আফগানিস্তানের বিপক্ষে টি-২০-তে নাইম শেখকে দলে নেয়ায় কেন এত সমালোচনা?

  • নয়া দিগন্ত অনলাইন
  •  ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৬:৪৬

নাঈম শেখ। – ছবি : সংগৃহীত

আফগানিস্তানের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজের জন্য ঘোষিত বাংলাদেশের স্কোয়াডে নাইম শেখের নাম দেখার পর তুমুল সমালোচনার মুখে পড়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের নির্বাচক প্যানেল।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ক্রিকেট সংক্রান্ত গ্রুপগুলোতে বাংলাদেশের ক্রিকেট সমর্থকদের অনেকেই বলছেন, নাইম শেখকে এবারে জাতীয় দলে নেয়া উচিত হয়নি, আবার অনেকে যুক্তি দিচ্ছেন নাইম শেখ যতটুকু করেছেন ততটুকুই বা কোন ক্রিকেটার করেছেন।

নির্বাচক প্যানেলের প্রধান মিনহাজুল আবেদীন নান্নু মনে করেন, নাইম শেখকে এখনই বাদ দেয়াটা হবে ‘অনুচিত’।

বাংলাদেশের নতুন ঘোষিত স্কোয়াডে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগের পারফরম্যান্সের প্রমাণ স্পষ্ট।

মুনিম শাহরিয়ারকে নিয়ে তুমুল আলোচনা ও প্রশংসার পরে তাকে জাতীয় দলের স্কোয়াডেও নেয়া হয়েছে।

একইসাথে ওয়ানডের পরে টি-টোয়েন্টি স্কোয়াডের অংশ হয়েছেন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগে ১৩৯ স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করা ইয়াসির আলী রাব্বি।

তবে নাইম শেখকে একটা বিপিএল দিয়ে মাপতে নারাজ নান্নু, তিনি মনে করেন টি টোয়েন্টি ক্রিকেটে গত এক বছর নাইম শেখ বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি রান নিয়েছেন, যেটাকে দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন তিনি।

গত এক বছরে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ ৫৭৫ রান তুলেছেন নাইম শেখ।

তিনটি ফিফটিও হাঁকিয়েছেন তিনি।

তবে তার ব্যাটিং নিয়ে আপত্তির জায়গাটা তার স্ট্রাইক রেট। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগে আট ম্যাচ খেলা নাইম শেখ মাত্র ৬৫ স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করেছেন। যেটা টি-টোয়েন্টি তো বটেই ওয়ানডে ক্রিকেটের সাথেও যায় না এখন।

গত বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে যারা অন্তত ৫০০ রান করেছেন, তাদের মধ্যে নাইম শেখের স্ট্রাইক রেট সবচেয়ে কম (১০০)।

নাইম শেখকে এর আগে গত সপ্তাহেই ওয়ানডে সিরিজের স্কোয়াড থেকে ড্রপ করা হয়, কিন্তু টি টোয়েন্টি দলে নেয়ার পর বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন নান্নু বলেছেন, ‘এখনই কোনো মন্তব্য করা মুশকিল তাকে নিয়ে।’

গত মঙ্গলবার ওয়ানডে দল ঘোষণার সময় বিসিবির প্রধান নির্বাচক নান্নু বলেছিলেন, ‘নাইম শেখ মেন্টালি ডিপ্রেসড।’

এটাকে নির্বাচকদের সিদ্ধান্তহীনতা বলছেন বিশ্লেষকরা।

আবার বিপিএলে নাইম শেখ যে দলের হয়ে খেলেছেন, মিনিস্টার ঢাকার ম্যানেজমেন্টে ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডেরই, তারাই নিয়মিত নাইম শেখকে ওপেনিংয়ে রাখতে ভরসা পাননি। হাবিবুল বাশার সুমন ছিলেন এই দলের ম্যানেজমেন্টে যিনি বিসিবির নির্বাচকদের প্যানেলেও আছেন, নাইম শেখ ঢাকার হয়ে এবারের বিপিএলে আট নম্বরেও নেমেছেন।

তবে বিশ্লেষক সাথিরা জাকির জেসি মনে করেন ব্যাপারটা এমন না যে জাতীয় দলের হয়ে রান করা একজন ক্রিকেটার একটা বিপিএল খেলেই বাদ পড়ে যাবে।

তিনি মনে করেন এখানে কিছু বিষয় দেখার আছে, প্রথমত নাইম শেখকে খেলানো হবে কি না, কারণ মুনিম শাহরিয়ার ও লিটন দাসের মতো টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান আছে এখন দলে।

‘দেখেন জাতীয় দলের একটা প্রসেস আছে, কোনো ক্রিকেটারকে দলে নেয়ার পর চাইলেই তাকে দল থেকে বাদ দেয়া যায় না, আবার যে কি না রানের দিক থেকে সবার ওপরে। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের স্ট্রাইক রেট এমনিই আহামরি কিছু না, হয়তো যার সবচেয়ে ভালো তার ১৩০ কারো ১২০, নাইমের ১০০।’

