সিসি মডেল এবং জেনারেল সিসির মিসর বিজয়

ফারুক ওয়াসিফ : ফরাসি জেনারেল নেপোলিয়ন বোনাপার্টের পরে, আধুনিক যুগে, জেনারেল সিসি হলেন দ্বিতীয় জেনারেল, যিনি মিসর জয় করেছেন। শুধু জয় বললে কম বলা হয়। তিনি উপর্যুপরি বিজয়ী হয়ে চলেছেন। তবে নেপোলিয়ন ছিলেন দখলদার, আর জেনারেল আব্দুল ফাত্তাহ আল-সিসি নিজে নীল নদীরই মিসরীয় সন্তান।

আরব বসন্তের পাখিরা এখন নীরব। অনেকে হত্যাকাণ্ডের শিকার, অনেকে জেলবন্দি। এখন শুধু জেনারেল সিসির জয়গান। গত ১০-১২ ডিসেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি তৃতীয়বারের মতো বিজয়ী হয়েছেন। এবারে ভোট পেয়েছেন ৮৯ শতাংশ। মিসরের প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে উচ্ছেদের পরের দুটি নির্বাচনে পেয়েছিলেন ৯০ শতাংশেরও বেশি ভোট।

তৃতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট হবার জন্য সিসিকে সংবিধান সংশোধন করতে হয়েছে। আগের সংবিধানে কেউ দুইবারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারতেন না। শুধু সেই বাধা উঠিয়ে নেওয়াই নয়, সিসি প্রেসিডেন্টের মেয়াদ চার বছর থেকে ছয় বছরও করিয়ে নিয়েছেন। সুতরাং ২০৩০ সাল পর্যন্ত সিসি ক্ষমতায়। সিসি সরকারের ‘সবুজ মিসর ২০৩০’ উন্নয়ন কর্মসূচিও ২০৩০ সাল অবধি চলবে।
নম্রভাষী এই জেনারেলকে কেউ চিনত না। যুক্তরাষ্ট্রে সামরিক প্রশিক্ষণ নেওয়ার সময়ে তাঁকে কারোরই তেমন গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি। কিন্তু তিনিই মিসরকে মুসলিম ব্রাদারহুডের হাত থেকে ‘রক্ষা’ করেন। এ জন্য ব্রাদারহুডের একটি সমাবেশ ভণ্ডুল করতেই হাজারেরও বেশি তরুণকে হত্যা করতে হয়। নিষিদ্ধ করতে হয় দলটিকে।

মিসর এ-রকম দেশ রক্ষাকারীদের হাতে বারবারই পড়েছে। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে পরাজয়ের জন্য সে সময়ের রাজা ফারুককে দায়ী করে সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতা নেন তরুণ কর্নেল গামাল আবদেল নাসের। নাসের হয়ে ওঠেন আরব জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা। এমনকি তাঁর নেতৃত্বে মিসর ও সিরিয়া ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্রও গঠন করে। এই প্রক্রিয়ায় তিনি কঠোর হাতে দমন করেন ইসলামপন্থি বিরোধীদের। নাসের আততায়ীর হাতে নিহত হলে তাঁর জায়গায় আসেন আরেক সেনাকর্তা আনোয়ার সাদাত। আনোয়ার সাদাতের আমলও ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজয় এবং অভ্যন্তরীণ দমনপীড়নের রেকর্ডে ভরা। আনোয়ার সাদাতের সময়ই প্রথম আরব রাষ্ট্র হিসেবে মিসর ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করে। এর ফলে দখলদার রাষ্ট্র থেকে ইসরায়েল হয়ে ওঠে মিসরের মিত্র রাষ্ট্র।

সেই ধারাবাহিকতাতে এবারেও যখন গাজায় ভয়াবহ গণহত্যা চলছে, তখন মিসর গাজার একটি দিক পাহারা দিয়ে চলছে, যাতে কেউ সেখান থেকে মিসরে প্রবেশ করতে না পারে। কৌশলগত কারণ হিসেবে সিসির বক্তব্য হলো এই– ইসরায়েল গাজাবাসীকে সিনাই উপত্যকায় ঠেলে দিয়ে গাজাকে জনশূন্য করায় সফল হবে। দ্বিতীয়ত, সিনাই উপত্যকায় ফিলিস্তিনিরা আশ্রয় পেলে ইসরায়েল ‘আত্মরক্ষার অধিকারে’র কথা বলে সেখানেও হামলা চালাবে।

এবারকার যুক্তি ঠিক থাকলেও, গাজার ওপরে আগে থেকে চলে আসা ইসরায়েলি অবরোধ কোনোভাবেই সফল হতো না, যদি মিসরও ইসরায়েলের চাহিদামতো গাজার সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ না করত। বলা চলে, গাজাবাসীকে অবরুদ্ধ করে রাখার প্রধান সহযোগী হলো মিসর। আরব জাতীয়তাবাদের প্রাণকেন্দ্র মিসর হলো পরাশক্তি ইসরায়েলের বিশ্বস্ত বন্ধু।

২০১৩ সালে পতিত স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের পতনের সময় আল-সিসি ছিলেন সামরিক গোয়েন্দা দপ্তরের প্রধান। তাহরির চত্বরের বিক্ষোভের জেরে হোসনি মোবারকের প্রতি সেনাবাহিনী সমর্থন তুলে নিলে তিনি পদত্যাগে বাধ্য হন। ক্ষমতা নির্বাচিত কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরের মধ্যবর্তী পর্যায়ে দেশ পরিচালনার জন্য সামরিক কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠন করা হয় ৩০ জনের কাউন্সিল। আল-সিসি ছিলেন সেই কাউন্সিলের কনিষ্ঠতম সদস্য। ওই কাউন্সিল আন্দোলনকারী শক্তিদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় দল মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে যোগাযোগের দায়িত্ব দেয় জেনারেল সিসিকে। দ্রুতই তিনি ব্রাদারহুডের নেতাদের আস্থা অর্জন করেন।

