- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৮:৫১, আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৮:৫২
বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার রাজনীতি করা না করা নিয়ে সম্প্রতি যে বিতর্ক শুরু হয়েছে তা সরকার সচেতনভাবেই করছে বলে মনে করেন দলটির অনেক নেতা। তারা বলছেন, এর পেছনে আন্তর্জাতিক চাপসহ নানা কারণ থাকতে পারে।
অবশ্য সরকার বলছে যে খালেদা জিয়ার রাজনীতি নিয়ে যে বিতর্ক তার পেছনে সরকারের কোনো দুরভিসন্ধি নেই।
আর রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের যে দাবি রয়েছে তা থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্য দিকে সরাতেই এমন বিতর্ক শুরু করতে পারে আওয়ামী লীগ।
সম্প্রতি বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার রাজনীতি করা না করা নিয়ে সরকারের অন্তত চার জন মন্ত্রী নানা ধরণের মন্তব্য করেছেন যা নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক।
স্থানীয় বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী, আইনমন্ত্রী ছাড়াও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন যে খালেদা জিয়ার রাজনীতি করার কোন সুযোগ নেই। একই মন্তব্য করেছেন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদও।
তবে কিছুটা ভিন্ন মন্তব্য করেছেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেছেন, রাজনীতি করতে কোন বাধা নেই মিসেস জিয়ার। আর আইনমন্ত্রী বলেছেন, রাজনীতি করতে কোনো বাধা না থাকলেও নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না বিএনপির সভানেত্রী।
সরকারের একাধিক মন্ত্রীর এমন মন্তব্যের কারণেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যে বিএনপি প্রধানের ব্যাপারে এই সময়ে এসে কেন মন্ত্রীরা এ ধরণের মন্তব্য করছেন।
বিএনপির জন্য ‘ট্র্যাপ’
বিএনপি নেতা রুমিন ফারহানা বলছেন, সরকারের ওপর উপর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাপ রয়েছে, যার কারণে আওয়ামী লীগ খালেদা জিয়াকে নিয়ে এ ধরণের মন্তব্য করছে।
তার মতে, প্রথমত আন্তর্জাতিক মহল বারবারই বিএনপিকে নির্বিঘ্নে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে নেয়ার পরিবেশ তৈরি করে দেয়ার জন্য সরকারকে বলছে। একই সাথে প্রধান বিরোধীদলের নেতাকে এভাবে রাজনীতি থেকে সরিয়ে রাখা এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তাকে একটার পর একটা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত দেখানোটাও সরকারের ওপর একটা চাপ সৃষ্টি করছে।
তিনি বলেন, ‘সেখান থেকেই একটা স্টেটমেন্ট আইনমন্ত্রী হয়তো দিয়েছেন।’
ফারহানা মনে করেন যে দ্বিতীয়ত, খালেদা জিয়ার রাজনীতি নিয়ে সরকারের মন্ত্রীদের যে দু’রকমের বক্তব্য সেটা আসলে বিএনপির জন্য একটা ‘ট্র্যাপ’ বা ফাঁদ।
তিনি বলেন, খালেদা জিয়া এখন রাজনীতিতে সক্রিয় হলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হবে যে তিনি সুস্থ আছেন। তাই তার আসলে বাসায় থাকার দরকার নেই। তাকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হোক।
তিনি বলেন, ‘এই সরকার অত্যন্ত প্রতিশোধপরায়ন ও ধূর্ত ও মিথ্যাবাদী। তাই এই সরকার কী উদ্দেশ্যে কী করে সেটা বলা মুশকিল।’
এদিকে, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ বলেছেন, সরকারের এই মন্তব্যকে তেমন গুরুত্বসহকারে দেখছে না বিএনপি।
বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার রাজনীতি করা না করা নিয়ে সরকারের যে মন্ত্রীরা কথা বলেছেন তাদের মধ্যে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও ছিলেন।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, খালেদা জিয়ার রাজনীতির বিষয়ে যে মন্তব্য করা হয়েছে তার পেছনে সরকারের কোনো দুরভিসন্ধি নেই। বরং এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়েই মিসেস জিয়ার রাজনীতি করা নিয়ে মন্তব্য করেছেন তিনি।
গত ২৬ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম সংসদে তার এক বক্তব্যে বলেছিলেন যে বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া রাজনীতি করতে পারবেন না, এমন মুচলেকা দেয়া হয়েছে। তার ভিত্তিতে তাকে বাসায় নেয়া হয়েছে।
সংসদে সেলিমের এমন বক্তব্যের পরই বিষয়টি নিয়ে একাধিক মন্ত্রী মন্তব্য করেন এবং বিতর্ক শুরু হয়। আর এর জেরেই আইনমন্ত্রীকে প্রশ্ন করেন সাংবাদিকরা।
উল্লেখ্য, দুর্নীতির দু’টি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত বিএনপি নেত্রীকে করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে সরকারের নির্বাহী আদেশে সাজা ছয় মাসের জন্য স্থগিত করে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ মুক্তি দেয়া হয়। এরপর থেকে দফায় দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে বাসায় অবস্থান করছেন তিনি। অসুস্থ থাকার কারণে সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি দেয়া হয়েছে তাকে।
তিনি বলেন, সাংবাদিকরা তার কাছে জানতে চেয়েছিলেন যে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেয়ার সময় এমন কোন শর্ত ছিলো কিনা যে তিনি রাজনীতি করতে পারবেন না। উত্তরে আইনমন্ত্রী বলেছেন, এমন কোনো শর্ত ছিল না।
বরং খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেয়ার সময় দুটি শর্ত ছিলো। সেগুলো হচ্ছে, তিনি বাসায় থেকে চিকিৎসা নিবেন এবং তিনি দেশের বাইরে যেতে পারবেন না।
তিনি বলেন, ‘যখন এরকম প্রশ্ন (খালেদা জিয়ার রাজনীতি নিয়ে) হয় তখন সত্যটাই বলা হয়। এই সত্যটাই বলা হয়েছে। এর মধ্যে কোনো দুরভিসন্ধি আওয়ামী লীগ সরকারের নাই।’
এদিকে খালেদা জিয়ার রাজনীতি করা নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতারা যে দু’ধরণের মন্তব্য করেছেন সে বিষয়ে আইনমন্ত্রী তার ব্যাখ্যায় বলেন, খালেদা জিয়া রাজনীতি করতে পারবেন না- এ কথাটির সূত্রপাত হয়েছে যে কারণে তা হলো, তিনি অসুস্থ ছিলেন বলেই মানবিক কারণে তার দণ্ড স্থগিত করে তাকে কারাগার থেকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল চিকিৎসার জন্য।
ফলে ‘খালেদা জিয়া যদি অসুস্থ থাকেন তাহলে তিনি রাজনীতি করবেন কীভাবে?’
