ছাত্র নেতৃত্বের দুই দাবি কোন পথে

ছাত্র নেতৃত্বের দুই দাবি কোন পথে

রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিনকে অপসারণে শুরুতে অনড় মনোভাব দেখালেও রাজনৈতিক ঐকমত্য না হওয়ায় ছাত্র নেতৃত্বের কণ্ঠে সেই দাবি আর জোরেশোরে শোনা যাচ্ছে না। সংবিধান পুনর্লিখনের দাবিতেও রাজনৈতিক দলগুলোর সর্বসম্মত সমর্থন মেলেনি। অভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্বের এসব দাবি কোন পথে তা এখনও পরিষ্কার নয়।

আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অভ্যুত্থানকে সর্বাত্মক সমর্থন করেছিল বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ সেই সময়কার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। নাগরিক সমাজ ও সাধারণ মানুষও আন্দোলনে ব্যাপক সমর্থন জানায়। তবে হাজারের বেশি প্রাণের বিনিময়ে রক্তাক্ত এই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের তিন মাসের মধ্যে পরিস্থিতির পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। ছাত্র নেতৃত্বের সব সিদ্ধান্তে আগের মতো সমর্থন করছে না বিএনপি এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দল। এ কারণে আওয়ামী লীগ এবং এর সমর্থক দলগুলোকে নিষিদ্ধ চেয়ে করা রিট এক দিনের মধ্যে প্রত্যাহার হয়। জাতীয় পার্টি (জাপা) কার্যালয়ে হামলার সরাসরি নিন্দা না করলেও বিএনপিসহ অন্যান্য দল প্রকাশ্যে বিরক্তি দেখায়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ অবশ্য দাবি করেন, রাষ্ট্রপতিকে অপসারণে দাবি থেকে তারা সরে আসেননি। সমকালকে তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রপতিকে অবশ্যই অপসারণ করতে হবে। কিছু রাজনৈতিক দল এ দাবিতে একমত, কিছু দলের দ্বিমত রয়েছে। তাঁর অপসারণ মেনে নেবে না– সেই পরিস্থিতি আমরা দেখছি না। যদি মেনে না নেয়, সে ক্ষেত্রে আমরা যেহেতু ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে আছি, তা  চালিয়ে যাব।’

গত ২২ অক্টোবর রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে রাষ্ট্রপতির অপসারণ, ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করাসহ পাঁচ দাবি জানায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সেদিন বঙ্গভবনের সামনে বিক্ষোভ করে কয়েকটি সংগঠন। দাবি মেনে পরের দিন ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে নিষিদ্ধ করে অন্তর্বর্তী সরকার। তবে আওয়ামী লীগ আমলের বিরোধী দলগুলোকে এ সিদ্ধান্তে উচ্ছ্বাস দেখাতে দেখা যায়নি। দলগুলোর ভেতরের খবর, তারা কেউ রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের পক্ষে নয়।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘ছাত্র নেতৃত্বই সবকিছু’– এমন বার্তা যাতে মাঠে না যায় সেজন্য রাষ্ট্রপতিকে হটানোর পক্ষে নয় বিএনপিসহ কয়েকটি দল। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের দু’জন সরকারে উপদেষ্টা হয়েছেন।

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লিয়াজোঁ কমিটির মাহফুজ আবদুল্লাহ। তাদের বক্তব্যই সরকারি ভাষ্য মনে করা হয়। তবে গত কয়েক দিন রাষ্ট্রপতির অপসারণের বিষয়ে তাদের কথা বলতে শোনা যায়নি।

ছাত্র নেতৃত্বের রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’র সূত্রগুলো জানায়, বিএনপির সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টি করে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণে সায় নেই সরকারের। অনেকে মনে করেন, রাষ্ট্রপতিকে অপসারণে সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হবে বলে বিএনপি কারণ দেখালেও দলটির আশঙ্কা ছিল এর মাধ্যমে ড. ইউনূস নিজেই রাষ্ট্রপতি হতে পারেন। এর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থার দিকে যেতে পারে দেশ। বিএনপির একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমকালকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের রাষ্ট্রপতির প্রতি বিএনপির কোনো সহানুভূতি নেই। বিএনপি ক্ষমতায় গিয়েই তাঁকে সরাবে। কিন্তু ছাত্ররা তাঁকে যেভাবে সরাতে চেয়েছিলেন, সেটি হলে তারা রাষ্ট্রের সর্বেসর্বায় পরিণত হতেন, বিএনপি তা থামিয়েছে। এর মাধ্যমে বিএনপি ছাত্র নেতৃত্বকে নিজের শক্তি ও অবস্থান বোঝাতে সক্ষম হয়েছে।’

রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধিতায় রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনকে সরাতে না পারার মাধ্যমে ছাত্র নেতৃত্বই যে একমাত্র শক্তি নয়, তা প্রমাণ হয়ে গেছে বলে মনে করেন জামায়াতের এক জ্যেষ্ঠ নেতা। তিনি সমকালকে বলেন, ‘আমরা বলেছি, জামায়াত রাষ্ট্রপতিকে সরাতে রাজি। তবে এর জন্য বিএনপির সম্মতি প্রয়োজন। বিএনপি যদি রাজি হয়, তাহলে রাষ্ট্রপতিকে বঙ্গভবন ছাড়া করতে আন্দোলনে যে সহযোগিতা প্রয়োজন তা করা হবে।’

