সন্দেহজনক ঋণের তথ্য পাঁচ শতাধিক

সন্দেহজনক ঋণের তথ্য পাঁচ শতাধিক.

ব্র্যান্ডশেয়ার ট্রেডিং নামসর্বস্ব একটি কোম্পানি। প্রতিষ্ঠানটির অনুকূলে গত বছর ৩৫০ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন করে এবি ব্যাংক। মোহাম্মদ আতাউর রহমান ও মো. মামুন রশিদ নামে দুই ব্যক্তিকে মালিক সাজিয়ে এ ঋণ অনুমোদন করানো হয়। তারা দু’জন মূলত নির্মাণ খাতের কোম্পানি ইনফ্রাটেক কনস্ট্রাকশনের কর্মচারী। আর ঋণের প্রকৃত সুবিধাভোগী ছিলেন ইনফ্রাটেক কনস্ট্রাকশনের মালিক মোহাম্মদ আলী হায়দার রতন। তিনি পাঁচ ব্যাংকে ৬০৯ কোটি টাকার ঋণখেলাপি। ঋণ অনুমোদন হলেও একটি অভিযোগের ভিত্তিতে ঋণছাড় আটকে দেয় বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। এ রকম বেনামি ও ভুয়া ঋণ, ঋণের টাকা পাচার, প্রভাব খাটিয়ে ঋণসহ গত অর্থবছরের সন্দেহজনক ঋণের ৫২০টি ঘটনা জানতে পেয়েছে বিএফআইইউ। এক বছর আগের তুলনায় যা ৫২ দশমিক ৪৯ শতাংশ বেশি।
গতকাল মঙ্গলবার প্রকাশিত বিএফআইইউর ২০২২-২৩ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে এ বিষয়ে পরিসংখ্যান রয়েছে। প্রতিবেদনটি প্রকাশ উপলক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংকের সভাকক্ষে সাংবাদিকদের সঙ্গে  মতবিনিময় করেন বিএফআইইউর কর্মকর্তারা। বিএফআইইউর প্রধান মো. মাসুদ বিশ্বাস সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। প্রতিবেদন উপস্থাপনা করেন বিএফআইইউর অতিরিক্ত পরিচালক কামাল হোসেন।
এক প্রশ্নের জবাবে মাসুদ বিশ্বাস বলেন, বিদেশে যারা জমি-ফ্ল্যাট কিনেছে, তাদের নিয়ে দুদক কাজ করছে। বিভিন্ন সময়ে অর্থ পাচারের কিছু মামলাও হয়েছে। অন্যদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে। তিনি বলেন, দেশ থেকে একশ টাকা পাচার হলে তার ৮০ টাকাই হয়ে থাকে বাণিজ্যের আড়ালে। আন্ডার ইনভয়েসিং বা ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে বাইরে অর্থ নেওয়া হয়। বাণিজ্যের আড়ালে পাচার ঠেকাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি জোরদার করা হয়েছে। এখন এলসি ধরে ধরে দর যাচাই করার কারণে বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচার অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, একবার অর্থ পাচার হলে তা ফেরত আনা অনেক কঠিন। এখন পর্যন্ত সিঙ্গাপুর থেকে কেবল আরাফাত রহমান কোকোর টাকা ফেরত আনা সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, বিদেশের ইন্টেলিজেন্স ইউনিট থেকে সব সময় তথ্য পাওয়া যায় না। এ জন্য ১০ দেশের সঙ্গে এমওইউ করার প্রক্রিয়া চলছে। পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনতে শক্ত রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার বলে তিনি মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, যারাই ডেসটিনি করেছিল, তারাই আবার দুবাই-সিঙ্গাপুর থেকে এফএটিএফ করেছিল। জড়িতদের ধরতে দুবাই ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে অনুরোধ করার পর পালিয়ে আরেক দেশে চলে গেছে।

