বিল্লাল হোসেন রবিন, নারায়ণগঞ্জ থেকে: স্কুলছাত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যায় বিশেষ মহল জড়িত ইঙ্গিত করে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে
সাধারণ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য চলচ্চিত্র অভিনেত্রী সারাহ বেগম কবরী। তিনি বলেন, সময় এসেছে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার। গতকাল দুপুরে ত্বকীর পরিবারকে সান্ত্ব্তনা দিতে গিয়ে কবরী এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার গতানুগতিকভাবেই চলছে। ত্বকী হত্যার রহস্য উদঘাটনে শুধুমাত্র একদিকে নজর দিলে চলবে না। কারণ, তরুণ ব্যবসায়ী আশিক ইসলাম আর ত্বকী হত্যাকাণ্ড একই সূত্রে গাঁথা। শহরের একটি বিশেষ পরিবারের প্রতি ইঙ্গিত করে সংসদ সদস্য কবরী বলেন, আওয়ামী লীগের রাজনীতি কোন বিশেষ পরিবারের জন্য নয়। ওই পরিবারের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ। এটা চলতে পরে না। নিরপরাধ একটা ছেলেকে এভাবে হত্যা করা হলো? তার বাবার ওপর রাগ ক্ষোভ থাকতে পারে, কিন্তু সন্তানের প্রতি ঘাতকদের এ নিষ্ঠুর আচরণ মেনে নেয়া যায় না।
নিহত ত্বকী নারায়ণগঞ্জ গণজাগরণ মঞ্চের প্রধান উদ্যোক্তা ও নাগরিক কমিটির সহসভাপতি সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বি’র ছেলে, প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা ডা. শাহাদাৎ হোসেনের নাতি। কবরী ত্বকীর মাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। ওই সময় হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়।
এর আগে ত্বকীর পিতা রফিউর রাব্বিকে উদ্দেশ্য করে কবরী বলেন, আমি জনপ্রতিনিধি হয়েও আপনার ছেলেকে রক্ষা করতে পারিনি। এটা আমার ব্যর্থতা। আমাকে ক্ষমা করবেন। কিন্তু সময় এসেছে রুখে দাঁড়ানোর। আজ রাব্বির ছেলে গেছে, কাল আরেকজনের যাবে। এভাবে আর চলতে দেয়া হবে না। এখানেই হত্যাকাণ্ডের ইতি টানতে হবে। তাই সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ জানাতে হবে।
তিনি বলেন, ২০১১ সালে বাসভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে সভা চলাকালে কারা পরিবহন মালিকদের পক্ষ নিয়ে জনপ্রতিনিধি ও বাসভাড়ার বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলে পড়েছিল তা নারায়ণগঞ্জবাসী জানে।
তিনি বলেন, তরুণ ব্যবসায়ী আশিক ইসলামকে একই ভাবে হত্যার পর আমি বিষয়টি জেলার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা কমিটিতে উত্থাপন করেছিলাম। কিন্তু প্রশাসন আমার কথায় কর্ণপাত করেনি। বরং, একজন সংসদ সদস্য উল্টো বলেছিলেন, জেলায় ৪-৫টা খুন হতেই পারে। এতে আতঙ্কিত হওয়ার কি আছে? তাহলে বোঝা যাচ্ছে কারা হত্যাকাণ্ডের মদত যোগাচ্ছে।
স্কুলছাত্র ত্বকী নিখোঁজ হওয়ার পর স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকাণ্ড এবং তার লাশ উদ্ধারের পর দু’দিন অতিবাহিত হলেও কোন ঘাতক গ্রেপ্তার না হওয়ায় প্রশাসনের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন কবরী।
ওই সময় সংসদ সদস্যের সঙ্গে উপস্থিত শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন বলেন, এই শহরে একজন যুবরাজ আছে। ওই যুবরাজ কে প্রশাসন তা জানে, কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
সন্তান হারানোর কষ্ট কতটা নির্মম,
একজন পিতাই তা বুঝতে পারে
