এমন নির্বাচন দেশের জন্য দুর্ভাগ্যজনক

রোববার অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি সন্তোষজনক হবে বলে আশাবাদী। অন্যদিকে বিএনপি ও তার সহযোগী দলগুলো ভোট বর্জনের আহ্বান জানিয়ে প্রচার চালাচ্ছে। একই সঙ্গে তারা ভোটের দিন দেশব্যাপী হরতাল ডেকেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন সম্পর্কে মতামত দিয়েছেন দু’জন বিশিষ্ট নাগরিক।

রোববারের নির্বাচনটি যেভাবে হতে যাচ্ছে, তা অত্যন্ত দুঃখজনক। সরকার একতরফাভাবে নির্বাচনটি করতে যাচ্ছে এবং বিএনপিসহ অধিকাংশ বড় দল সংগত কারণেই এটি বর্জন করেছে। এ নির্বাচন মানুষের ভোটাধিকার হরণসহ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কফিনে আরেকটি পেরেক ঠুকবে। বস্তুত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্ষমতায় থাকার সুযোগ নেই। এ সুযোগ আছে, যেখানে রাজা-বাদশাহ আছে। তারা বংশপরম্পরায় শত শত বছর শাসন করতে পারে। কিন্তু সভ্যতার অগ্রগতিতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু হয়েছে, যেখানে জনগণের মতামতের প্রতিফলন রয়েছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় চিরদিন ক্ষমতায় থাকার আয়োজন মানেই সেখানে ঘাপলা আছে। কারণ এখানে নির্দিষ্ট সময় পরপর নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন হয়। জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে সরকারকে ক্ষমতায় আসতে হয়।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতার মেয়াদ ফুরালে জনগণ সরকারের মূল্যায়ন করে। ভালো কাজ করলে, মানুষ চাইলে একই সরকারকে একাধিকবার নির্বাচিত করতে পারে। অন্যথায় জনগণের ভোটে সরকার পরিবর্তন হয়। নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে সেনা অভ্যুত্থান কিংবা বল প্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়া– কোনোটাই গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু বর্তমান সরকার সেই বল প্রয়োগ করেই ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করছে। এর মাধ্যমে প্রকারান্তরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই ধ্বংস করছে। অথচ আমরা দীর্ঘ সেনা শাসন এবং নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরে পাই। এ ব্যবস্থার সহায়ক হিসেবে সবার অংশগ্রহণে যাতে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, সে জন্য দেশের সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো নিয়ে কিছু প্রশ্ন থাকলেও
সেগুলো দেশে এবং আন্তর্জাতিকভাবেও গ্রহণযোগ্যতা পায়। কিন্তু সরকার ইচ্ছাকৃত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে। এমনকি পদ্ধতিগতভাবে পঞ্চদশ সংশোধনী যেভাবে হয়েছিল; অর্থাৎ যে সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল হলো, সেটাও আইনগতভাবে সিদ্ধ ছিল না।

