বর্তমান নির্বাচনকে ‘বিশেষ নির্বাচনী তৎপরতা’ বলে মনে করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ও নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। এটা দিয়ে মূল সমস্যার সমাধান হবে না উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, আমি তো নির্বাচন বলি না, বলি যে.. ‘বিশেষ নির্বাচনী তৎপরতা।’ এটা আমি পুতিন সাহেবের কাছ থেকে ধার করেছি। ইউক্রেন আক্রমণ করার পর তিনি বলেছিলেন, ‘স্পেশাল মিলিটারি অপারেশন।’ সেটার থেকে আমি শব্দটা ধার করেছি, বিশেষ নির্বাচনী তৎপরতা। এটা দিয়ে মূল সমস্যার সমাধান হবে না। আমরা মূল সমস্যাটাকে ক্যারি ওভার করবো। এটাকে নিয়ে আবার ২০২৪ সালে জীবনযাপন করবো। এই রকম সমস্যাকে নিয়ে জীবনযাপন করতে গেলে হোচট খায়, থমকে যায়, ভেঙে পড়ে। ১৯৮৮ এর নির্বাচন সবচেয়ে ভালো উদাহরণ, এরশাদ আমলের। ১৯৯৬ সালের বিএনপি’র আমলে নির্বাচন ভালো উদাহরণ। টেকাতে পারেনি।
এটা টেকেনা। জনমানুষ যখন ব্যাপকভাবে না চায়, ইতিহাস বলে এটা নিয়ে আপনি খোড়াতে পারেন; দৌড়াতে পারবেন না, হাঁটতেও পারবেন না।
বুধবার আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম ডিডব্লিউ বাংলার খালেদ মুহিউদ্দিন জানতে চায় এর মুখোমুখি হয়ে এসব মন্তব্য করেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
সাম্প্রতিক সময়ে যে নির্বাচন হয়েছে সেগুলো যথাযথভাবে হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২০১৪ ও ২০১৮ নির্বাচনটা যথাযথ হয়নি। এটা মোটামুটি এখন স্বীকৃত। এবং আপনি লক্ষ্য করে দেখবেন নেত্রী যখন বলেন তিনি ২০০৮ এর কথা বলেন। তিনি নিজেও ২০১৪ বা ১৮ এর কথা খুব বেশি বলেন না। এটার কারণে বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক মোমেন্টাম সেটা অর্থনৈতিক ও সামাজিক শক্তিকে আরও এগিয়ে নেবে সেটার জন্য যথাযথভাবে হচ্ছে না। এটার বড় কারণ হলো- আমাদের একটা রাজনৈতিক সমঝোতার ভিত্তিতে, সকলকে অংশগ্রহণের ভিত্তিতে সংসদকে কেন্দ্রবিন্দু করার কথা ছিল। ওই সমঝোতা যেহেতু ভেঙে গেছে যেটা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে আমরা পঞ্চাদশ সংশোধনী বাদ দিয়ে দিয়েছি। এই সমঝোতাটা ভেঙে যাওয়ার কারণে অংশগ্রহণমূলক, প্রতিনিধিত্বশীল একটা উদার গণতান্ত্রিক পরিবেশের মধ্যে আমাদের রাজনীতি আর নাই। যেহেতু রাজনীতি নাই, সেহেতু শক্তিশালী সরকারও নাই। সরকার দুর্বল হয়ে গেছে। টকশোতে ডয়েচে ভেলের বাংলা বিভাগের প্রধান খালেদ মুহিউদ্দিন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের কাছে প্রশ্ন করে বলেন, সিপিডি একটা গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরেছিল সেখানে ব্যাংকের টাকা পাচারের কথা বলেছিল, যেটা লাখ কোটি টাকার মতো। আরও অনেক অসঙ্গতির কথা তুলে ধরেছিল। সরকারের পক্ষ থেকে এর তীব্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। তথ্যমন্ত্রী নির্দিষ্ট করে বলেছেন অসত্য তথ্য দেয়া হয়েছে, অন্য মন্ত্রীরাও অনেক কথা বলেছেন। দু-একটা বললে, রিপোর্ট তৈরি ও প্রকাশের ক্ষেত্রে অনেক লুকোচুরি, ভুল ও অসত্য তথ্য পরিবেশন করেছে। বলা হয়েছে ৭৫ শতাংশ বিদেশ নির্ভর। আসলে ৩৫ শতাংশ সাহায্য নির্ভর। এই প্রতিক্রিয়ার পর.. নির্বাচনের আগে আগে সরকারকে বিপদে ফেলার জন্য এটা বলছেন কিনা বা করেছেন কিনা?
