দখলদারিত্ব আর গণহত্যার ইন্ধনে ভারতীয় পুঁজি

আমার দেশ অনলাইন
প্রকাশ : ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ০৬: ৫৯
আপডেট : ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ০৭: ১০

ছবি সংগৃহিত।

আধুনিকতার মুখোশ: এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে টাটা গ্রুপকে ভারতের পুঁজিবাদের অন্যতম বিবেক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। টাটা গ্রুপের রয়েছে এক অনন্য ইতিহাস, যারা জনকল্যাণকর কাজের মাধ্যমে লাভ করে, আর তাদের অগ্রগতির মূলমন্ত্র হচ্ছে নীতি-নৈতিকতা। লাখ লাখ ভারতীয় নাগরিকের কাছে টাটা একটি আস্থার নাম। আধুনিক ভারতীয় উপখ্যানের সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত একটি ব্র্যান্ড।

এত এত সদ্গুণের উপর গড়ে ওঠা এই টাটা গ্রুপের মুখোশের পিছনে রয়েছে এক অন্ধকার বাস্তবতা। যা টাটাকে ফিলিস্তিনের গাজা ধ্বংসকারী ইসরাইলের যুদ্ধযন্ত্রের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক দক্ষিণ এশীয় সংগঠন সালাম-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে শিরোনাম করা হয়েছে ‘অধিগ্রহণের স্থপতি: টাটা গ্রুপ, ভারতের পুঁজি এবং ভারত-ইসরাইল জোট’। এখানে টাটা-কে বলা হয়েছে ভারত-ইসরাইলের সামরিক অংশীদারিত্বের হৃদয়। আরো উঠে এসেছে ইসরাইলের নজরদারি এবং দখলদারি স্থাপত্যের সঙ্গে টাটা কীভাবে জড়িত । টিআরটি ওয়ার্ল্ডের কভারেজ আরও বিশদভাবে বর্ণনা করে বলেছে কীভাবে এই সহায়ক সংস্থাগুলি সরাসরি ইসরাইলের সামরিক-শিল্পকে টিকিয়ে রেখেছে।

অনুসন্ধান: জটিলতার জাল

প্রতিবেদনে, টাটা গ্রুপের বেশ কয়েকটি সহায়ক সংস্থাকে চিহ্নিত করা হয়েছে, যারা ইসরাইলের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তার বাস্তুতন্ত্রে সরাসরি জড়িত।

AmarDesh_TASL

ভারতের বৃহত্তম বেসরকারি প্রতিরক্ষা নির্মাতা টাটা অ্যাডভান্সড সিস্টেমস লিমিটেড (টিএএসএল) এর সাথে দীর্ঘস্থায়ী অংশীদারিত্ব রয়েছে ইসরাইল অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ (আইএআই) । প্রতিষ্ঠান দুটি একত্রে বারাক-৮ সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল সিস্টেমের মূল উপাদান তৈরি করে। এটি ইসরাইলের নৌ প্রতিরক্ষার মেরুদণ্ড পাশাপাশি গাজায় হামলায় ব্যবহৃত গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র। TASL F-16 যুদ্ধবিমানের বিমান কাঠামো এবং অ্যাপাচি হেলিকপ্টারের জন্য ফিউজলেজও তৈরি এই প্রতিষ্ঠানগুলো। আরএই বিমান আর হেলিকপ্টানগুলো ব্যাপকহারে ব্যবহার করা হচ্ছে পশ্চিম তীরে।

AmarDesh_TATAJAGUAR

টাটার আরেকটি সহায়ক সংস্থা জাগুয়ার ল্যান্ড রোভার (JLR) যাদের বিরুদ্ধে MDT ডেভিড হালকা সাঁজোয়া যানের জন্য চ্যাসিস সরবরাহ করার অভিযোগ রয়েছে। আর এই যানগুলো পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের টহল ও দমনের জন্য ব্যবহার করে থাকে ইসরাইলি বাহিনী ।

