তপশিল ঘোষণার পর নাটোরের সিংড়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদের পাঁচ সম্ভাব্য প্রার্থী গণসংযোগ শুরু করেন। নির্বাচন নিয়ে সাধারণ ভোটারদের মধ্যেও শুরু হয় আলোচনার ঝড়। কে কার চেয়ে যোগ্য, তা নিয়ে বিশ্লেষণ চলতে থাকে পথে-ঘাটে, চায়ের দোকানে। কিন্তু কিছুদিন পর হঠাৎ চুপ চার সম্ভাব্য প্রার্থী। সেই সঙ্গে কমে যায় নির্বাচন নিয়ে বিশ্লেষণও। মাঠে ঘুরতে থাকেন শুধু এক প্রার্থী– লুৎফুল হাবীব রুবেল। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও শেরকোল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। তাঁর আরেকটি পরিচয়, তিনি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী ও নাটোর-৩ আসনের এমপি জুনাইদ আহমেদ পলকের শ্যালক।
এলাকাবাসী বলছেন, নিজের শ্যালককে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতাতেই তিন প্রার্থীকে নির্বাচন না করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। সেজন্য একজনকে পুকুরও উপহার দিয়েছেন। আরেক সম্ভাব্য প্রার্থী দেলোয়ার হোসেন পাশা শেষ সময়ে এসে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ায় রুবেলের লোকজন তাঁকে তুলে নিয়ে মারধর করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তিনি এখন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাঁকে তুলে নেওয়ার ঘটনার ভিডিও ফুটেজেও পলক ও রুবেলের ঘনিষ্ঠজনকে দেখা গেছে। এ ঘটনায় মামলার পর রুবেলের দুই অনুসারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
শ্যালককে বিজয়ী করতে পলকের বাসায় বৈঠক
নির্বাচনী এলাকা সিংড়া উপজেলা নিয়ে গঠিত নাটোর-৩ আসন। এই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদের প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়ে গণসংযোগ শুরু করেছিলেন উপজেলা পরিষদের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি কামরান হাসান কামরুল, উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও চৌগ্রাম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহেদুল ইসলাম ভোলা, উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ লুৎফুল হাবীব রুবেল, পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন ও কলম ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সদস্য দেলোয়ার হোসেন পাশা।
এর মাঝে গত ২৯ মার্চ ভোলাকে ঢাকায় প্রতিমন্ত্রী পলকের বাসায় ডেকে নেওয়া হয়। সেই বৈঠক থেকে তাঁর শ্যালক রুবেলকে একক প্রার্থী করার সিদ্ধান্ত হয়। তাঁকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী করতেও নির্দেশনা দেওয়া হয়। সেখান থেকে ফিরে আসার পর ভোলা যেন বোবা হয়ে যান। তিনি নির্বাচনে আছেন কিনা, তা জানার জন্য সাংবাদিকরা একাধিকবার তাঁর মোবাইল ফোনে কল করেছেন। কিন্তু তিনি কোনো সাড়া দেননি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভোলার এক সমর্থক সমকালকে জানান, প্রথমে হুমকি এবং পরে অর্থের লোভ দেখিয়ে ভোলাকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য করা হয়। এজন্য তাঁকে প্রায় কোটি টাকার মূল্যের একটি পুকুর উপহার দেওয়া হয়েছে।
এদিকে ২৯ মার্চ বৈঠকের একটি ছবি সমকালের কাছে এসেছে। এতে দেখা যায়, সোফায় পাঁচজন বসে আছেন। পলকের ডান পাশে সিংড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র জান্নাতুল ফেরদৌস এবং লুৎফুল হাবীব রুবেল। বাঁ পাশে আরিফুল ইসলাম, মাওলানা রুহুল আমিন ও জাহিদুল ইসলাম ভোলা।
বৈঠকের সত্যতা স্বীকার করেছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ওহিদুর রহমান শেখ এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র জান্নাতুল ফেরদৌস। ওহিদুর রহমান বলেন, অসুস্থতার জন্য তিনি বৈঠকে থাকতে পারেননি। তবে সমঝোতা বৈঠকে রুবেলকে একক প্রার্থী করা হয়।
মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ায় দেলোয়ারের ওপর ক্ষোভ
একটি সূত্র জানায়, সব ঠিক ঠিক চলছে ভেবে তপশিল ঘোষণার পর রুবেলকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত করার লক্ষ্যে ঈদের আগেই তাঁর মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া হয়। তবে সোমবার দেলোয়ার মনোনয়নপত্র জমা দিলে রুবেলসহ তাঁর ঘনিষ্ঠজনের স্বপ্নভঙ্গ হয় এবং তারা ক্ষুব্ধ হয়ে হয়ে ওঠেন। এর জেরে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে থেকে দেলোয়ারকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে নির্যাতন করেন।
