আ মরি বাংলা ভাষা

  • অধ্যাপক ডা: জেহাদ খান
  •  ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ২০:০৮

‘আমার গ্র্যান্ড ফাদার ফিফটি টুর ল্যাঙ্গুয়েজ মুভমেন্টে বুলেটের সাউন্ড শুনেছিলেন।’ এ হচ্ছে বর্তমান ডিজুস জেনারেশনের ছেলেমেয়েদের বাংলা ভাষা। তাদের বাংলা ভাষা শুনে মনেই হবে না যে, এ জাতিরই কিছু বীর-পুরুষ বাংলা ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছিলেন। এটা হচ্ছে আসলে সাংস্কৃতিক হীনম্মন্যতার বহিঃপ্রকাশ। বাংলা ভাষা পৃথিবীতে সম্ভবত সপ্তম ভাষা, জনসংখ্যা বিবেচনায়। পৃথিবীতে কোনো কোনো ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যায়। কোনো কোনো ভাষার অস্তিত্ব আছে কিন্তু কেউ ওই ভাষায় কথা বলে না। যেমন ল্যাতিন, সংস্কৃত ইত্যাদি। আবার কোনো কোনো ভাষায় মানুষ কথা বলে কিন্তু লিখিত রূপ নেই। কোনো কোনো ভাষা সৃষ্টি করা হয়, যেমন উর্দু। অথচ বাংলা ভাষা উর্দুর চেয়ে অনেক পুরনো। পৃথিবীতে খুব কম জাতি আছে যারা ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছে। শহীদ বরকত, রফিক, জব্বারের রক্তের বিনিময়ে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। এসব কিছু বিবেচনা করলে বাংলা ভাষায় কথা বলার মধ্যে নতুন প্রজন্মের জন্য হীনম্মন্যতাবোধের কোনো কারণ নেই। ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে থাকে। কিন্তু সেখানে হিন্দির চাপে বাংলা ভাষার অবস্থান তত সুবিধাজনক নয়। পশ্চিমবঙ্গের এক বুদ্ধিজীবী দুঃখ করে বলেছেন, বাংলাদেশে মানুষ ভাষাশহীদ হয় আর আমাদের এখানে ভাষাই শহীদ হয়ে যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের একটি ছেলে একবার চেন্নাই শহরে আমার কাছ থেকে আবেগাপ্লুত হয়ে একটি টাকা চেয়ে নিলো যে, আমাদের টাকার ওপর বাংলা ভাষায় লেখা রয়েছে। প্রত্যেক যুগে একটি আন্তর্জাতিক ভাষা (Lingua franca) থাকে। মুসলিমরা যখন জ্ঞান-বিজ্ঞানে, শৌর্য-বীর্যে ছিল পৃথিবীতে সবচেয়ে উন্নত, তখন আরবি ছিল আন্তর্জাতিক ভাষা। মুসলিম স্পেনে শতশত ইউরোপীয় শিক্ষার্থী আরবি ভাষা শিখে অধ্যয়ন করত। ইবনে সিনা ফারসিভাষী হয়েও আরবিতে তিনি ‘কানুন ফিততিব’ লিখেছিলেন যা ইউরোপে প্রায় ৪০০ বছর মেডিক্যাল পাঠ্যবই হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। বর্তমান সময়ে ইংরেজি হচ্ছে তেমনি আন্তর্জাতিক ভাষা। যদিও জাতিসঙ্ঘে ছয়টি ভাষা ব্যবহার করা হয়, তবুও বর্তমানে ইংরেজি ভাষার সর্বজনীন ব্যবহার অনস্বীকার্য। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইংরেজি হচ্ছে একমাত্র আন্তর্জাতিক ভাষা। যেমন এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের ভাষা হচ্ছে ইংরেজি। কম্পিউটারের ভাষাও প্রধানত ইংরেজি। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বাংলা ভাষার প্রতি অযৌক্তিক ভালোবাসা দেখাতে গিয়ে আমরা ইংরেজি ভাষাকে অবহেলা করে চলেছি। এর ফলাফল শিক্ষাঙ্গনে ও কর্মক্ষেত্রে অনুভূত হচ্ছে। যেকোনো বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষার জন্য ইংরেজি ভাষার জ্ঞান অপরিহার্য। এরকম ঘটনা আজকাল শোনা যাচ্ছে যে, ইংরেজি ভাষায় দুর্বল হওয়ার কারণে পিএইচডি কোর্স থেকে আমাদের ছাত্রছাত্রীরা মাঝে মাঝে দেশে ফেরত চলে আসছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইংরেজি ভাষা জানার কারণে ভারত, শ্রীলঙ্কার লোকেরা শ্রমিক কর্মকর্তা হয়। আর আমাদের লোকেরা তাদের অধীনে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। আমাদের দেশেও বিভিন্ন এনজিও, গার্মেন্টস ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা পদে ভারত-শ্রীলঙ্কার লোকদের আগমন শুরু হয়েছে। আমাদের দেশের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ইংরেজিতে কম্যুনিকেশন স্কিল ভারত-পাকিস্তানের সমপর্যায়ের কর্মকর্তাদের তুলনায় কম। এই হচ্ছে আন্তর্জাতিক ভাষাকে অবহেলা করার অনিবার্য পরিণতি। আমাদের শিক্ষাঙ্গনে ইংরেজি ভাষা প্রধানত ব্রিটিশ (ও লেভেল, এ লেভেল) ও বাংলা কারিকুলামে পড়ানো হয়। প্রথম ক্ষেত্রে ইংরেজি শিক্ষার মান ভালো কিন্তু বিদেশে যাওয়ার ব্যাপারেই ওই শিক্ষার্থীদের বেশি আগ্রহ থাকে। তাছাড়া আমাদের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে তারা বেশি সুবিধা করতে পারে না, ভিন্ন কারিকুলাম হওয়ার কারণে। অন্য দিকে বাংলা কারিকুলামে ইংরেজি শিক্ষার মান সন্তোষজনক নয়। অথচ এই শিক্ষার্থীরাই হচ্ছে আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধার। কাজেই এ ক্ষেত্রে ইংরেজি শিক্ষার ওপর আরো জোর দেওয়া উচিত।

মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে যে বাংলা ব্যাকরণ পড়ানো হয় তা অনেক ক্ষেত্রে দুর্বোধ্য ও কঠিন। এমন সব কঠিন শব্দ অহেতুক মুখস্থ করতে হয় যা বাস্তব জীবনে কোনো কাজে আসে না। যেমন অংস, অবচয়, অবধান, অজাগর, অশন, আধি ইত্যাদি। আমার ধারণা, আমার মতো অধিকাংশ পাঠকই এ শব্দগুলোর অর্থ জানেন না। অথচ এ ধরনের অনেক শব্দ আমাদের শিক্ষার্থীদের কষ্ট করে মুখস্থ করতে হচ্ছে যা ব্যবহারিক জীবনে কোনো কাজে আসে না অথবা পরীক্ষার পরেই যা স্মৃতি থেকে হারিয়ে যায়। যারা বাংলা ভাষার ওপর গবেষণা করবে বা উচ্চশিক্ষা লাভ করবে, তাদের জন্য এ ধরনের শব্দ কাজে লাগতে পারে তবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য অবশ্যই নয়। তিন প্রকারের র (র, ড়, ঢ়), তিন প্রকার স (ষ, শ,স), দুই প্রকার ন (ন, ণ)-এত বর্ণমালা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মনে মানসিক চাপ সৃষ্টি করতে বাধ্য। বাংলা ভাষাকে যুগোপযোগী করতে হলে বাংলা একাডেমির এ ব্যাপারে সহজ বর্ণমালা প্রবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া উচিত। ভাষা আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল স্পষ্ট। উর্দু পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হলে জীবনের সর্বক্ষেত্রে উর্দুভাষী জনগোষ্ঠী থেকে এ দেশের জনগণ পিছিয়ে পড়বে। আশ্চর্যজনকভাবে সত্যি যে, ইংরেজি ভাষাকে অবহেলা করার কারণে আমাদের একই পরিণতি ভোগ করতে হচ্ছে। তৎকালীন পাকিস্তানের পাঁচটি প্রদেশের একটিতেও উর্দু ভাষায় কথা বলা হতো না। বরং উর্দু ছিলো ভারতের প্রধানত উত্তর প্রদেশ, বিহার, তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্র প্রদেশের ভাষা। তেমনি হিন্দিও হচ্ছে ওইসব প্রদেশসহ আরো কিছু প্রদেশের প্রধান ভাষা। আমরা উর্দুকে প্রতিরোধ করেছি, কিন্তু হিন্দি আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনে ধীরে ধীরে কোনো বাধা ছাড়াই প্রবেশ করছে। হলুদ ও বিয়ের অনুষ্ঠান, পিকনিক পার্টি, জন্মদিনে বা যানবাহনে হিন্দি গানের ছড়াছড়ি দেখে কবির কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে, ‘মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলাভাষা’ অথবা ‘আমার ভাইয়ের রক্তে … আমি কি ভুলিতে পারি?’ একটি ভাষার উন্নতি ও চর্চা ওই জাতির সার্বিক উন্নতির ওপর নির্ভর করে। কাজেই জাতি হিসেবে আমরা যদি সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারি, তাহলে আমাদের ভাষাও তত সমৃদ্ধ হবে। তেমনি বিপরীত কথাও সত্য। আমরা যদি নতুন প্রজন্মকে ভালো শিক্ষাব্যবস্থা, ইংরেজি ও বিজ্ঞান চর্চা, একটি ভালো সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো উপহার দিতে না পারি, তাহলে তারা জাতীয় গৌরব ও আত্মসম্মানবোধ হারিয়ে বিজাতীয় সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকে পড়তে বাধ্য হবে। এটাই স্বাভাবিক। বলা হয় ‘History is never written in one generation’ অর্থাৎ ইতিহাস লেখা কখনো এক প্রজন্মে শেষ হয় না। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ভাষা আন্দোলনে কার অবদান কতটুকু এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো আরো ভালোভাবে সত্যিকার ভাষাসৈনিকদের শনাক্ত করতে সক্ষম হবে।

লেখক : মেডিসিন ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