
স্বেচ্ছাচারিতা ও দুর্নীতির অভিযোগে আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে বেনজীর আহমেদের ব্যাপক দুর্নীতিতে জড়িত থাকার বিষয়টি সাম্প্রতিক সময়ে বেশ আলোচিত। এ নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা এক ধরনের অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়েছেন। কেউ কেউ বিস্মিতও হয়েছেন।
এ পটভূমিতে আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন সমকালকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমান মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীল নীতির কথা বলে দিয়েছেন। এখন তিনি দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে আরও কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। ফলে আগামীতে আজিজ ও বেনজীরের মতো আরও কিছু ব্যক্তির অনিয়ম-দুর্নীতি সামনে আসতে পারে।
প্রায় একই তথ্য দিয়েছেন আওয়ামী লীগের আরও কয়েকজন শীর্ষ নেতা। স্পর্শকাতর বিষয় বলে তারা নিজেদের নাম প্রকাশ করতে চাননি। তবে তারা আজিজ ও বেনজীরের বিরুদ্ধে উত্থাপিত দুর্নীতির অভিযোগসহ ভারতে দলীয় এমপি আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনা নিয়ে নিজেদের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও কথা বলেছেন কেউ কেউ।
এদিকে আজিজ ও বেনজীর প্রশ্নে সরকার বিব্রত নয় বলে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দাবি করলেও দলের ভেতরের চিত্র ঠিক উল্টো বলে মনে করছেন বেশির ভাগ নেতাকর্মী। অবশ্য এ নিয়ে দলের কোনো নেতা এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়ননি। তারা এসব বিষয় বেশ সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছেন।
এ ঘটনায় দলের নেতাকর্মীর প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি জানতে চাইলে মন্তব্য করতে চাননি আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক। তবে সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, ‘আজিজ ও বেনজীরের ঘটনা আমাকে, দলকে ও সরকারকে বিব্রত করেছে। তবে আইন নিজস্ব গতিতে চলবে। শেখ হাসিনা অতীতের মতো আগামীতেও কোনো অবস্থাতেই অপরাধীকে ছাড় দেবেন না। অপরাধীকে শাস্তি পেতেই হবে।’ এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনও বলেছেন আজিজ ও বেনজীরের ঘটনায় সরকার কিছুটা বিব্রত।
আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সিমিন হোসেন রিমির মতে, দেশ ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের কথা বিবেচনায় নিয়ে সব কিছু ভালো করার চেষ্টা চলছে। এর বাইরে কোনো মন্তব্য করতে চাননি মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী। তাঁর ছোট্ট মন্তব্য, ‘সময় সব কিছুর উত্তর দেবে।’
অবশ্য দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের শুরু থেকেই বলে আসছেন, সরকারের বিচার করার সৎ সাহস আছে বলেই অপরাধ অস্বীকার করে পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়নি। বেনজীরের অবৈধ সম্পদের বিষয়ে এখনও তদন্ত হচ্ছে। আরও তদন্ত হবে। আর তদন্ত হচ্ছে মানে মামলা হলে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। অর্থাৎ কোনো অপরাধী শাস্তি ছাড়া পার পাবে না শেখ হাসিনার আমলে। আজিজ আহমেদও যদি অপরাধী হন, তাঁর বিরুদ্ধেও তদন্ত করতে পারবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অর্থাৎ অপরাধী যিনিই হোন না কেন, অপরাধী হলে অপরাধের জন্য শাস্তি পেতেই হবে।
দায়িত্বে থাকাকালে শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি– এ প্রশ্নে অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, ‘দায়িত্বে থাকাকালে আলোচিত কর্মকর্তাদের অপকর্ম প্রকাশ পায়নি। ওই সময়ে তারা দায়িত্বশীল পদে ছিলেন। ফলে অভিযোগও ছিল না।’
এ ক্ষেত্রে গোয়েন্দা সংস্থার কার্যক্রম নিয়েও মৃদু প্রশ্ন তুলেছেন আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা। তাদের দৃষ্টিতে, বেনজীরের ঘটনার মাধ্যমে একটি বিষয় উন্মোচিত হয়েছে যে তাঁর বেপরোয়া দুর্নীতি এক দিনে হয়নি। অথচ একজন সরকারি কর্মকর্তা কী করছেন না করছেন, সে বিষয়ে খোঁজ-খবর নেওয়ার জন্য একাধিক দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা রয়েছে। এ সংস্থাগুলো যথাযথভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারেনি বলে সরকারি দলের নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন। যার দায়দায়িত্ব এসে পড়েছে সরকারের ওপর। এ কারণে এখন থেকে যখন ব্যক্তিকে শীর্ষ পদে বসানো হবে, তখন তাঁকে ক্রমাগত এবং ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করা হবে। সেই সঙ্গে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি তাঁর দায়িত্ব পালনের সময় দুর্নীতি বা অনিয়ম করছেন কিনা তা নিয়মিত নিবিড় পর্যবেক্ষণ করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। যাতে ভবিষ্যতে দায়িত্বপ্রাপ্ত কেউ আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে উঠতে না পারেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া যাবে, তাদের বিরুদ্ধে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত করা হবে। কে কোন পদে রয়েছেন, কে কার আত্মীয় কিংবা কার কী পরিচয়, এ সবের কিছুই বিবেচনায় নেওয়া হবে না। এ অনুসন্ধানের মাধ্যমেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সেই সঙ্গে দুদকের কোনো পর্যায়ে কেউ যাতে প্রভাব বিস্তার করতে না পারে, সেদিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখা হবে। এ বিষয়ে কোনো হস্তক্ষেপ মেনে নেওয়া হবে না। কোনো এমপি কিংবা সরকারের কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তি যেন কারও জন্য তদবির করতে না পারেন, তাও নিশ্চিত করা হবে। সেই সঙ্গে প্রশাসন ও সরকারের বিভিন্ন উচ্চপদে যারা আছেন, তাদের আয়ের উৎস কী, তাদের সম্পদের বিস্তারিত বিষয় সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে তথ্য সংগ্রহ করা হবে।
samakal