অনেক সময় উইকেটে টিকে থাকাটাও মূল্যবান মনে করেন জেসি।

‘তামিম ইকবাল থাকলে হয়তো এই ভূমিকাটাই পালন করতেন, কারণ তখন দায়িত্বটা তাকে নিতে হতো, এ প্রান্তে যিনি থাকবেন মুনিম বা লিটন তাকে ১৬০-১৭০ স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করতে হতো, তাহলেই এভারেজ স্ট্রাইক রেটটা কিন্তু সমান হয়ে যায়।’

বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়মিত অনুসারীদের একজন সূবর্ণ কবির জ্যোতি মনে করেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্রিকেট অনুসারীরা একইসাথে আবেগী এবং দ্রুত একটা রায় দিয়ে দেন যে কোনো বিষয়ে। তাদের সাথে পেশাদারদের চিন্তা মেলানোটা কঠিন।

আরেকজন ক্রিকেট সমর্থক অজন্তা বলেন, ‘আমরা যুক্তির থেকে আবেগকে বেশি প্রশ্রয় দিয়ে থাকি। এজন্য হয় কি, কেউ খেলায় খারাপ করলো সাথে সাথে তীব্র সমালোচনার ঝড় উঠাই।’

‘ব্যাপারটা এমন আমরা তাদেরকে অধিকার করে ফেলছি! এমন যে “আরে ভাই, এ সাধারণ খেলাটা প্যাচায় কেন?! ইশ! এই বলে কেউ ছক্কা হাঁকায়! এর থেকে তো আমিই পারি ভালো!”

তিনি মনে করেন মাঠে যারা ক্রিকেটটা খেলেন তাদের স্ট্রাগলটা বোঝা কঠিন, নাইম শেখের ক্ষেত্রেও এই ব্যাপারটাই ঘটেছে, তাকে যদি অযোগ্য মনে করা হয় তিনি ধীরে ধীরে দল থেকে বাদ পড়বেনই, আধুনিক ক্রিকেটে কেউই পারফরম্যান্স ছাড়া টিমে টিকে থাকতে পারেন না।

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে পাওয়ার-প্লে ব্যবহারের গুরুত্ব

বিশ্লেষকরা মনে করেন, একজন ওপেনিং ব্যাটসম্যান যদি ধীরগতিতে ব্যাট করেন তা অনেক সময়ই ম্যাচ থেকে যে কোনো দলকে ছিটকে দিতে পারে।

ক্রিকেট পরিসংখ্যানবিদ মাজহার আরশাদ লিখেছেন, ‘টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ৪০ বলে ৫০ এর চেয়েও তিনি ১ বলে ০ করে আউট হয়ে যাওয়া ভালো মনে করেন।’

এটা তিনি বাবর আজমের ব্যাটিংয়ের প্রেক্ষিতে লিখেছেন, বাবর আজমের দল এবার পাকিস্তান সুপার লীগে ১০ ম্যাচের নয়টিতেই হেরে গেছে।

বিষয়টি মাজহার আরশাদ এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন তার ভেরিফায়েড টুইটে, ‘আপনার হাতে রান করার জন্য দুটি উৎস আছে, ১০টি উইকেট ও ১২০টি বল।’

আরশাদের মতে, যখন একজন ব্যাটসম্যান ডাক মারে তখন সে অবদান রাখতে ব্যর্থ হয়, কিন্তু যখন একজন ব্যাটম্যান ৪০ বলে ৫০ রান তোলেন, তিনি অন্য উৎসগুলোও নষ্ট করে দেযন, সুতরাং যে উইকেটে অনায়াসে ২০০ রান হয় সেখানে ৫০ রানের একটা ধীরগতির ইনিংস শূণ্য রানের চেয়েও বেশি ক্ষতি করে।

বাবর আজম ১০ ম্যাচে ৩৪৩ রান করে শীর্ষ রান সংগ্রাহকদের তালিকায় আছেন কিন্তু মাজহার আরশাদ মনে করেন বাবরের রান তার দলের কাজে আসেনি, তিনি ১১৮ স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করেছেন।

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে প্রথম ছয় ওভার থাকে পাওয়ার প্লে, এই সময়ে ফিল্ডিং বাধ্যবাধকতার কারণে ব্যাটিং দলের লক্ষ্য থাকে দ্রুত রান নেয়া।

এই সময়টা কাজে লাগাতে না পারলে পরের ব্যাটসম্যানদের ওপর স্বয়ংক্রিয়ভাবেই চাপ পড়ে, যা সামলে উঠতে গিয়ে অনেক সময়ই ইনিংস বিপর্যয়ের দিকে আগায়।

নাইম শেখ মূলত ২০১৯ সালে নাগপুরে ভারতের বিপক্ষে ৪৮ বলে ৮১ রানের একটি ইনিংস খেলে আলোচনায় আসেন কিন্তু তারপর আর কখনোই এই গতিতে ব্যাটিং করতে পারেননি তিনি।

৩২ ম্যাচ খেলা নাইম শেখের স্ট্রাইক রেট এখন ১০৫.৬২।

সূত্র : বিবিসি