জবাবে সিপিডি’র এই বিশেষ ফেলো বলেন, প্রথম কথা হলো সিপিডি এই কাজ ৩০ বছর ধরে করছে, এটা প্রথম ঘটনা না। যে প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে এটা আমাদের বছরে তিনবার হয়। চার মাস পর পর আমরা অর্থনীতির চলমান পরিস্থিতির মূল্যায়ন করে থাকি। সেটার অংশ হিসেবে ডিসেম্বর মাসে এটার মূল্যায়ন হয়েছে। ঘটনাক্রমে জানুয়ারিতে নির্বাচনী তৎপরতা চলছে সেটা আমরা জানি।
তিনি আরও বলেন, যেহেতু সরকার বিশেষ নির্বাচনী তৎপরতার ভিতরে আছে, নির্বাচন বলতে আমার একটু অস্বস্তি লাগে; এটার প্রতিক্রিয়া থেকে বোঝা যায় আমরা কতোখানি সঠিক ছিলাম। এটা সিপিডি তার ধারাবাহিকতায় বলেছে। কোনো বিশেষ সরকার দল ধরে বলে নাই। এর আগের সরকারেও যদি আপনি ফিরে যান, আগের সরকার যারা ছিলেন তারা তো আমাকে জেলে পর্যন্ত নিতে চেয়েছে ওয়ারেন্ট ইস্যু করে। প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগের তথ্যের জন্য। সেহেতু এটা কোনো নতুন ব্যাপার না। আর আমাদের সেক্ষেত্রে শুধু কথার ভেতরে থেমে যায় তা না অন্য ধরনের হেনস্তাও হয়ে থাকে। তো এটা নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। আপনার যেমন পেশাগত কিছু সমস্যা থাকে আমাদেরও পেশাগত কিছু সমস্যা আছে।
কখনো কী আর একটা নিরপেক্ষ সরকার এসে একটা নির্বাচনের ব্যবস্থা করবেন এরকম একটা জায়গা কী বের হতে পারে কিনা জানতে চাইলে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, দুঃখটা হলো সবচেয়ে একটা খারাপ নির্বাচনের ভেতর দিয়ে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের ভেতর দিয়ে আমরা একটা রাজনৈতিক সমঝোতা পেয়েছিলাম; কেয়ারটেকার সরকার। আবার বিএনপি সরকারের ২০০৬ সালে বিচারপতিদের বয়স নিয়ে যে কাজটা করা হলো এটার মাধ্যমে একটা বড় গর্হিত কাজ করা হয়েছে। ওনারা করলেন কী.. ইয়াজউদ্দিন সাহেবকে প্রধান তত্ত্বাবধায়ক বানিয়ে। তিনি মারা গেছেন। আমার কাছের মানুষ ছিলেন এক সময়। তৎকালীন আইনমন্ত্রী। তাকে আমি বলেছি, আপনি যদি এই কাজ না করতেন তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাস ভিন্ন হতো। এটা হলো বাংলাদেশে মাদারহুড প্রবলেম। এটার সুযোগ নিয়ে এটাকে পুরোটাই তুলে দিলাম। দেখেন, এখানে কীভাবে উচ্চ বিচার ব্যবস্থাকে অপব্যবহার করলাম। আমার সব জাজমেন্টের ভেতরে সকলে জানে দুইবার আরোপ করার কথা ছিল। ফুল জাজমেন্ট বের হওয়ার আগে পার্লামেন্টে পাস করালাম। এটা দিয়ে যে সামাজিক সমঝোতা ছিল, রাজনৈতিক সমঝোতাটা তা পূর্ণভাবে বিচুর্ণ করে দিলাম। এটা একটা বড় ধরনের রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি করেছে। এটা ব্যতিরেকে আরেকটা নতুন সমঝোতা সৃষ্টি না করা পর্যন্ত এটা নিয়ে আমাদের এভাবে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে হবে। বাংলাদেশের সমস্ত পরিস্থিতিকে একটা অনিশ্চিয়তার মধ্যদিয়ে, একটা ছাড় দিয়ে আমাদের যেতে হবে। এখন নিম্নস্তরের সঙ্গে উচ্চস্তরের মানুষের বৈষম্য হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের সরকারি হিসাবে বলছে, উচ্চতর এক শতাংশের সঙ্গে নিম্নতর এক শতাংশের আয়ের গুণিতক হলো একাশি গুণ। এটা কতোদিন আগেও আমাদের ছিল ৩০ গুণ। এটা শুধু আয়ের কথা বললাম। যদি সম্পদের কথা বলি তাহলে তো হাজার গুণের বেশি হবে। সেই সম্পদ দেশের ভেতরে রাখতে পারিনি। এটিই কী স্বাধীনতার চিন্তা ছিল কিনা। বঙ্গবন্ধুর কথা বলি যখন, তিনি কী তাহলে এরকম একটা অসম জাতির কথা চিন্তা করেছিলেন কিনা। তিনি বলেন, আয় বেড়েছে, ব্যয়ও তো বেড়ে গেল। মূল্যস্ফিতি ১০ শতাংশের উপর চলে গেছে। আগে বলতাম শুধু শহরে এখন না গ্রামেও মূল্যস্ফিতি ১০ শতাংশ। আগে বলতাম শুধু খাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রে। এখন খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের ক্ষেত্রেও হচ্ছে।