সন্তান হারানোর কষ্ট কতটা নির্মম, একজন পিতাই তা বুঝতে পারেন। আমার মতো কোন পিতা যাতে আর সন্তানহারা না হয়। আমি আমার ছেলেকে আর ফিরে পাবো না সত্য, কিন্তু আমার ছেলেকে উদ্ধারে প্রশাসন পুরোপুরি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। নারায়ণগঞ্জে র্যাব ১১-এর কার্যালয় আমার বাসা থেকে মাত্র ৪০-৫০ গজ। অথচ এতটুকু দূরত্বে থাকার পরও র্যাব আমাদের নিরাপত্তা দিতে পারেনি। তাহলে এ বাহিনী রেখে লাভ কি? তাদের প্রয়োজনই বা কি? এ বিশেষ বাহিনী নারায়ণগঞ্জে এক বিশেষ মহলের হয়ে কাজ করে। তাই আমরা সাধারণ মানুষ তাদের সেবা পাই না। আমার ছেলে নিখোঁজ হওয়ার পর থানায় জিডি করেছি। ওই জিডির কপি র্যাব-১১ নারায়ণগঞ্জ ক্যাম্পেও দেয়া হয়েছে। পরদিন সকালে সাংবাদিকরাও ক্যাম্পে গিয়ে ত্বকীর নিখোঁজের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখার জন্য বলেছে। কিন্তু তারা কার্যকর কোন ব্যবস্থা নেয়নি। নিহত স্কুলছাত্র তানভির মোহম্মদ ত্বকীর শোকাহত পিতা বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বি ক্ষোভ আর দুঃখ নিয়ে গতকাল বিকালে তার বাসভবনে মানবজমিনকে কথাগুলো বলেন।
রফিউর রাব্বি বলেন, আমার পিতা মরহুম ডা. শাহাদাত হোসেন নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের একজন সংগঠক। স্বাধীনতার পর থেকে মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত তিনি জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। সিন্দাবাদের ভূতের মতো একটি বিশেষ গোষ্ঠী নারায়ণগঞ্জবাসীর ঘাড়ের ওপর চেপে বসে আছে। ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটলে ওই ভূত থাকে না। তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জে একটি বিশেষ মহল আছে। তাদের বিরুদ্ধে কথা বললে হয় রাজাকার, না হয় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি হয়ে যেতে হয়। সাম্প্রতিক সময়ে নারায়ণগঞ্জের আশিক, চঞ্চল হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ত্বকী হত্যার যোগসূত্র থাকতে পারে বলে মনে করছেন রফিউর রাব্বি। তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জে একটা টর্চার সেল আছে। পুরো শহরবাসী জানে। কিন্তু প্রশাসন জানে না। নারায়ণগঞ্জের প্রশাসন বিশেষ লোকদের হয়ে কাজ করে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও ফাঁসির দাবিতে নারায়ণগঞ্জে গণজাগরণ মঞ্চের উদ্যাক্তা আমি। এটা ঠিক। সব সময় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির সঙ্গেই আছি। কিন্তু আমি কোন রাজনীতি করি না। তবে বিভিন্ন সময়ে নাগরিক সমস্যা নিয়ে সোচ্চার হয়েছি, অহেতুক বাসভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদ করেছি, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরাসরি একটি পক্ষের হয়ে কাজ করেছি, এসব কারণে একটি বিশেষ মহল আমার ওপর ক্ষুব্ধ হতে পারে। ওই মহলটিই হয়তো গণজাগরণ মঞ্চের চলমান আন্দোলনের সময়টাকে মোক্ষম সময় হিসেবে বেছে নিয়েছে- যাতে খুনিরা সহজেই পার পেয়ে যায়। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের সর্বস্তরের মানুষ যেভাবে ত্বকীর হত্যাকাণ্ড নিয়ে সোচ্চার হয়েছে, তারা যদি ঐক্যবদ্ধ থাকে তাহলে প্রশাসন খুনিদের রক্ষা করতে পারবে না।
তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জবাসীর দুর্ভাগ্য, এতগুলো হত্যাকাণ্ড হলো- একটারও সুরাহা হলো না। পুলিশ রহস্য উন্মোচিত করতে পারেনি। বরং, হত্যা মামলার তদন্ত করতে গিয়ে এমন কিছু লোকের নাম চলে আসে তখন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হলে উপরের পারমিশন লাগবে বলে পুলিশ দোহাই দেয়। আমার ছেলের বেলায়ও তাই হতে পারে বলে আশঙ্কা করছি। আমি আমার সন্তান হত্যার বিচার চাই। ঘাতক যেই হোক তাদের গ্রেপ্তার করে এ হত্যার রহস্য উন্মোচন করতে হবে।
প্রশাসনের ব্যর্থতার কারণেই
ত্বকীকে প্রাণ দিতে হয়েছে
