এস আলমের ১ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকাই এখন কুঋণ

logo

মুদ্রিত সংস্করণ

  • মাফিয়ার কবলে ইসলামী ব্যাংকের অন্তহীন দুরবস্থা
  • শেয়ার বিক্রি করে পাওনা সমন্বয়ের উদ্যোগ নেই

৪০ বছর ধরে শ্রমিকের ঘাম ও সাধারণের আমানতে তিলে তিলে বটবৃক্ষের মতো গড়ে উঠেছিল ইসলামী ব্যাংক। রেমিট্যান্স, বৈদেশিক বাণিজ্য-বিনিয়োগ, সাধারণ বিনিয়োগে সবার শীর্ষে ছিল ব্যাংকটি। কিন্তু এস আলমের শকুনি থাবা মাত্র সাত বছরের ব্যবধানে সবকিছু এলোমেলো করে দেয়। যেখানে ৪০ বছরের বেশি সময় কার্যক্রম পরিচালনা করে এক লাখ ৪৩ হাজার কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করেছিল, সেখানে ৭ বছরেই মাফিয়া এস আলম ব্যাংকটি থেকে নামে-বেনামে হাতিয়ে নেয় এক লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমেই লুট করে ১৮ হাজার কোটি টাকা। পুরো ঋণই এখন মন্দ ঋণে পরিণত হয়েছে।

গত বছরের ৫ আগস্টের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক আদালতের মাধ্যমে এস আলমের সব শেয়ার হস্তান্তর বা বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা এনেছিল। তাও প্রায় এক বছর পার হতে যাচ্ছে। কিন্তু এস আলমের শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকের বিশাল দায় পরিশোধের কোনো উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। কেন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না তারও কোনো সদুত্তর নেই কারো কাছে। ফলে ইসলামী ব্যাংকের টাকা লুট করে বিদেশে পালিয়ে গেলেও প্রকারান্তরে ব্যাংকটির মালিকানা মাফিয়া এস আলমের হাতেই রয়ে গেছে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এটা মোটেও ব্যাংকটির জন্য নিরাপদ নয়। কারণ এস আলমের রং পাল্টাতে তেমন সময়ই লাগবে না। পরবর্তী সরকারের সময় যেকোনো উপায়ে তিনি আবার ব্যাংকটির মালিকানায় বসে যেতে পারেন। আবারো লুটপাট চালাতে পারেন বলে আশঙ্কা সবারই।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা গেছে, ইসলামী ব্যাংকের মোট শেয়ার সংখ্যা এখন ১৬১ কোটি। এর মধ্যে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ২০১৭ সালের পর ব্যাংকটির ৮১ দশমিক ৫৯ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা হাতিয়ে নেয় এস আলম। সেই হিসাবে তার দখলে রয়েছে ১৩১ কোটি ৩৫ লাখ ৯৯ হাজার শেয়ার। গত বৃহস্পতিবার পুঁজিবাজারে ইসলামী ব্যাংকের প্রতিটি শেয়ার বিক্রি হয় ৪২ টাকা। সেই হিসাবে ইসলামী ব্যাংকে এস আলমের ধারণকৃত শেয়ারের মূল্য প্রায় ৫ হাজার ৫৯৬ কোটি টাকা। অথচ এসব শেয়ার বিক্রি করে এস আলমের কাছ থেকে ব্যাংকের বিশাল দায় কিভাবে সমন্বয় করা হবে সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে না। এতে অন্তহীন দুরবস্থায় পড়েছে বেসরকারি খাতের বৃহত্তম এই ব্যাংকটি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন বিদেশী অডিট ফার্মের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর প্রকৃত আর্থিক চিত্র বের করছে। ইতোমধ্যে ৬টি ব্যাংকের আর্থিক নিরীক্ষা কাজ সম্পন্ন করেছে। এর মধ্যে ৫টি ব্যাংককে একীভূত করতে হচ্ছে। ইসলামী ব্যাংক নিজেদের অর্থেই অডিট কাজ শেষ করেছে। সর্বশেষ তথ্য মতে, ব্যাংক ডাকাত হিসেবে পরিচিত এস আলম ইসলামী ব্যাংক থেকে এক লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা নামে বেনামে লুট করেছে। এর মধ্যে অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের মাধ্যমে নিয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকা। পুরো অর্থই এখন মন্দ মানের খেলাপিতে রূপান্তরিত হয়েছে। আর এ খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকের বেশি হারে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়েছে। ফলে মুনাফার পরিবর্তে বড় অঙ্কের লোকসান গুনছে ব্যাংকটি। সাধারণ শেয়ার হোল্ডারদের মাঝে লভ্যাংশ বণ্টন করার ইতিহাসে এবারই প্রথম ব্যাংকটি কোনো লভ্যাংশ বিতরণ করতে পারেনি। নানাভাবে ব্যাংকটি এখন অস্তিত্ব রক্ষার চেষ্টা করছে।

গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে যায়। তার সাথে পালিয়ে যায় এস আলমও। বিদেশে বাড়ি-গাড়ি করে আরামে বসবাস করলেও যারা সাধারণ ব্যাংকার তারা এখন জেল খাটছেন। কেউবা দুদক ও আদালতে হাজিরা দিচ্ছেন। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, এস আলমের বিরুদ্ধে এখনই দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেয়ার উপযুক্ত সময়। তার হাতে থাকা শেয়ার বিক্রি করে ব্যাংকের দায় কিছুটা হলেও লাঘব করার উদ্যোগ নিতে হবে।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, এস আলমের দোসররা স্বপ্ন বুনছে এই মাফিয়া আবারো ব্যাংকে ফিরে আসবে। এ কারণে অনেকেই সঠিকভাবে এস আলমের ব্যাংক ডাকাতির তথ্য প্রকাশ করছে না।

সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন, এস আলমের শেয়ারগুলো অবিলম্বে বাজেয়াপ্ত করতে হবে। পাশাপাশি শেয়ারগুলো বিক্রি করে ব্যাংকের দায় সমন্বয় করতে হবে। তাহলে সাধারণ আমানতকারীদের ব্যাংকের প্রতি আস্থা পুরোপুরি ফিরে আসবে। কর্মকর্তারাও শঙ্কামুক্ত হয়ে কাজ করতে পারবেন।

এ দিকে এস আলমের শেয়ার বিক্রি করে দায় সমন্বয় করার পাশাপাশি এস আলমের পোষ্য পরিচালকদেরকেও আইনের আওতায় আনতে হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। নানা অনিয়মের মাধ্যমে অর্থ বের করে দিতে সহযোগিতা করতেন তার ভাড়াটে পরিচালকরা। প্রতিটি ঋণ অনুমোদন দেয়া হয় ব্যাংকগুলোর পর্ষদ থেকে। পর্ষদ সভা ডেকে এস আলমের ঋণের নামে ব্যাংক লুটের সহযোগিতা করা অর্থাৎ অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করা ব্যাংক পরিচালকরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন। এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ব্যাংকের নিরীহ কর্মকর্তারা। ২০১৬ সাল থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত ৩২ জন স্থানীয় পরিচালককে বসিয়েছিল এস আলম। তাদেরকে এস আলমের বিভিন্ন কোম্পানির প্রতিনিধি ও বিকল্প পরিচালক হিসেবে দেখানো হয়েছিল।

ভুক্তভোগী ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, এস আলমের সাবেক পিএস ও পরে ইসলামী ব্যাংকের ডিএমডি হিসেবে নিয়োগ পাওয়া আকিজ উদ্দিন, মিফতা উদ্দিন, কোম্পানি সেক্রেটারি জে কিউ এম হাবিবুল্লাহসহ বেশ কয়েকজন অনুগত কর্মকর্তার নির্দেশে এস আলমকে নামে-বেনামে ঋণ দেয়ার জন্য পর্ষদে নথি উত্থাপন করা হতো। কোনো রকম বাধা ছাড়াই এসব ঋণ অনুমোদন করে দিতেন পরিচালকরা।

ভুক্তভোগীদের মতে, কখনো চাকরির ভয় দেখিয়ে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে হয়রানি করার ভয় দেখিয়ে নিরীহ কিছু ব্যাংক কর্মকর্তাকে এসব ভুয়া ঋণের ফাইলে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হতো। পরিচালকরাও তাতে কোনো প্রকার আপত্তি না জানিয়ে তা অনুমোদন করে দিতেন। অথচ পরিচালকরা অনুমোদন না করলে এসব ঋণের প্রস্তাব অনুমোদন হতো না। কিন্তু পরিচালকরা এখন ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকলেও সাধারণ কর্মকর্তারা এখন দুদক ও আদালতে হাজিরা দিচ্ছেন। হচ্ছেন নানা রকম হয়রানি। তাদের মতে, পরিচালকরা কোনো প্রকার দায় এড়াতে পারেন না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here