৫২০টি সন্দেহজনক ঋণের রিপোর্টিং
প্রতিবছর সন্দেহজনক লেনদেনের রিপোর্টের সংখ্যা প্রকাশ করলেও প্রথমবারের মতো ঋণ-সংক্রান্ত সন্দেহজনক রিপোর্টের তথ্য প্রকাশ করেছে বিএফআইইউ। গত অর্থবছর ৫২০টি সন্দেহজনক ঋণের তথ্য বিএফআইইউর কাছে এসেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে সন্দেহজনক ঋণের রিপোর্টিং হয়েছিল ৩৪১টি। তার আগে কোনো এক অর্থবছরে সন্দেহজনক রিপোর্টের সংখ্যা একশ ছাড়ায়নি। ২০২০-২১ অর্থবছরে ঋণসংক্রান্ত সন্দেহজনক রিপোর্ট হয়েছিল ৯৮টি। তার আগের অর্থবছর ছিল ৯৪টি এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ছিল ৫৯টি।
সন্দেহজনক ঋণের রিপোর্টিং বৃদ্ধির বিষয়টি এমন এক সময়ে প্রকাশ করা হলো, যখন বেনামে ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচারসহ বিভিন্ন অভিযোগ সামনে আসছে। আর্থিক খাত সংস্কার ও খেলাপি ঋণ কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্প্রতি যে পথনকশা দিয়েছে, সেখানেও বেনামি ঋণ তদারকি জোরদারের কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া গত সোমবার বাম গণতান্ত্রিক জোট বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান ফটকে বিক্ষোভ সমাবেশ করে অর্থ পাচারকারী ও ঋণখেলাপিদের তালিকা প্রকাশ এবং পাচার করা অর্থ ফেরত আনার দাবি জানিয়েছে।
বিএফআইইউর অতিরিক্ত পরিচালক কামাল হোসেন বলেন, ঋণ নিয়ে দেশের বাইরে পাচারের সন্দেহ হলে তা কীভাবে চিহ্নিত করতে হবে, সে বিষয়ে ব্যাংকগুলোতে সচেতনতা বাড়ানো হয়েছে। যে কারণে এ ধরনের সন্দেহজনক ঋণের রিপোর্টিং অনেক বেড়েছে। এর মধ্যে ঋণ নিয়ে পাচারের সন্দেহ, এক খাতের নামে ঋণ নিয়ে আরেক খাতে ব্যবহার এবং তহবিল স্থানান্তরের মাধ্যমে ইচ্ছাকৃত খেলাপি-সংক্রান্ত রিপোর্ট আছে। পাশাপাশি নিয়ম না মেনে ঋণ প্রক্রিয়া করার পর্যায়েও রিপোর্ট পেয়ে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার ঘটনা রয়েছে। একটি ব্যাংক ঋণ অনুমোদনের পরও বিএফআইইউর কারণে গত বছর ছাড় করতে পারেনি।

সন্দেহজনক লেনদেন রিপোর্টিং বেড়েছে ৬৫%
বিএফআইইউর তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে সব মিলিয়ে মোট সন্দেহজনক লেনদেন রিপোর্টিং হয়েছে ১৪ হাজার ১০৬টি। আগের অর্থবছরের তুলনায় যা ৫ হাজার ৫৩৫টি বা প্রায় ৬৫ শতাংশ বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরে এ ধরনের রিপোর্টিং হয়েছিল ৫ হাজার ২৮০টি। তার আগের অর্থবছর ৩ হাজার ৬৭৫টি এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩ হাজার ৫৭৩টি। মানি লন্ডারিং, ঘুষ বা অন্য কোনো অবৈধ লেনদেন, সন্ত্রাসে অর্থায়নসহ যে কোনো লেনদেন সন্দেহজনক মনে হলে বিএফআইইউতে রিপোর্ট করতে হয়। ব্যাংক-বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, এমএফএস, এনজিও, স্বর্ণের দোকানসহ আর্থিক লেনদেন হয় এ রকম সব প্রতিষ্ঠানই বিএফআইইউতে রিপোর্ট করতে পারে। ব্যক্তি পর্যায় থেকেও সন্দেহজন লেনদেনের তথ্য জানানো যায়। যদিও বেশির ভাগ রিপোর্টই আসে ব্যাংক থেকে।
গত অর্থবছরে ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে সন্দেহজনক রিপোর্টিং হয়েছে ১২ হাজার ৮০৯টি। মোট রিপোর্টের যা প্রায় ৯১ শতাংশ। বাকি রিপোর্ট এসেছে অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে। তবে সব সন্দেহজনক কার্যক্রমই যে রিপোর্টিংয়ের আওতায় এসেছে, তেমন নয়। আবার সন্দেহজনক রিপোর্টিং বৃদ্ধি মানেই সবক্ষেত্রে বেআইনি বা বিধিবহির্ভূত কিছু ঘটেছে, তাও নয়। এসটিআরের পাশাপাশি গত অর্থবছরে নগদ জমা রিপোর্টিং (সিটিআর) হয়েছে ২২ হাজার ৮৫৯টি। আগের অর্থবছরে যা ছিল ২১ হাজার ১১৩টি। ১০ লাখ বা এর বেশি অঙ্কের যে কোনো লেনদেন হলে সিটিআর হিসেবে বিএফআইইউকে জানাতে হয়।
বিএফআইইউর প্রধান মাসুদ বিশ্বাস বলেন, সন্দেহজনক লেনদেন বৃদ্ধি মানেই অর্থনীতিতে সন্দেহজনক কার্যক্রম বেড়েছে, তেমন নয়; বরং রিপোর্ট প্রদানকারী সংস্থার মধ্যে সচেতনতা এবং বিএফআইইউর তৎপরতার কারণে এ ধরনের রিপোর্টিং বেড়েছে। একটি সময় ব্যাংকারসহ বিভিন্ন পর্যায় থেকে মনে করা হতো রিপোর্ট করে বিপদে পড়তে হবে। তবে বিএফআইইউ বোঝাতে সক্ষম হয়েছে রিপোর্টদাতার নাম ও পরিচয় গোপন রাখা হয়। এখন ওয়েবসাইটের মাধ্যমেও যে কোনো তথ্য জানানো যায়। এসব কারণে রিপোর্টের সংখ্যা বাড়ছে।

