সড়ক পরিবহন আইন : বাস্তবায়ন কত দূর?

মো: সাইফুদ্দীন খালেদ | ০৭ মার্চ ২০২০

সড়ক পরিবহন আইন : বাস্তবায়ন কত দূর?

একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না- এ স্লোগান ব্যবহার করা হয় সড়কপথে দুর্ঘটনা বিষয়ে জনগণকে সচেতন করার জন্য। পত্রিকা খুললে যে খবরগুলো সব থেকে বেশি শিহরিত করে তোলে তা হচ্ছে বিভিন্ন মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনার খবর। প্রতিদিন বহু মানুষের মৃত্যু ঘটছে দেশের বিভিন্ন সড়কে।

এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, সড়ক দুর্ঘটনার ফলে বছরে গড়ে বাংলাদেশের জিডিপির শতকরা দেড় ভাগ নষ্ট হয়, যার পরিমাণ পাঁচ হাজার কোটি টাকা। বিগত ১৫ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় দেশে প্রাণ হারিয়েছেন ৫৫ হাজার মানুষ। আর দুর্ঘটনাজনিত মামলা হয়েছে প্রায় ৭৭ হাজার। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় সারা দেশে মারা গেছেন এক হাজার ১৬৩ জন। সড়ক বাড়ছে, গাড়ি বাড়ছে, দক্ষ চালক বাড়ছে না। বিআরটিএ’র তথ্য হলো- দেশে অনুমোদিত গাড়ির সংখ্যা ৩৪ লাখ। লাইসেন্সপ্রাপ্ত চালক আছেন ১৭ লাখ। একটা গাড়ি দিন-রাত একজনে চালালেও আরো ১৭ লাখ চালকের ঘাটতি আছে। প্রতি বছর চালকের চাহিদা রয়েছে ৩০-৩৫ হাজার। এখন পর্যন্ত বছরে নতুন চালক যুক্ত হচ্ছেন মাত্র তিন থেকে পাঁচ হাজার। আমাদের দেশে যোগ্য চালক সৃষ্টির কোনো পরিকল্পিত উদ্যোগ বা প্রতিষ্ঠান নেই। অনুমোদনহীন ও অদক্ষ প্রশিক্ষক দ্বারা পরিচালিত কিছু ট্রেনিং স্কুল আছে, সেখান থেকে স্ব-উদ্যোগে চালক তৈরি হচ্ছে। বেকার তরুণরা টার্মিনালে, স্ট্যান্ডে ঘোরাঘুরি করে; ৫-১০ টাকার বিনিময়ে গাড়ি ধোয়ামোছা করে। কোনো সময় গাড়ির সহকারীর অবর্তমানে ওরা যাত্রী ডাকে এবং গাড়িতে উঠে শখ করে স্টিয়ারিং ধরে। রাস্তায় প্রতিদিন যে অসংখ্য দুর্ঘটনা ঘটে, তার সব কিছুর জন্য শুধু চালকরা দায়ী নয়। কেননা সরকারি প্রতিষ্ঠান বিআরটিএ’র ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়ার প্রক্রিয়ায় যদি ত্রুটি থাকে, যদি তারা অদক্ষ লোককে লাইসেন্স দেয় এবং সেই ড্রাইভার যদি দুর্ঘটনার কারণ হন, তা হলে তার দায় কি বিআরটিএ’রও নয়?