এ ঘটনার কিছু সময় আগে দেলোয়ার নাটোরে গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে অভিযোগ করেছিলেন, একই এলাকা থেকে তাঁর বড় ভাই কলম ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এমদাদুল হক ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলাউদ্দীন মুন্সিকে অপহরণ করা হয়েছে।
দেলোয়ারের চাচাতো ভাই আছের উদ্দীন ব্যাপারী সমকালকে বলেন, ‘সোমবার মনোনয়নপত্র জমার শেষ দিন ছিল। তাকে থামাতে প্রথমে দেলোয়ারের বড় ভাই এমদাদুলকে তুলে নিয়ে আটকে রাখে, ছোট ভাই কোথায় জানতে চায়। ছোট ভাইকে পাওয়ার পর এমদাদুলকে ছেড়ে দেয়। তখন দেলোয়ারকে নিয়ে যায়। সন্ধ্যায় একটি গাড়িতে করে তাঁকে নিয়ে এসে ড্রাইভার বলে– আপনার ভাইয়ের মুখ দিয়ে ফেপড়ি (ফেনা) বের হচ্ছে, তাঁকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যান।’
আছের উদ্দীন আরও বলেন, ‘লুৎফুল হাবীব রুবেল ভাইয়ের নির্দেশেই তাঁকে তুলে নিয়ে মারধর করা হয়েছে। প্রতিমন্ত্রী পলকের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত মোহন আলীর নেতৃত্বে পাশাকে অপহরণ করা হয়।’
সোমবার রাতে অচেতন অবস্থায় দেলোয়ারকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। সকালে তাঁর জ্ঞান ফিরলে দুপুরে ৮ নম্বর ওয়ার্ডের বেডে পাঠানো হয়। তাঁর বড় ভাই এমদাদুল হক বলেন, ‘আমার ভাই প্রার্থী হয়েছে– এটাই অপরাধ। আওয়ামী লীগের লোকেরাই তাকে তুলে নিয়ে নির্যাতন করেছে।’
দেলোয়ারকে তুলে নিয়ে মারধরের ঘটনায় অজ্ঞাতপরিচয় ২০ জনকে আসামি করে নাটোর সদর থানায় মামলা করেছেন বড় ভাই মজিবর রহমান। পুলিশ এ ঘটনায় দু’জনকে গ্রেপ্তার করেছে। তারা হলেন– শেরকোল ইউনিয়ন যুবলীগের সদস্য নাজমুলক হক বাবু ও সুমন আহমেদ।
সিসিটিভি ফুটেজে যা দেখা গেল
এদিকে দেলোয়ারকে অপহরণের ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজে প্রতিমন্ত্রী পলকের কয়েক ঘনিষ্ঠজনকে দেখা গেছে। তাঁর অনুসারী সিংড়া উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহন আলীকে পাঞ্জাবি পরা অবস্থায় ঘটনার সময় জেলা নির্বাচন কার্যালয়ের নিচতলায় সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। উপজেলার শেরকোল ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মজনু তালুকদারকে অপহরণে ব্যবহৃত মাইক্রোবাসের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। হলুদ পাঞ্জাবি পরেছিলেন যুবলীগ কর্মী রিফাত মাহমুদ পিয়াস। গেঞ্জি পরেছিলেন কলম ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হোসেন কাজল। গেঞ্জি ও জিন্স পরেছিলেন যুবলীগ কর্মী নাহিদ পারভেজ স্মরণ। লুৎফুল হাবীবের ব্যক্তিগত সহকারী জাহিদ হাসানকে সাদা গেঞ্জি ও জিন্স প্যান্ট পরে অপহরণে অংশ নিতে দেখা যায়।
এ ছাড়া সেখানে উপস্থিত ছিলেন শেরকোল ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি সেতু সরকার, সিংড়া মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুস সাত্তার, উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদস্য আনোয়ার হোসেন, পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার বাবু ও শেরকোল ইউনিয়ন যুবলীগের সাবেক সভাপতি সানোয়ার হোসেন। এ ছাড়া রুবেলের গাড়িচালক সুজনকে কালো গেঞ্জি পরে অপহরণের কাজে ব্যবহৃত কালো মাইক্রোবাসটি চালিয়ে নিয়ে যেতে দেখা যায়।
তবে লুৎফুল হাবীব রুবেল বলেন, ‘দেলোয়ারকে কারা তুলে নিয়ে গেছে, কারা মারধর করছে, তা আমার জানা নেই।’ ভিডিও ফুটেজে ঘনিষ্ঠদের জড়িত থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তারা কেন করেছে আমি জানি না।’
সার্বিক বিষয়ে কথা বলতে জুনাইদ আহমেদ পলকের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘স্যার সিঙ্গাপুরে গেছেন।’
সিংড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, নির্বাচনকে ঘিরে দলীয় ঐক্য অক্ষুণ্ন রাখতে এবং কোনো ধরনের সংঘর্ষ বা বিভাজন এড়াতে প্রতিমন্ত্রীর নির্দেশনা পেয়ে আমরা কয়েক দফা বৈঠক করি। শেষমেশ ২৯ মার্চ ভোলা ও রুবেলের উপস্থিতিতে প্রতিমন্ত্রীর বাসায় বৈঠক হয়। বৈঠকে প্রার্থীদের সম্মতিতে একক প্রার্থীর সিদ্ধান্ত হয়। ভোলা নির্বাচন না করার ঘোষণা দিয়ে রুবেলকে সমর্থন জানান। আমরা চাই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হোক। দেলোয়ার নির্বাচন করবেন, তাতে বাধা দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
সদর থানার ওসি মিজানুর রহমান জানান, দেলোয়ারের ভাই মামলা করেছেন। ঘটনায় ব্যবহৃত মাইক্রোবাসের নম্বর ও মালিকানার তথ্য এবং ঘটনার ভিডিও ফুটেজ পুলিশের হাতে এসেছে। আসামিদের শনাক্ত করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
samakal