জি এম কাদেরের ব্যাখ্যা আর সহজ কিছু প্রশ্ন

প্রচণ্ড দাবদাহে পুড়ছে দেশ, পুড়ছে মানুষ। যতদূর চোখ যায় ঘন নীল আকাশ, বেশিক্ষণ তাকানো যায় না, পিছলে যায় দৃষ্টি, ক্লান্ত হয়ে আসে চোখ। সচরাচর চৈত্রের কাঠফাটা রোদ কিছুটা তেজ হারায় বৈশাখে। কালবৈশাখী ঝড় খানিকটা হলেও শীতল করে প্রকৃতি। কিন্তু এ বছর কালবৈশাখী দূরে থাক মেঘের সামান্য আনাগোনাও নেই আকাশে। তপ্ত মাটি ফেটে চৌচির। আমের মুকুল পুড়ে ছাই।

কৃষকের ধান কাটার লোকের জোগান নাই। প্রাণীকূলও ধুঁকছে যেন। প্রকৃতির এই রুদ্র মূর্তি হয়তো থাকবে আরও কয়েকদিন। তারপর নিশ্চিতভাবেই ঝড় উঠবে, ঠাণ্ডা হবে প্রকৃতি।

এত গেল প্রকৃতির কথা। রাজনীতির অবস্থা কি? এমন প্রশ্নে অনেকেই বিরক্ত হবেন জানি। অনেকেই বলবেন দেশে রাজনীতি থাকলে তবে না রাজনীতির খবর। শেষ পর্যন্ত যারা আশায় বুক বেঁধেছিলেন তাদের অনেকেই হাল ছেড়েছেন ৭ই জানুয়ারির পর। কেউ কেউ হিসাব কষে বুঝেছেন বিদেশিদের নিয়ে উচ্চাশার অনেকটাই ছিল অতিরঞ্জিত খবরের ফসল। ৭ই জানুয়ারির আগে গুঞ্জন ছিল বাতাসে। নির্বাচন হবে কিনা, হলে কেমন হবে, নতুন কি কৌশল নিবে আওয়ামী লীগ, নির্বাচনে বিদেশি শক্তিগুলোর ভূমিকা কি হবে, নির্বাচনের পরেই বা কী ঘটবে ইত্যাদি নিয়ে সর্বত্র ছিল নানান আলোচনা। ৭ই জানুয়ারির পর রাজনীতির মাঠ এখন অনেকটাই ফাঁকা। গত দেড় দশক ধরে একটি মাত্র দল ক্ষমতায়। সংসদে বিরোধী দলও তাদের পছন্দমাফিক। বিরোধী দলে কতোজন থাকবে, বিরোধী দলের নেতা কে হবেন, তাদের বিরোধিতার চৌহদ্দিই বা কতোটুকু হবে, কি বা কতোটুকু তারা বলতে পারবে, কোথায় তাদের থামতে হবে তার সবটাই ঠিক করছে দীর্ঘ সময় ধরে একাধারে ক্ষমতায় থাকা সরকারি দল। মজার বিষয় হচ্ছে সংসদে সরকারের স্তুতি যতটা না ক্ষমতাসীন দলের মুখে শোনা গেছে তার চেয়ে বেশি শোনা গেছে বিরোধী দলের মুখে। আর শোনা যাবে নাই বা কেন? সরকারি দল যে পদ্ধতিতে সংসদের আসনগুলো দখলে নিয়েছে বিরোধী দলও তার বাইরে ছিল না। সরকারি দলের পক্ষে নির্বিঘ্নে কাটানো সম্ভব হয়েছে সংসদের প্রধান বিরোধী দলের শর্তহীন আনুগত্যের ফলে।

এই কথাগুলোর কোনোটিই নতুন নয়। জাতীয় পার্টি নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রতিবারই এই কথাগুলো নানা ভাবে উঠে আসে। তবে যে বিষয়টি নতুন তা হলো একজন রাজনীতিবিদের স্বীকারোক্তি। সমপ্রতি জাতীয় পার্টির একাংশের নেতা ঝানু রাজনীতিবিদ কাজী ফিরোজ রশীদ বলেছেন জাতীয় পার্টিকে আগে ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দল বলা হলেও এখন ‘ক্রীতদাস’ বলা হয়। জাতীয় পার্টির ভবিষ্যৎ অন্ধকার, মানুষের কোনো আস্থা জাতীয় পার্টির উপর নেই বলেও তিনি স্বীকার করেন। কোনো দল নিজে থেকে না চাইলে তাকে ‘গৃহপালিত’ কিংবা ‘ক্রীতদাস’ করা আদৌ সম্ভব কিনা সে বিষয়ে অবশ্য আলোচনা হতে পারে। যেমন আলোচনা হতে পারে এই ধরনের হাঁকডাক এখন কেন সেটা নিয়ে। দশম বা একাদশ সংসদে যখন জাতীয় পার্টি বসেছিল বিরোধী দলের আসনে তখন কিন্তু এ ধরনের আত্মসমালোচনা শোনা যায়নি জাতীয় পার্টির মুখে। বরং সে সময় জাতীয় পার্টির বেশির ভাগ সদস্যকে দেখা গেছে সরকারের মন যুগিয়ে চলতে।

