অর্থনৈতিক মন্দার কারণে যেখানে অনেক ব্যবসায়ী নতুন বিনিয়োগ করতে দ্বিধাগ্রস্ত, আকিজ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম শেখ আকিজ উদ্দিনের উদ্যোগী ছেলেরা প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশের পাট শিল্পে অর্থ ঢেলে যাচ্ছেন।
আকিজ ভাইদের মধ্যে কনিষ্ঠ শেখ বশির উদ্দিন গত তিন বছরে এই খাতে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। এখন তার বড় ভাই, আকিজ গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং আকিজ জুট মিলের মালিক শেখ নাসির উদ্দিন আরো প্রায় ২,৫০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ নিয়ে এগিয়ে এসেছেন।
গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলায় একটি পাটকল তৈরিতে এই বিপুল অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে। প্রস্তৃত হলে এটিই হবে বিশ্বের বৃহত্তম পাটকল।
৪৫০ বিঘা জুড়ে বিস্তৃত পাটকলটিতে ছয়টি কারখানা থাকবে। প্রতিটি কারখানা গড়ে ওঠেছে ১ লাখ ৭৫ হাজার বর্গফুটজুড়ে।
আকিজ জুটের পরিচালক (অপারেশন) জি মুর্শিদ বাপ্পি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে (টিবিএস) বলেন, প্রতিদিন ৬০০ টন উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন পাটকলটি হবে ‘বিশ্বের বৃহত্তম জুট কম্পোজিট টেক্সটাইল মিল’।
তিনি আরো বলেন, আমরা মিলটিতে পাটের কাপড় উৎপাদনের দিকে মনোযোগ দিচ্ছি। এছাড়াও, আমাদের লক্ষ্য হল এই কাপড়গুলিতে প্রিন্ট করা, যা সাধারণত সুতির কাপড়ে দেখা যায়।
পাটশিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা বলছেন, এই কৌশলগত পদক্ষেপগুলি আকিজ ভাইদের পাট খাতে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসাবে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বাংলাদেশের মোট পাট উৎপাদনের প্রায় ৫০ শতাংশ হয় তাদের মিলগুলি থেকে।
২০২০ সাল থেকে, আকিজ গ্রুপের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ বশির উদ্দিন- আকিজ বশির গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা – পাট শিল্পে উল্লেখযোগ্য অধিগ্রহণ শুরু করেন। তিনি জনতা জুট মিলস এবং সাদাত জুট মিলস ক্রয় করেন, যার সম্মিলিত ব্যয় ৭০০ কোটি টাকারও বেশি। তিনি পারটেক্স গ্রুপ থেকে পারটেক্স জুট মিলসও কিনেছেন প্রায় ৫০০ কোটি টাকা দামে। এখানেই শেষ নয়, তিনি তার মিলের আধুনিকীকরণ এবং পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে পাটে বিনিয়োগ অব্যাহত রাখেন।
আকিজ বশির গ্রুপের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা হেলাল আহমেদ, যিনি গ্রুপের পাট ব্যবসা দেখাশোনা করেন, তিনি বলেন, বর্তমানে তারা জনতা, পারটেক্স এবং সাদাত জুট মিলের উৎপাদন দিয়ে বাজারের শীর্ষস্থানে আছেন।
আকিজ গ্রুপে ৩৫ বছর ধরে কাজ করছেন হেলাল এবং পাট খাতে তার ব্যাপক অভিজ্ঞতা রয়েছে। তিনি বলেন, ২০২০ সালের জুনে দায়িত্ব নেওয়ার পর জনতা পাটকলের সক্ষমতা বৃদ্ধি এব্ং বৈচিত্র্য আনতে আমরা বিনিয়োগ করেছি।
নাসির এবং বশিরের প্রচেষ্টার পাশাপাশি, তাদের ভাই শেখ আফিল উদ্দিন কয়েক বছর ধরে সফলভাবে আফিল জুট উইভিং মিলস চালাচ্ছেন। তার মিলটি পাটের বস্তার বৃহত্তম সরবরাহকারী, যা দেশে চাল এবং আলু প্যাকেজিংয়ের জন্য ব্যবহৃত হয়।
লক্ষণীয়ভাবে, তারা শুধুমাত্র তাদের কার্যক্রমকে প্রসারিতই করেননি বরং একই ধরনের পাটজাত পণ্য উৎপাদনে নিজেদের প্রতিযোগীর অবস্থানে দাঁড় করিয়েছেন।
যদিও বশির ও নাসিরের নজর রপ্তানি বাজারের দিকে। আর আফিল স্থানীয় বাজারে কাজ করেন।
বর্তমানে, চাল, আটা, আলু, ডাল, পেঁয়াজ এবং হাঁস-মুরগি এবং ফিশ ফিড সহ ১৩টি পণ্য বাধ্যতামূলক পাটের প্যাকেজিং নিয়মের আওতায় রয়েছে। তবে পাট শিল্পের অভ্যন্তরীণ সূত্রে জানা গেছে, এ নিয়ম যথাযথভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে না।
আফিল জুট উইভিং মিলসের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, যদি বাধ্যতামূলক প্যাকেজিং নিয়ম পরিপূর্ণভাবে অনুসরণ করা হয়, তাহলে স্থানীয় বাজারে পাটের চাহিদা বছরে বর্তমানের দুই লাখ টন থেকে দ্বিগুণ হবে।
বাংলাদেশের পাট শিল্প
বাংলাদেশে বছরে ১১-১২ লাখ টন পাট উৎপাদন হয়। যার মধ্যে দুই লাখ টন কাঁচা পাট সরাসরি রপ্তানি করা হয় এবং আরও দুই লাখ টন স্থানীয়ভাবে ব্যবহার করা হয়। বাকি সাত লাখ টন ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন পণ্য বিশেষ করে বিশ্ববাজারে রপ্তানির জন্য সুতা তৈরিতে।
বাংলাদেশ ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৯১২ মিলিয়ন ডলার মূল্যের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করেছে, যা এক বছর আগের তুলনায় ১৯ শতাংশ কম। এই রপ্তানি আয়ের মধ্যে, প্রায় ৫০০ মিলিয়ন এসেছে সুতা থেকে। যা এক বছর আগের তুলনায় ২৮ শতাংশ কম।
রপ্তানিকারকরা পাট রপ্তানি হ্রাসের জন্য বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দাকে দায়ী করেছেন। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের পাটের সুতার সবচেয়ে বড় বাজার তুরস্কে রপ্তানি উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। দুই লাখ টন থেকে এখন প্রায় এক লাখ টনে নেমেছে।
ইরান, ভারত ও চীনের মতো অন্যান্য বড় বাজারেও রপ্তানি কমছে। তারা বলেন, কাঁচা পাটের উচ্চ মূল্য- প্রতি মণ ৬,০০০ টাকা- দুই বছর আগে অনেক ক্রেতাকে পাটজাত পণ্যের বিকল্প খুঁজতে বাধ্য করেছে।
আকিজ ভাইয়েরা এগিয়ে যাচ্ছেন
প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পেরে বিশেষ করে ছোট অনেক মিল যখন গত কয়েক বছরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, আকিজ গ্রুপের ভাইয়েরা এই খাতে এগিয়ে যাচ্ছেন।
শিল্প সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গত কয়েক বছরে উৎপাদন খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে, এই সময় আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমে গেছে। যার ফলে ছোট মিলগুলো বন্ধ হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মতে, দেশের ৮০টি পাটকলের মধ্যে ১২টি পুরোপুরি বন্ধ এবং এক ডজনেরও বেশি কারখানা টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করছে।