আন্তঃসংস্থার তথ্যবিনিময়ে বেশির ভাগই নিচ্ছে পুলিশ
বিএফআইইউর কাছ থেকে বিভিন্ন সংস্থা গোয়েন্দা রিপোর্ট চেয়ে আবেদন করে। গত অর্থবছর এ ধরনের ১ হাজার ৭১টি আবেদন এসেছিল। আবেদনের মধ্যে ৬৮০টি আসে পুলিশের কাছ থেকে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে ৯৫টি, দুদক থেকে ৬৪টি, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ২৩টি এবং অন্যান্য সরকারি সংস্থা থেকে আসে ২০৯টি আবেদন। মূলত ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেন, অনলাইন গেমিং, বেটিং, হুন্ডিসহ বিভিন্ন তথ্যবিনিময় হয়েছে। যে কারণে পুলিশের তথ্য নেওয়ার সংখ্যা বেশি।

বিদেশের সঙ্গে তথ্যবিনিময় কমেছে
গত অর্থবছরে সন্দেহজনক লেনদেন রিপোর্টিং বাড়লেও বিদেশের সঙ্গে তথ্যবিনিময় অনেক কমেছে। গত অর্থবছরে বিভিন্ন দেশে তথ্য চেয়ে ৯০টি আবেদন পাঠানো হয়। আগের অর্থবছরে যা ছিল ১০৩টি। ২০২০-২১ অর্থবছরে ছিল ১৯১টি। আর গত অর্থবছরে বাংলাদেশে অন্য দেশের আবেদন এসেছে ২২টি। আগের বছর যা ছিল ২৬টি; ২০২০-২১ অর্থবছরে এসেছিল ২২টি।
বিএফআইইউর প্রধান বলেন, অর্থ পাচারের তথ্য চেয়ে আবেদন করলেও অনেক দেশ সাড়া দেয় না। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের ৮১টি এফআইইউর সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই (এমওইউ) করা হয়েছে। আরও ১০টি দেশের সঙ্গে তথ্যবিনিময়ের এমওইউ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, বিএফআইইউ যখন যে ঘটনা জানতে পারে, সে বিষয়ে কাজ করে। তবে আন্তর্জাতিক সংস্থার বিধিনিষেধের কারণে অনেক তথ্য প্রকাশ করতে পারে না।

অর্থ পাচারের ৫৯ মামলা চলমান
বিএফআইইউ অর্থ পাচার ও মানি লন্ডারিং বিষয়ে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদান করলেও মামলা করতে পারে না। তবে কোনো অ্যাকাউন্টে অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পেলে তা ফ্রিজ করতে পারে। বিএফআইইউর তথ্যের ভিত্তিতে মামলা করে থাকে অন্যান্য সরকারি সংস্থা। এখন পর্যন্ত বিএফআইইউর সন্দেহজনক তথ্যের ভিত্তিতে অর্থ পাচার-সংক্রান্ত ৫৯টি মামলা আদালতে চলমান। এর মধ্যে ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ পাচার-সংক্রান্ত দুদকের করা ৪৭টি মামলা বিচারাধীন। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের ১০টি মামলা চলমান। এ ছাড়া রাজস্ব ফাঁকির মাধ্যমে অর্থ পাচার-সংক্রান্ত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর (সিআইইডি) এবং কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি) একটি করে মামলা করেছে।

samakal