ব্রাদারহুড আর সেনাবাহিনীর মধ্যে সম্ভবত এ রকম একটা সমঝোতা হয়েছিল যে, ব্রাদারহুড সেনাবাহিনীকে ঘাঁটাবে না আর সেনাবাহিনীও বেসামরিক প্রশাসন চালাতে দেবে রাজনৈতিক সরকারকে। সামরিক তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে বিজয়ী হয়ে আসেন ব্রাদারহুডের প্রার্থী মোহাম্মদ মুরসি। যে সিসির আদালতে কয়েক বছর পরে বিচারাধীন অবস্থায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বেন মুরসি,
সেই সিসিই হন মুরসি সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী। ৭৬ বছরের জেনারেলকে সরিয়ে ৫৭ বছরের সিসিকে ওই পদে বসান স্বয়ং মুরসি। এভাবেই নিজের কবর তিনি নিজের হাতেই খোঁড়েন।

ক্ষমতাসীন হওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই আরব বসন্ত ঘটানো তরুণদের মধ্যে অজনপ্রিয় হয়ে ওঠে ব্রাদারহুড সরকার। মুরসি নিজেকে সাময়িক সময়ের জন্য সংবিধানের ঊর্ধ্বে নিয়ে যান। নতুন সংবিধান বাস্তবায়নে বিরোধীদের বাধা এড়াতে এটি নাকি তাঁর প্রয়োজন ছিল। এই সুযোগটাই নেয় সেনাবাহিনী। তারা বিক্ষোভকে উস্কে মুরসি সরকারকে জনগণের বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে দেয়।
মোহাম্মদ মুরসির সরকারকে ইসরায়েল চাইছিল না, সৌদি আরব চাইছিল না, চাইছিল না যুক্তরাষ্ট্রও। যখন মিসরীয় জনগণের একটা অংশও তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেল, সেই সুযোগটা কেউই হাতছাড়া করল না। এক মাহেন্দ্রক্ষণে প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল সিসি মুরসি সরকারকে উচ্ছেদের ঘোষণা দেন। মিসরীয়দের অনেকে নতুন মোবারককে সে সময় অভিনন্দনও জানায়।

কিন্তু আজ মিসরের নাগরিকের স্বাধীনতা বলে কিছু নেই, সিভিল সোসাইটিকে পঙ্গু করা হয়েছে এনজিওবিরোধী নতুন আইনের মাধ্যমে। মুরসির পর সিসির প্রধান প্রতিপক্ষ যিনি হতে পারতেন সেই আহমাদ তান্তাবিকে আদালতের রায়ের মাধ্যমে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। সৌদি আরবের কাছে দুটি দ্বীপ হস্তান্তরের প্রতিবাদ করায় বহু সাংবাদিক, লেখক, ব্লগার বন্দি হয়েছেন। ভিন্নমত জানাবার মতো কেউ আর মিসরে নাই।

২০১৮ সালের মতো এবারও সিসি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখাতে দু’জন প্রার্থী দাঁড় করিয়েছিলেন, যারা কেউ স্বতন্ত্র কেউবা ডামি প্রার্থী। দু’জনের কেউ ৫ শতাংশ ভোটও টানতে পারেননি। তবে তুমুল অর্থনৈতিক সংকট আর ইসরায়েলের প্রতি নতজানু নীতি নেওয়ার পরও কীভাবে সিসি প্রায় ৯০ শতাংশ ভোট পেলেন সেটি একটা রহস্য। তবে তাঁর সমর্থক গোষ্ঠী এবং সেনাবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় বাসে করে ভোটার আনা হয়েছে। ভোট দিলেই এক লিটার তেল বা এক লিটার চিনি মাগনা পাওয়া গেছে। এক মিসরীয় বিদেশি গণমাধ্যমে বলেছেন, ভোট দিয়ে যখন লাভ নাই তখন এই অভাবের দিনে যা পাচ্ছি সেটিই লাভ।

মিসরে মুদ্রাস্ফীতি এখন প্রায় ৩৩ শতাংশ। ওদিকে সরকার মরুভূমিতে নতুন রাজধানী নির্মাণের উচ্চাভিলাষী প্রকল্প চালাচ্ছে। হাতে নিয়েছে সুয়েজ খাল চওড়া করার মেগা প্রজেক্ট। এদিকে মিসরের বৈদেশিক ঋণ বেড়ে ২০২২ সালের ডিসেম্বরেই ছিল ১০৩ বিলিয়ন ডলার। ২০২৪ সাল থেকেই এ ঋণ পরিশোধ করতে হবে।

২০১৪ সালে সিসির ক্ষমতা দখলের পরে কোনো কোনো আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক বলেছিলেন, যদি সিসি মডেল টিকে যায় তাহলে আরও আরও দেশে এই মডেল রপ্তানি হবে। আরবের সবচেয়ে জনবহুল মুসলিম দেশে যদি এটি করা যায়, তাহলে একইরকম দশায় থাকা অন্য দেশেও করা গেলে যেতে পারে। ২০২৩ সালের শেষ এসে দেখা যাচ্ছে, অনুমানটি সত্য বলে ধরা দিচ্ছে।

সমকাল