অন্যদিকে আইটি জায়ান্ট টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিসেস (টিসিএস) ইসরাইলের সরকারি ও আর্থিক খাতের জন্য ডিজিটাল অবকাঠামো তৈরির কাজে জড়িত বলে জানা গেছে। এর মধ্যে রয়েছে গুরুতর প্রোজেক্ট নিম্বাস। যেখানে ইসরাইলের নজরদারি সহজিকরণে গুগল এবং অ্যামাজনের সঙ্গে বিতর্কিত ক্লাউড-কম্পিউটিং চুক্তি করতে সহায়তা করেছে টিসিএস।

সালাম রিপোর্ট তাদের যুক্তি দিয়ে বুঝিয়েছে, এগুলি কোনো বিচ্ছিন্ন বাণিজ্যিক ব্যবস্থা নয় বরং ইসরাইলের দখলদারি অর্থনীতির মধ্যে ভারতের পুঁজির একটি পদ্ধতিগত অংশ।

নিউইয়র্ক সিটি ম্যারাথনের মতো বিশ্বব্যাপী ইভেন্টগুলিতে টাটা স্পনসর করে। এগুলোকে “ক্রীড়া-ধোলাই” হিসাবে বর্ণনা করেছে সালামের প্রতিবেদনে। বলা হয়েছে বিশ্বব্যাপী আধুনিকতা এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার আড়ালে যুদ্ধের লাভজনক অংশগ্রহণ ঢাকার একটি উপায়। টাটা গ্রুপকে এই অভিযোগের বিষয়ে বারবার জিজ্ঞাসাবাদ করলেও কোনো প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেনি।

রাজ্য থেকে কর্পোরেশন: ভারত-ইসরায়েল জোট

টাটার এই জটিলতার মাঝে কোনো শূন্যতা নেই। কেননা এটি ভারতের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা নীতি প্রকাশের বৃহত্তম রাষ্ট্রীয় কর্পোরেট আয়না।

৯০-এর দশক থেকে, বিশেষত নরেন্দ্র মোদীর সময়ে ভারত ইসরাইলের সম্পর্ক, নিরবতা থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ কৌশলগত অংশীদারিত্বের দিকে চলে এসছে। এখন ভারত ইসরাইলের অস্ত্রের বৃহত্তম ক্রেতা, যা ইসরাইলের প্রতিরক্ষা রপ্তানির প্রায় ৪০-৪৫ শতাংশ।

যৌথ উদ্যোগে বিস্তার:

AmarDesh_Barak-8

ডিআরডিও এবং আইএআই যৌথভাবে বারাক-৮ ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্পটি তৈরি করেছে, এর অংশ বিশেষ টাটা এসেম্বলি করেছে।

ভারতের কেনা হেরন ড্রোন, ফ্যালকন এডব্লিউএসি‌এস সিস্টেম এবং স্পাইক অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক ক্ষেপণাস্ত্র—সবই একই শিল্প নেটওয়ার্কের অংশ, যা ফিলিস্তিনে ইসরাইলের দখলদারিত্বকে টিকিয়ে রাখছে।

এই সিস্টেমের বেশ কিছু অংশ ভারত কাশ্মীরে ব্যবহার করে আসছে। যা একটি দখলকে অন্য দখলের সঙ্গে সংযুক্ত করে আসছে। যেখানে ফিলিস্তিন এবং কাশ্মীরিদের নজরদারির মধ্যে একটি বিরক্তিকর সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়।

AmarDesh_indo

এই ভূ-রাজনৈতিক ব্যাখ্যায়, হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদ এবং ইহুদিবাদ আদর্শ একই ফ্রন্টে দাঁড়িয়েছি। উভয়ই নিরাপত্তা এবং সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী বক্তব্যের আড়ালে আধিপত্যবাদকে ন্যায্যতা দেয়। উভয়ই দেশপ্রেমের নামে সামরিকবাদকে স্বাভাবিক করে তোলে। দুটো দেশই তাদের সমাজকে ডিজিটাল নজরদারি এবং জাতিগত-ধর্মীয় নিয়ন্ত্রণের পরীক্ষাগারে পরিণত করেছে।