রাজনীতিতে ভুল স্বীকারের নজির এদেশে প্রায় নেই বললেই চলে। সেই ভুলের মাশুল যতই দল, দেশ কিংবা দেশের মানুষকে দিতে হোক না কেন তাতে কিছু যায় আসে না। বিশেষ করে বড় দলগুলোতে ‘বস ইজ অলওয়েজ রাইট’ নীতি অক্ষরে অক্ষরে পালিত হয়। এতটাই পালিত হয় যে, একসময় নেতারা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে, তাদের দ্বারা ন্যূনতম ভুল কিছু হওয়া অসম্ভব। সেই জায়গা থেকে কাজী ফিরোজ রশীদের এই বক্তব্য কিছুটা ব্যতিক্রম তো বটেই। তবে পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, জাতীয় পার্টির বিভিন্ন ভাগের অনেক নেতাই প্রকাশ্যে মুখ খুলতে শুরু করেছেন, মুখ খুলছেন কর্মীরাও। বিশেষ করে ৭ই জানুয়ারি নির্বাচনকে ঘিরে দলীয় কোন্দল চরমে উঠে। এমন কি সংসদে প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা জি এম কাদের পর্যন্ত স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে, বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েও চাপে পড়েই ভোটে আসতে বাধ্য হয়েছিল জাপা।

নির্বাচন যেমনই হোক, আমরা মানি আর নাই মানি, বাস্তবতা হলো প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা জি এম কাদের। সুতরাং রাজনীতি করতে এবং হাওয়া বুঝতে হলে তার কথাকে গুরুত্ব না দিয়ে উপায় নাই। কোন্দল করে দল ভাঙা কিংবা চাপের মুখে নির্বাচনে অংশ নেয়াই শুধু নয়,৭ই জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে তিনি আরও বলেন “আর তখন আমার মতো অয়েল ইনফর্মড নেতা দেশে কমই ছিল। আমি জেনে গিয়েছিলাম, কিছু শক্তিশালী দেশ এই সরকারকে জয়ী করতে চায়। তাই আমি নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। পরবর্তীতে সরকার আমাদের সঙ্গে নেগোসিয়েশনে গেল।” আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতার বিষয় বলতে গিয়ে তিনি বলেন- “২৬ জনের তালিকা দেয়া হলো। কিন্তু আওয়ামী লীগ যেখানে জাতীয় পার্টির ক্যান্ডিডেট দিলো সেখানে স্বতন্ত্র পাওয়ারফুল প্রার্থীও রেখেছে। সরকার যাকে পাস করাতে চায়, তাকে পাস করানো হয়েছে। আমি যেই আসনে নির্বাচন করেছি, সেখানেও আমাকে হারানোর জন্য অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। আমাকে ধ্বংস করা মানে জাতীয় পার্টিকে ধ্বংস করা।” তিনি নির্বাচনকালীন সময়ে তার অবস্থান স্পষ্ট করে বলেন ‘আমি বুঝতে পেরেছিলাম, বিএনপি’র আন্দোলন সফল হবে না। বিদেশি তিনটি বড় শক্তি নির্বাচনকে সফল করতে চেয়েছে। আরও কিছু দেশ সরকারকে (আওয়ামী লীগ) জোরালো সমর্থন দিচ্ছিল।’

খুব নতুন কিছু বলেন নাই জি এম কাদের। রাজনীতির উঠানে এই আলাপগুলো চলে আসছে নির্বাচনের সময় থেকেই। কিন্তু যে প্রশ্নটি অবধারিত ভাবে উঠতে পারে তা হলো কথাগুলো এখন কেন? তিনি নিজেই দাবি করছেন সেই সময় তার মন অয়েল ‘ইনফর্মড নেতা’ দেশে কম ছিল। সেই ইনফরমেশন মানুষের কাছে প্রকাশ করতে বাধা কি ছিল তার? তাহলে কি তার বিষয়ে এমন কোনো তথ্য প্রমাণ সরকারের কাছে আছে যা প্রকাশিত হলে তার রাজনীতি করা দূরেই থাক নিজের ইমেজ রক্ষা করে চলাই কঠিন হবে? কারণ তার মতো মানুষ গুম বা হত্যার শিকার হবেন এটি রাজনৈতিক ভাবে খুব বিশ্বাসযোগ্য কথা না। বিএনপি’র আন্দোলন সফল হবে না তা যদি তিনি জেনে থাকেন তাহলে কি কারণে সফল হবে না সেটিও তিনি জানতেন। অর্থাৎ অনেকের মতে বিএনপি যে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে তার কারণ বিএনপি’র আন্দোলনের দুর্বলতা নয় বরং ভিন্ন কিছু। সেই ভিন্ন কিছুটা কি? বহিঃশক্তি? যে তিনটি দেশের কথা তিনি বলছেন তাদের নাম কেন তিনি বলতে পারছেন না? সেই শক্তিদের কোনো একটির সঙ্গে আপস করেই কি তিনি বিরোধী দলের নেতা? তার দাবি মতে সরকার যাকে পাস করাতে চায় তাকে পাস করানো হয়েছে, তার অর্থ কি সরকারের ইচ্ছা আর অনুগ্রহেই পাস করেছেন তিনি? নাকি কোনো বহিঃশক্তির ইশারায় তাকে সংসদে আনতে বাধ্য হয়েছে সরকার? নির্বাচনের আগ দিয়ে জি এম কাদেরের ভারত ভ্রমণ এবং তৎপরবর্তী নিশ্চুপ অবস্থা কিসের ইঙ্গিত দেয়?

গত দেড় দশকে আওয়ামী লীগ রাজনীতিকে যেখানে নিয়ে দাঁড় করিয়েছে তার বড় একটা দায় এই মানুষগুলোকে নিতে হবে। এদেশে রাজনীতিকে হত্যা বলি কিংবা বিরাজনীতিকরণ বলি, জাতীয় পার্টির দায় আওয়ামী লীগের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়।

manabzamin