময়ের আলোচনা শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছে চীনের সরকারি বার্তাসংস্থা সিনহুয়া। হামাসের একটি সূত্রের বরাত দিয়ে এ খবর জানায় চীনা সংবাদমাধ্যমটি। সিনহুয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিয়ে কাতার হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে বন্দি বিনিময়ে মধ্যস্থতা করা এই উদ্যোগ গ্রহন করেছে। তবে, ইসরাইলের একজন সরকারি কর্মকর্তা এধরণের খবরের অস্বীকার করে বলেছেন, বন্দি বিনিময়ের কোন আলোচনা হচ্ছে না। হামাসের পক্ষ থেকেও একই ধরণের কথা বলা হয়েছে। সংগঠনটি জানিয়েছে, ইসরাইলের সাথে যুদ্ধ চলছে, এখন বন্দি বিনিময়ের আলোচনায় বসার সময় নয়।

যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশে^র নেতাদের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের বেলায় এক নীতি, আবার ফিলিস্তিনিদের বেলায় অন্য নীতি অনুসরণ করার অভিযোগ উঠেছে। সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষক এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারিদের দিক থেকে তোলা হয়েছে এই গুরুতর অভিযোগ। ইসরাইলে হামাসের বিষ্ময়কর হামলার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকসহ পশ্চিমা বিশে^র নেতারা হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে অভিহিত তারা ইসরাইলের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এমনকি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিও হামাসের হামলার কঠোর নিন্দা করে ইসরাইলে নিহতদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। তিনি বলেন, ইসরাইলের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রশ্নাতীত।

রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমন করার পর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের নেতারা রুশ আগ্রাসনের নিন্দা করে ইউক্রেনের প্রতিরোধ যুদ্ধকে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার লড়াই আখ্যা দিয়ে দেশটির পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দেন। একইসাথে তারা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা দিচ্ছেন ইউক্রেনকে। অথচ গাজা উপত্যকা ও অধিকৃত পশ্চিমতীরে ইসরাইলের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ সংগ্রামকে পশ্চিমা নেতারা সন্ত্রাসী তৎপরতা হিসেবে অভিহিত করে এর নিন্দা জানাচ্ছেন। এটি সুস্পষ্টভাবেই পশ্চিমা নেতাদের দ্বৈত নীতি বলে মনে করেন ব্রিটিশ সাংবাদিক অ্যারোন বাস্তানি।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ‘এক্স’ দেয়া এক পোষ্টে তিনি এই মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, একই ধরণের ঘটনায় ইউক্রেনের প্রশংসা ও ফিলিস্তিনিদের নিন্দা করা হচ্ছে। পশ্চিমারা রাশিয়ার দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের যুদ্ধকে প্রশংসায় ভাসিয়ে দিচ্ছেন, অন্যদিকে ইসরাইলের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের লড়াইকে সন্ত্রাসী তৎপরতা আখ্যা দিচ্ছেন। এটি অবশ্যই পশ্চিমা নেতাদের ডাবল ষ্ট্যান্ডার্ড বা দ্বৈত নীতি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারি অনেকেই পশ্চিমাদের এই দ্বিমুখি নীতিকে ভন্ডামী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।