সুতরাং, টাটা গ্রুপের অংশীদারিত্ব কেবল বাণিজ্যিক নয়। এগুলি রাজনৈতিক প্রকল্পের অর্থনৈতিক প্রকাশের অংশ। যেখানে কর্পোরেট পুঁজি, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এবং আদর্শ একে অপরের সাথে মিলেমিশে আছে।

কর্পোরেট সহযোগিতা এবং নীতিগত ফাঁকি

টাটাই একমাত্র নয়। বরং বিশ্বব্যাপী কর্পোরেশনগুলি দীর্ঘদিন ধরেই ইসরাইলি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে সমর্থন করে আসছে। হিউলেট-প্যাকার্ড, ক্যাটারপিলার এবং এমনকি এখন গুগল এবং অ্যামাজনের মতো সকলের বিরুদ্ধেই দখলদারিত্ব এবং নজরদারি সক্ষম করার অভিযোগ উঠেছে। তবে টাটার নীতিগত অবস্থানের কারণে বিষয়টি একটু ভিন্ন আঙ্গিকে দেখতে হয়।

AmarDesh_TATAad1

কেননা টাটা কোম্পানি তার বিজ্ঞাপনে গান্ধীর আদর্শ তুলে ধরে জন কল্যাণমূলক কথা বলে। অন্যদিকে তারা মৃত্যু নিয়ে ব্যবসা করে লাভবান হয়। যদিও তাদের নিজস্ব আচরণবিধি জাতিসংঘ ও অন্যান্য মানবাধিকার নির্দেশিত নীতিমালার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অর্থাৎযা মানবাধিকার লঙ্ঘনে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করে। তবুও তাদের মধ্যে কোনো দৃশ্যমান জবাবদিহিতা ব্যবস্থা নেই। তারা তাদের প্রতিরক্ষা খাাতের কোনো রাজস্ব প্রকাশ করে না। নীতিগত সম্মতির কোনও পাবলিক অডিট নেই এবং এর চুক্তির মানবিক প্রভাবের উপরো তাদের কোনো নিজস্ব পর্যবেক্ষণ নেই।

সালাম রিপোর্ট এই ধারণাটিকে ‘কর্পোরেট জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে নৈতিক ফাঁকি’ বলে অভিহিত করেছে। ভারতীয় কোম্পানিগুলো দেশপ্রেম অথবা মেক ইন ইন্ডিয়া এর মতো শব্দগুলো ব্যবহার তদন্তকে উপেক্ষা করতে পারে। যুদ্ধ থেকে লাভবান হওয়ার জন্য এটি একটি সুবিধাজনক আবরণ।

ভারত নীরবতার সহযোগী

ভারতের মূলধারার মিডিয়াগুলো টাটার বিরুদ্ধে খুব কমই রিপোর্ট করেছে। এমনকি ভারত সরকারও তাদের তদন্তে কোনও আগ্রহ দেখায়নি। এর বিপরীতে, কর্মকর্তারা ভারত-ইসরাইলের ‘কৌশলগত আলিঙ্গন’-কে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির একটি মডেল হিসেবে জোরেশোরে প্রচার করে চলেছেন।

নাগরিক সমাজও এখন দ্বিধাগ্রস্ত। কয়েক দশক আগেও ভারত ফিলিস্তিনি স্বার্থের পক্ষে সোচ্চার ছিল। অথচ আজ সংহতির স্থানে ভর করেছে নীরবতা আর ভয়। অন্যদিকে চলছে গণহত্যার বিপজ্জনক পরিস্থিতিকে স্বাভাবিকীকরণ । যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি একসময় দখলদারিত্বের উপর আলোচনার আয়োজন করেছিল, তারা এখন বিষয়টি এড়িয়ে চলে। প্রতিবাদকারীরা কঠোর আইনের অধীনে গ্রেপ্তারের ঝুঁকিতে থাকে।