আগামী সরকারে ও সংসদে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আওয়ামী লীগবিরোধী ছোট দলগুলোকে পাশে টেনেছে বিএনপি। গণঅধিকার পরিষদের একাংশ ছাড়া ছাত্র নেতৃত্বের দাবির সঙ্গে অন্য কোনো দলকে তাই সরাসরি একাত্ম হতে দেখা যায়নি। ছাত্র নেতৃত্বে ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এবি পার্টিও রাষ্ট্রপতিকে অপসারণে আইনি পথ দেখিয়েছে।

সংবিধান প্রশ্নেও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ছাত্র নেতৃত্বের চিন্তার ফারাক দেখা যাচ্ছে। বিএনপি চায়, অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত কমিশন সংস্কারের সুপারিশ করুক, পরবর্তী নির্বাচিত সংসদ তা বিবেচনা করবে। তবে ছাত্র নেতৃত্ব ৫ আগস্ট থেকে বলে আসছে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সংবিধান অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে। ড. ইউনূসের সরকার বিদ্যমান সংবিধানের অধীনে শপথ নিলেও একে মুজিববাদী একটি দলের প্রণীত সংবিধান আখ্যা দিয়ে বাতিল করতে চাইছে ছাত্র নেতৃত্ব। সম্প্রতি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বক্তব্যে স্পষ্ট, সংবিধান বাতিলে সায় নেই দলটির। তিনি বলেছেন, ‘সংস্কার মানে বইয়ের কয়েক লাইন পরিবর্তন নয়।’

বিএনপি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ঘোষিত রাষ্ট্র সংস্কারে দলের ৩১ দফাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। সারাদেশে এর প্রচার চালাচ্ছে। বিশিষ্টজনদের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে চলতি মাসেই এসব দফা নিয়ে সেমিনার করতে পারে।

হাসনাত আবদুল্লাহ সমকালকে বলেন, ‘অভ্যুত্থানের পর নতুন বাংলাদেশে সংবিধান পুনর্লিখন চায় সবাই। কম সংখ্যক মানে দু-একটা রাজনৈতিক দল চায় পুরোনো সংবিধানকে সমুন্নত রাখতে, তাদের ঐকমত্যের জন্য কাজ করে যাব।’

জামায়াতসহ কয়েকটি দল সংসদে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে নির্বাচন প্রস্তাব করলেও বিএনপি এতে রাজি নয়। দলটি বিদ্যমান আসনভিত্তিক নির্বাচন চায়। ছাত্র নেতৃত্ব এখনও স্পষ্ট করেনি তারা কী চায়। তবে সূত্রের খবর, তারাও আনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচনের কথা ভাবছে। যদিও তাদের ভাবনায় শিগগির নির্বাচন নেই। তাদের দাবি ও তৎপরতার পেছনে অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার উদ্দেশ্য আছে কিনা, রাজনৈতিক মহলে এমন আলোচনাও উঠেছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটিকে রাজনৈতিক দলে রূপান্তরের উদ্যোগে খুব একটা গতি দেখা যাচ্ছে না। গত ২২ অক্টোবর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে চার সদস্যের কমিটি হলেও তা শিগগির পূর্ণাঙ্গ করার খবর নেই। কুষ্টিয়ার পর নড়াইলে জেলা কমিটি হয়েছে। নাগরিক কমিটিও উপজেলা থানা পর্যায়ে ‘প্রতিরোধ কমিটি’ করেছে। গত শুক্রবার যাত্রাবাড়ী এবং গতকাল শনিবার হাতিরঝিল থানা কমিটি ঘোষিত হয়েছে।

এর মাধ্যমে সংগঠন দুটি রাজনৈতিক দল গড়ার দিকে এগোচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টদের অভিমত। তবে যেমন সাড়া সংগঠন দুটি আশা করেছিল, তা পাওয়া যায়নি। তাদের কর্মসূচিতে আগের তুলনায় উপস্থিতি কম দেখা যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবি আসছে, জুলাই-আগস্টের কর্মসূচিতে ছাত্র নেতৃত্বের ডাকে লাখো মানুষের জমায়েত হলেও এখন কোথাও হাজার কোথাও শতেক মানুষের জমায়েত হচ্ছে। ফলে রাজনৈতিক দল গঠন করে আগে থেকেই মাঠে সক্রিয় দলগুলোর সঙ্গে পেরে ওঠা কতটা সম্ভব হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রাখছেন কেউ কেউ।

রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন না পেলেও আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, অভ্যুত্থানে সরব থাকা অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট পিনাকি ভট্টাচার্যসহ অনেকেই রাষ্ট্রপতির অপসারণ প্রশ্নে ছাত্র নেতৃত্বকে সমর্থন করছেন। তবে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের অনেকে একে বিভেদ সৃষ্টিকারী আখ্যা দিয়ে বিরোধিতাও করছেন।

সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহালের প্রতিবাদে গত জুলাইয়ে বিভিন্ন সংগঠনের শিক্ষার্থীরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে মাঠে নামেন। তাদের আন্দোলন দমনে অতীতের মতো শক্তি প্রয়োগের পথে যায় আওয়ামী লীগ। ১৫ জুলাই ছাত্রলীগকে দিয়ে হামলা করালে সারাদেশে প্রতিবাদে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ১৬ জুলাই আবু সাঈদসহ ছয়জনের প্রাণহানিতে আন্দোলন রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানে। ৫ আগস্ট দেশ ছাড়েন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

samakal

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here