নিরাপদ সড়কের দাবিতে ২০১৮ সালের আগস্টে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছিল। সেই পরিপ্রেক্ষিতে সংসদে ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ পাস করা হয়। নতুন আইনে জরিমানা ও বিভিন্ন অপরাধে শাস্তির মাত্রা বাড়ানো হয়েছে। সড়ক পরিবহন আইনে মোটরযান চলাচলের নির্দেশাবলি দেয়া হয়েছে। ওই আইনের ৪৯ ধারায় প্রথম অংশে বলা হয়েছে- মদ্যপান বা নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করে কোনো চালক মোটরযান চালাতে পারবেন না। মদপান বা নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করে কোনো কন্ডাক্টর বা মোটরযান শ্রমিক মোটরযানে অবস্থান করতে পারবেন না। মোটরযান চালক কোনো অবস্থায় কন্ডাক্টর বা মোটরযান শ্রমিককে মোটরযান চালনার দায়িত্ব দিতে পারবেন না। সড়ক বা মহাসড়কে নির্ধারিত অভিমুখ ছাড়া বিপরীত দিক থেকে মোটরযান চালানো যাবে না। সড়ক বা মহাসড়কে নির্ধারিত স্থান ছাড়া অন্য কোনো স্থানে বা উল্টো পাশে বা ভুল দিকে মোটরযান থামিয়ে যানজট বা অন্য কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যাবে না। মোটরসাইকেলে চালক ছাড়া একজনের অধিক সহযাত্রী বহন করা যাবে না এবং চালক ও সহযাত্রী উভয়কে যথাযথভাবে হেলমেট ব্যবহার করতে হবে। যানবাহন চলন্ত অবস্থায় চালক, কন্ডাক্টর বা অন্য কোনো ব্যক্তি কোনো যাত্রীকে মোটরযানে ওঠাতে বা নামাতে পারবেন না। প্রতিবন্ধী যাত্রীদের জন্য গণপরিবহনে অনুকূল সুযোগ-সুবিধা রাখতে হবে। মোটরযানের বডির সামনে, পেছনে, উভয় পাশে, বডির বাইরে বা ছাদে কোনো প্রকার যাত্রী বা পণ্য বা মালামাল বহন করা যাবে না। সরকার বা কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া কোনো মোটরযানে বিজ্ঞাপন প্রদর্শন বা প্রচার করা যাবে না। কোনো মহাসড়ক, সড়ক, ফুটপাথ, ওভারপাস বা আন্ডারপাসে মোটরযান মেরামতের নামে যন্ত্রাংশ বা মালামাল রেখে বা দোকান বসিয়ে বা অন্য কোনোভাবে দ্রব্যাদি রেখে যানবাহন বা পথচারী চলাচলে বাধা সৃষ্টি করা যাবে না। সড়কের সংলগ্ন ফুটপাথের ওপর দিয়ে কোনো প্রকার মোটরযান চলাচল করতে পারবে না। কোনো ব্যক্তি কোনো মোটরযানের মালিক বা আইনানুগ কোনো কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া সংশ্লিষ্ট মোটরযান চালিয়ে বাইরে নিয়ে যেতে পারবেন না। আইনানুগ কর্তৃপক্ষ বা যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া কোনো ব্যক্তি দাঁড়িয়ে থাকা কোনো মোটরযানে প্রবেশ বা আরোহণ করতে পারবেন না। আরো রয়েছে, মোটরযান চালক যান চালনারত অবস্থায় মোবাইল ফোন বা অনুরূপ সরঞ্জাম ব্যবহার করতে পারবেন না। চালক সিটবেল্ট বাঁধা ছাড়া মোটরযান চালাতে পারবেন না। দূরপাল্লার মোটরযানে নির্ধারিত সংখ্যক যাত্রী বা আরোহীর অতিরিক্ত কোনো যাত্রী-আরোহী বহন করা যাবে না। কোনো চালক, কন্ডাক্টর বা মোটরযান পরিচালনার সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তি পরিবহন যানে যাত্রীসাধারণের সাথে কোনো প্রকার দুর্ব্যবহার বা অসৌজন্যমূলক আচরণ বা হয়রানি করতে পারবেন না। রাত্রি বেলায় বিপরীত দিক থেকে আগত মোটরযান চালনায় বিঘœ সৃষ্টি হয়, এরূপ হাইবিম ব্যবহার করে মোটরযান চালানো যাবে না। এসব নির্দেশ অমান্য করলে শাস্তির বিধান রয়েছে। প্রথম অংশের কোনো বিধান লঙ্ঘন করলে অনধিক তিন মাসের কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে এবং চালকের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত হিসাবে দোষ সূচক ১ পয়েন্ট কর্তন করা হবে। দ্বিতীয় অংশের কোনো বিধান লঙ্ঘন করলে অনধিক এক মাসের কারাদণ্ড বা পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে এবং চালকের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত হিসেবে দোষ সূচক ১ পয়েন্ট কর্তন হবে। এই আইনে বলা আছে, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হত্যার উদ্দেশ্যে বলে প্রমাণিত হলে তা দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ৩০২ ধারার অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে, যার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।

কোনো ব্যক্তির ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকলে বা মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্স ব্যবহার করে গাড়ি চালালে সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হবে। সড়কে দু’টি গাড়ি পাল্লা দিয়ে চালানোর সময় যদি দুর্ঘটনা ঘটে, সে ক্ষেত্রে তিন বছরের কারাদণ্ড অথবা ২৫ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। চলন্ত অবস্থায় চালক মুঠোফোনে কথা বললে এক মাসের কারাদণ্ড বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে। এ আইনে অপরাধের তদন্ত, বিচার, আপিল ইত্যাদি ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধি প্রযোজ্য হবে। ফলে আইনটি কার্যকর হলে বেপরোয়া চালানো এবং অবৈধ লাইসেন্সধারী চালকদের দৌরাত্ম্য কমার কথা। কিন্তু আইন পাস হওয়ার দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হলেও বাস্তবায়ন করা হয়নি। সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়ন না করে সড়কে শৃঙ্খলা এনে দুর্ঘটনা রোধে কমিটি প্রণীত সুপারিশযুক্ত প্রতিবেদনে আশু করণীয় ৫০টি, স্বল্পমেয়াদি ৩২টি এবং দীর্ঘমেয়াদি ২৯টি প্রস্তাব- সর্বমোট ১১১টি প্রস্তাব আনা হয়েছে। এসব সুপারিশ বাস্তবায়িত করতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হতে পারে আর কতটুকু কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে এগুলো, সে ব্যাপারে সন্দেহ রয়ে গেছে। ইতোমধ্যে জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারী সড়ক পরিবহন ধর্মঘটের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার নতুন আইনের ৯টি ধারা পর্যালোচনা করবে বলে জানানো হয়েছে।

সড়ক দুর্ঘটনা এখন অন্যতম জাতীয় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। এ সমস্যা থেকে উত্তরণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া জরুরি। যানবাহনের উচ্চগতি দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ। এ ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। জেব্রাক্রসিং ও ফুট ওভারব্রিজ ছাড়া রাস্তা পারাপার হওয়া অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। পাঠ্যপুস্তকের সিলেবাসেও সড়ক দুর্ঘটনার কারণ ও প্রতিরোধসংক্রান্ত সচেতনতামূলক লেখা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বিআরটিএ’র অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কর্তৃক প্রচলিত পদ্ধতিতে উপযুক্ত ব্যক্তিকে লাইসেন্স প্রদানে প্রতিবন্ধকতা এবং লাইসেন্সের কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করাসংক্রান্ত বিষয়ে কর্তৃপক্ষ সচেতন হওয়া জরুরি।