কর্পোরেটদের বিবেক যখন দখলে থাকে তখন তা সাধারণ মানুষের জীবনের নৈতিক পতনের প্রতিফলন ঘটায়।

জবাবদিহিতা দেখতে কেমন

আন্তর্জাতিক আইন এই বিষয়টি স্পষ্ট। যখন কোনো কোম্পানি জেনেশুনে যুদ্ধাপরাধকে সক্ষম করে এমন সরঞ্জাম বা পরিষেবা সরবরাহ করে, তখন কোম্পানির কার্যক্রমও সেই অপরাধে জড়িত হতে পারে। রোমের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সংবিধি এবং জাতিসংঘের নির্দেশিকা নীতি দুটোতেই সশস্ত্র সংঘাতকালীন সময়ে কর্পোরেটদের দায়িত্বপালনে রূপরেখা দিয়েছে।

গাজায় ব্যবহৃত অস্ত্রের জন্য টাটার উপাদান তৈরির বিষয়টি তাই স্বাধীন তদন্ত হওয়া উচিত। বিনিয়োগকারী, ট্রেড ইউনিয়ন এবং ভোক্তাদের এই স্বচ্ছতা দাবি করার অধিকার এবং কর্তব্য রয়েছে।

AmarDesh_Apartheid

এর দৃষ্টান্ত রয়েছে: ১৯৮০-এর দশকে, বিশ্বব্যাপী আন্দোলন দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদের বিরুদ্ধে কোম্পানিগুলোর ওপর জন্য চাপ দিয়েছিল, যেন তারা সেখানে তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে। একই রকম এক নৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন ইসরাইলের বিরুদ্ধে। যারা ইসরাইলের বর্ণবৈষম্য থেকে লাভবান হচ্ছে। বয়কট, বিনিয়োগ প্রত্যাহার ও নিষেধাজ্ঞা (বিডিএস) আন্দোলন তেমনই এক আহ্বান, এবং ভারতীয় নাগরিক সমাজকে এ থেকে দূরে থাকা উচিত নয়।

যখন বিবেককে প্ররোচিত করা হয়

AmarDesh_TATAad

গণহত্যার সামনে টাটার নীরবতা কেবল কর্পোরেট ব্যর্থতা নয়। এটি গান্ধীর ভূমি ভারতের নৈতিক দাবির শূন্যতাকেও প্রতিফলিত করে। যখন এর প্রধান কর্পোরেশন জাতিগত নির্মূলের যন্ত্রপাতিতে প্রচ্ছন্ন অবদান রাখে তখন সেই ঐতিহ্যের আর কিছু্‌ বাকি থাকে না?

যখন গাজার শিশুরা অনাহারে থাকে এবং পুরো পরিবার ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে, তখন টাটার সাম্রাজ্য সেই হত্যাকারী রাষ্ট্রের কাছে প্রযুক্তি বিক্রি করে চলেছে। অথচ তাদের বিজ্ঞাপনগুলোতে সহানুভূতির সঙ্গে প্রচার করা হচ্ছে-‘একটি উন্নত আগামী গড়া।’

যে জাতির কোম্পানিগুলো নিপীড়িতদের রক্তের ওপর মুনাফা গড়ে তোলে, সে জাতি কখনো নৈতিক নেতৃত্ব দাবি করতে পারে না। এখন আর বিনয়ী বা নীরবতার সময় নয়; ভারতকে এখন নিজের মুখোমুখি হতে হবে এবং তার হারানো মানবতাকে ফিরিয়ে আনতে হবে।

মিডল ইস্ট মনিটর নিবন্ধে মতামত দিয়েছেন রঞ্জন সলোমন। ভাষান্তরে মো. মাহফুজুর রহমান।

Source: https://www.dailyamardesh.com/world/amdvuzc7mkrpv

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here