বস্তুত বর্তমান সরকার তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করেছিল ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার জন্যই। কারণ তারা দেখেছে, নির্বাচনে সব দল সত্যিকারভাবে অংশগ্রহণ করলে, তাদের ফের ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ নেই। সে জন্য এই ব্যবস্থা বাতিল করেই ক্ষান্ত হয়নি; সরকার মানুষের সভা-সমাবেশের অধিকার কেড়ে নেয়; কথা বলার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে; রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংস ও দলীয়করণের মাধ্যমে টিকে থাকে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়ে সরকার ২০১৪ সালেই নির্বাচনকে নির্বাসনে পাঠায়। আমলাতন্ত্র এখন হয়ে গেছে দলতন্ত্র। বিচার বিভাগও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। সবাইকে ম্যানেজ করে ২০১৮ সালের যে নির্বাচন হয়, সেটাও ছিল সাজানো। দুটি নির্বাচনের কোনোটিতেই মানুষ ভোট দিতে পারেনি। মানুষের ভোটাধিকার হরণের আয়োজন ছিল সেগুলো। এবারও তারই পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। এখন আবার ক্ষমতায় আসার জন্য আওয়ামী লীগ যা করছে, তাতে অতীতের রেকর্ডও ভেঙে গেছে। বিরোধী দলের ওপর লাগাতারভাবে যে নিপীড়ন সরকার চালিয়ে আসছিল, গত বছরের ২৮ অক্টোবর তার আরও নিকৃষ্ট প্রকাশ ঘটেছে। এদিন লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে বিএনপি সমাবেশ করেছে। সেখানে সরকার অন্যায়ভাবে শক্তি প্রয়োগের উপলক্ষ তৈরি করে। তারা সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাস দিয়ে সভা ভণ্ডুল করে। বিএনপি যাতে সভা থেকে সুফল পেতে না পারে, সে জন্য তারা বল প্রয়োগের শক্তি অবলম্বন করে। অথচ উল্টো তারা বলে বেড়াচ্ছে, বিএনপি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। এর পর বিএনপির নেতাকর্মীর ওপর জেল-জুলুম, নির্যাতন চালিয়ে আওয়ামী লীগ একতরফাভাবে নির্বাচন করছে।

যে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী নেই, সেটা কেমন নির্বাচন? আওয়ামী লীগের এই পাতানো নির্বাচনে সহযোগিতা করছে নির্বাচন কমিশন। হাস্যকর এ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে আমরা ও মামুরা। এটা এতই হাস্যকর বিষয় যে, আওয়ামী লীগই ডামি প্রার্থীর কথা বলছে। এইভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। আগে আওয়ামী লীগ বলত, দলের কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ালে শাস্তি দেওয়া হবে। এবার তাকেই উৎসাহ দেওয়া হলো। আওয়ামী লীগ নেতারা নির্বাচনকে বলছেন, একটা খেলা। এটা এমন খেলা, যেখানে তারাই প্রার্থী আবার তারাই প্রতিদ্বন্দ্বী। এই প্রহসনের নির্বাচনকে কীভাবে নির্বাচন বলা যায়? এখানে ভোটারের কাছে বিকল্প কে? যাকেই ভোট দেবেন, সে-ই আওয়ামী লীগ। এই খেলায় তাই নিজেদের মধ্যেই দ্বন্দ্ব-সংঘাত দেখা যাচ্ছে।

এমন নির্বাচন থেকে বাংলাদেশের ক্ষতি ছাড়া কোনো কিছু আশা করা যায় না। এর মাধ্যমে দেশ স্বৈরতন্ত্রের পথে আরেক ধাপ এগিয়ে যাবে। অন্তর্জাতিকভাবেও আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে। আমরা জানি, এ নির্বাচনে অধিকাংশ দেশই পর্যবেক্ষক পাঠাবে না। এ নির্বাচনে কী হবে, সবই নির্ধারিত। এমন নির্বাচনের প্রভাব শুধু দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ওপরেই পড়বে না, বরং দীর্ঘ মেয়াদে আমাদের অর্থনীতির ক্ষতির শঙ্কাও রয়েছে। এমন নির্বাচনের মাধ্যমে যারা নির্বাচিত হবেন, তারা জনগণের প্রতি দায়িত্বশীল হওয়ার বদলে ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করবেন। ইতোমধ্যে আমরা কিছু চিত্র দেখেছি। হলফনামায় যদিও পুরো সত্য উঠে আসে না, তারপরও এমপি-মন্ত্রীরা কীভাবে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন– তা স্পষ্ট। দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। আর দুর্দশা ভোগ করছে মানুষ। মূল্যস্ফীতির কশাঘাতে মানুষ কষ্টে আছে। সেই মানুষেরই অর্থ দিয়ে এমন পাতানো নির্বাচন হচ্ছে, যাতে মানুষ তার কাঙ্ক্ষিত নেতা তো পাবেই না; উপরন্তু আরও সংকটে পড়বে। এমন নির্বাচন দেশের জন্য দুর্ভাগ্যজনক।

ড. আবদুল লতিফ মাসুম: প্রাক্তন অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

samakal