এদিকে মেধাবী স্কুলছাত্র ত্বকী হত্যার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বক্তারা বলেছেন, প্রশাসনের ব্যর্থতার কারণেই অকালে ত্বকীকে প্রাণ দিতে হয়েছে। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পরিচালিত প্রশাসন ত্বকীর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হয়েছে। এ ব্যর্থতা একই সঙ্গে সরকারেরও।
গতকাল বিকালে শহরের চাষাঢ়া শহীদ মিনারে ত্বকী হত্যায় আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশে জেলার সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ এসব কথা বলেন। প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে ত্বকী হত্যার ঘটনায় ৫ দিনব্যাপী কর্মসূচিও ঘোষণা করা হয়। আজ থেকে এ কর্মসূচি শুরু হয়ে ১৫ই মার্চ পর্যন্ত চলবে।
বক্তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ত্বকী নিখোঁজ হওয়ার পর তার পিতা থানায় জিডি করার পর পুলিশের পাশাপাশি র্যাব ও জেলা গোয়েন্দা পুলিশের সহযোগিতা কামনা করেন। কিন্তু র্যাব-পুলিশ কেউই ত্বকীকে উদ্ধারে এক চুল পরিমাণও নড়েনি। প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তায় খুনিরা ত্বকীকে নির্মমভাবে হত্যার পর লাশ নদীতে ফেলে দেয়। আর ত্বকীকে হত্যার পর পুত্র হারানোর বেদনায় শোকাহত পিতাকে প্রশাসন জিজ্ঞেস করে কারা খুন করতে পারে।
সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি এডভোকেট প্রদীপ ঘোষ বাবুর সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি রুমন রেজা, সিপিবির সভাপতি হাফিজুল ইসলাম, বাসদের সমন্বয়ক নিখিল দাস, খেলা ঘর জেলা কমিটির সভাপতি রথীন চক্রবর্তী, ভবানী শংকর রায়, উদীচীর সভাপতি জাহিদুল হক ভূঁইয়া দিপু, নাগরিক কমিটির সভাপতি এডভোকেট এবি সিদ্দিক, সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান, ছাত্র নেতা সজল বাড়ৈ, গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ক তরিকুল সুজন প্রমুখ।
প্রতিবাদ সমাবেশ শেষে একটি মশাল মিছিল শহর প্রদক্ষিণ করে।
৫ দিনের কর্মসূচি
ত্বকী হত্যার প্রতিবাদে আজ থেকে ৫ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে, আজ জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ঘেরাও এবং স্মারকলিপি পেশ, আগামীকাল বিকালে শহীদ মিনারে নাগরিক শোকসভা, বুধবার পাড়া-মহল্লায় গণসংযোগ, বৃহস্পতিবার সকালে শহীদ মিনারে ছাত্র সমাবেশ এবং শুক্রবার বিকালে শহীদ মিনারে গণজমায়েত।
স্কুল ও সহপাঠীদের মানববন্ধন
এদিকে ত্বকী হত্যার প্রতিবাদে তার স্কুল, সহপাঠী এবং জাগো ফাউন্ডেশন মানববন্ধন করেছে। সকাল ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধনটি অনুষ্ঠিত হয়। মানববন্ধনটি প্রেস ক্লাবের নিচ থেকে শুরু হলেও সেটি পরে ক্লাবের উত্তর দিকে যেতে যেতে চাষাঢ়া শহীদ মিনার পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে। মানববন্ধনে নিহত ত্বকীর স্কুল এবিসি ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের শিক্ষার্থী-শিক্ষক, জাগো ফাউন্ডেশনের সদস্য এবং ত্বকীর বন্ধু মহল অংশ নেয়।
মানববন্ধনে অংশ নেয়া এবিসি ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের অধ্যক্ষ আবদুল হাই বলেন, আমরা ত্বকীর মতো একটি মেধাবী ছেলেকে হত্যার বিচার চাই।
উল্লেখ্য, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে নারায়ণগঞ্জে গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম উদ্যোক্তা বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বির ছেলে তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী (১৭) বুধবার বিকালে নিখোঁজ হয়। ৪০ ঘণ্টা পর শুক্রবার সকালে শহরে শীতলক্ষ্যা নদীর তীর থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়।
Source: Manab Zamin