আর যদি সুস্থ থাকেন তাহলে তার স্থগিত দণ্ডাদেশ আবার চালু করা হবে এবং তাকে কারাগারে গিয়ে তার মেয়াদ পূর্ণ করতে হবে। সে কারণেই বলা হচ্ছে যে, তার রাজনীতি করার সুযোগ নেই।
এখন কেন বিতর্ক?
খালেদা জিয়া কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বাসায় থাকার মেয়াদ প্রায় তিন বছর হতে চলল। এত দিন কোনো মন্তব্য না এলেও নির্বাচন ঘনিয়ে আসার কারণে এখন তার রাজনীতি নিয়ে বক্তব্য আসছে বলে মনে করছে বিএনপি।
বিএনপি নেতা রুমিন ফারহানা বলেন, সামনে নির্বাচন ঘিরে আন্তর্জাতিক মহলে তৎপরতা রয়েছে। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য আন্তর্জাতিক চাপ রয়েছে। বিএনপির প্রধান দাবি হচ্ছে, খালেদা জিয়াকে কারান্তরিন রেখে এবং দলীয় সরকারের অধীনে বিএনপি নির্বাচনে যাবে না।
তিনি বলেন, ‘সুতরাং এই চাপকে কিছুটা ভ্যালিড করার জন্যও এই ইস্যুটাকে সামনে আনা হতে পারে।’
তবে এমন প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘আমরা তো এটা তুলি নাই। আওয়ামী লীগ এটা তোলে নাই। সাংবাদিকদের প্রশ্নের কারণেই এটি সামনে এসেছে।’
বিএনপির মতো একই মত দিয়েছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. গোবিন্দ চক্রবর্তী বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক মহল একটা চাপ তৈরি করেছেন যাতে সামনে নির্বাচনটা সুষ্ঠুভাবে হয়। এটি একটি কারণ হতে পারে এই সময়ে এমন বিতর্কের জন্য।
সম্প্রতি কয়েক মাসে বিভিন্ন শক্তিশালী রাষ্ট্রের অনেক কূটনীতিক বাংলাদেশে এসেছেন। যার মধ্যে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের একাধিক কর্মকর্তা এবং ভারতের পররাষ্ট্র দফতরের সচিবও রয়েছেন। বিদেশী এই কর্মকর্তারা সরকারের উচ্চ পর্যায়ে বৈঠক করেছেন।
গোবিন্দ চক্রবর্তী বলেন, ‘সেখানে একটা অভ্যন্তরীণ পলিটিক্যাল নেগোসিয়েশনের ব্যাপারও থাকতে পারে যে, সবাইকে নিয়ে নির্বাচনটা করতে হবে, সো হোয়াই ডোন্ট ইউ গিভ সাম ছাড় (কেন কিছু ছাড় দাও না)?’
এধরণের বোঝাপড়ার কারণেও এমন কথাবার্তা আসতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশে গত কয়েক মাসে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতিসহ নানা নাগরিক ভোগান্তির দিক সামনে এনে একটি আন্দোলন দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছে। একই সাথে তারা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতেও অটল রয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই চেষ্টায় বিএনপি কম-বেশি জনসমর্থনও পেয়েছে এবং সেটা অব্যাহত আছে।
এই দিক থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নিতে সরকার খালেদা জিয়ার বিষয়টি সামনে নিয়ে আসছে বলেও মনে করেন অধ্যাপক ড. গোবিন্দ চক্রবর্তী।
তার মতে, এটা হচ্ছে ‘পাবলিক পলিটিক্যাল ডিসকোর্সটাতে (জনগণের রাজনৈতিক আলোচনা) একটা পরিবর্তন আনা যাকে অনেক সময় আমরা বলি, কোনো একটা ইস্যু থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেবার একটা চেষ্টা।’
একই মত দিয়েছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক ড. দিলারা চৌধুরীও। তিনিও মনে করেন, আসলে বিএনপির আন্দোলনের মূল ইস্যু থেকে জনগণের দৃষ্টিটাকে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা চলছে।
বিএনপিও বলছে, আওয়ামী লীগ আসলে দৈনিন্দন নানা সমস্যার দিক থেকে মানুষের মনোযোগ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে চাইছে। আর এ কারণেই খালেদা জিয়ার রাজনীতির ইস্যুটি নিয়ে কথা বলছে তারা।
তবে বিএনপি এ ধরণের মন্তব্যে তেমন একটা পাত্তা দিচ্ছে না বলে জানান দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু। তিনি বলেন, সাধারণ মানুষ সরকারের এমন সব মন্তব্যে পাত্তা দেয় না।
সূত্র : বিবিসি