আবু তাহের খান
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সিঙ্গাপুর যেখানে মধ্যপ্রাচ্য ও অন্যান্য দেশ থেকে অপরিশোধিত তেল এনে তা পরিশোধনের মাধ্যমে বিদেশে রফতানি করে কোটি কোটি ডলার উপার্জন করছে, সেখানে বাংলাদেশ কেন শুধু তার নিজস্ব চাহিদার অংশটুকুও নিজেরা পরিশোধন করতে পারছে না? জবাবটি খুবই সহজ। বাংলাদেশ গত ৫২ বছরেও দেশে নতুন কোনো তেল পরিশোধনাগার স্থাপন করেনি বা স্থাপনের কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি। বরং ছিটেফোঁটা যেসব উদ্যোগ নেয়ার চেষ্টা হয়েছে, উদ্দেশ্যমূলকভাবে ও গোষ্ঠীস্বার্থে অপপ্রভাব প্রয়োগ করে অতিসূক্ষ্ম কৌশলে সেগুলোকে থামিয়ে দেয়া হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে অধ্যাপক মইনুল ইসলাম তার একাধিক লেখার মাধ্যমে বিষয়টির প্রতি সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ক্যাপাসিটি চার্জ সংবলিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগকে যে কারণে থামিয়ে রাখা যায়নি, সেই একই কারণে সচল করা যায়নি জ্বালানি তেল পরিশোধনাগার স্থাপনের উদ্যোগকেও। ধারণা করা যায়, আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের আগে শতচেষ্টায়ও তা আর সচল করা যাবে না। আর অর্থনীতির প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে এ ধরনের নানামাত্রিক মডেলের উপস্থিতির কারণেই বিভিন্ন পর্যায় থেকে বহুবার এ প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে যে কথিত উন্নয়ন কতটা টেকসই হবে এবং তা সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের কতটা উপকারে আসছে? যে উন্নয়নের জন্য অগ্রিম আইনি দায়মুক্তির উদ্যোগ নিতে হয়, সেটি যে স্বচ্ছতাপূর্ণ উন্নয়ন হবে না এবং তা যে সাধারণ মানুষের স্বার্থরক্ষার চেয়ে গোষ্ঠীবিশেষকে অধিকতর লাভবান করবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। আর গত ৫২ বছরে দেশে এক ফোঁটা বাড়তি তেল পরিশোধনের ক্ষমতাও তৈরি হলো না, এটি সেই লাভচর্চারই অংশ।
সিঙ্গাপুর যে পরিশোধিত জ্বালানি তেল রফতানির ক্ষেত্রে এতটা এগিয়ে থাকতে পারল, সেটি বহুলাংশে তার ব্যবসায়িক বুদ্ধি ও কৌশলের কারণে অবশ্যই। তবে এর পেছনে তাদের নিজস্ব গভীর সমুদ্রবন্দর থাকাটাও একটি বড় কারণ। এ নাব্য-গভীরতার কারণেই বিপুল পরিমাণ তেল ধারণক্ষমতাসম্পন্ন বিশালাকৃতির মাদার ভেসেলগুলো সেখানে খুব সহজেই ভিড়ে যেতে পারে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে এ ধরনের গভীর সমুদ্রবন্দর না থাকলেও চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের বর্তমান অবস্থানকে ব্যবহার করেও দক্ষিণ এশিয়ার সমুদ্রবন্দরবিহীন দেশগুলোকে এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্য ও চীনের ইউনান প্রদেশকে বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশও একটি পরিশোধিত জ্বালানি তেলের ছোটখাটো রফতানিকারক দেশ হয়ে উঠতে পারত। কিন্তু এক্ষেত্রে রফতানিকারক হওয়া তো দূরের কথা, নিজেদের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় তেল পরিশোধনাগারও গত অর্ধশতকের ব্যবধানে এ দেশে গড়ে উঠল না। এ অবস্থায় দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনা কারা কাদের স্বার্থে করেন, সে বিষয়ে প্রশ্ন তোলাটা শুধু ন্যায্যই নয়, জরুরিও বটে।
বর্তমানে কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে জাপান ও অন্যদের সহযোগিতায় গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনের যে কাজ চলেছে, ২০২৬ সাল নাগাদ তার নির্মাণকাজ সম্পন্ন হওয়ার কথা রয়েছে। আর সেটি সম্পন্ন হওয়ার পর সিঙ্গাপুর বন্দরে বর্তমানে যে ধরনের মাদার ভেসেল ভিড়তে পারে, সেগুলো এখানেও ভিড়তে পারবে। সেক্ষেত্রে দূরদৃষ্টি ও চিন্তার গভীরতা থাকলে বাংলাদেশের তো উচিত ছিল আরো ১০ বছর আগে থেকেই চট্টগ্রাম অঞ্চলে একাধিক উচ্চক্ষমতার তেল শোধনাগার গড়ে তোলা, যাতে সেগুলোকে ব্যবহার করে আমরাও সিঙ্গাপুরের ন্যায় পরিশোধিত জ্বালানি তেলের অন্যতম রফতানিকারক দেশ হয়ে উঠতে পারতাম। কিন্তু সেটি হওয়ার চিন্তা তো দূরের কথা, আমরা জ্বালানি তেলের সামান্য নিজস্ব চাহিদাটুকু পূরণের জন্যও দরকারি পরিশোধনাগার স্থাপনের কথা ভাবছি না। কারা, কেন, কোন হীন উদ্দেশ্যে এ দেশকে উন্নয়নের রোল মডেল বলে তা বোঝা সত্যি মুশকিল।
বাংলাদেশের অবস্থান ভারত মহাসাগরের মোহনায় ও প্রশান্ত মহাসাগরের অতি সন্নিকটে হওয়া সত্ত্বেও জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তার সমুদ্রবন্দরভিত্তিক সম্প্রসারণ কৌশলকে কাজে না লাগিয়ে সম্প্রতি ভারতীয় ঋণে ভারত থেকে পাইপলাইনে জ্বালানি তেল আমদানির একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে, যা চলতি বছরের ১৮ মার্চ দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী যৌথভাবে উদ্বোধন করেছেন। এ প্রকল্পের মাধ্যমে ভারতের ওপর বাংলাদেশের অপ্রয়োজনীয় জ্বালানিনির্ভরতাই শুধু বাড়েনি, অর্থনৈতিক বিবেচনাতেও এ প্রকল্প গ্রহণযোগ্য নয়। তাছাড়া এ প্রকল্পের আওতায় নিয়মিত তেল সরবরাহ না পাওয়ার আশঙ্কা যেমনি রয়েছে, তেমনি রয়েছে তুলনামূলক সাশ্রয়ী মূল্যে তা কিনতে না পারা ও একতরফা মূল্যবৃদ্ধির ঝুঁকিও (এ বিষয়ে লেখকের বিস্তারিত বিশ্লেষণ দেখা যেতে পারে: আজকের পত্রিকা, ১ এপ্রিল ২০২৩)। এক্ষেত্রে চরম হতাশা ও দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে এতসব ঝুঁকি নিয়েও ভারত থেকে পাইপলাইনে জ্বালানি তেল আমদানির চুক্তি করা হলো, কিন্তু এর বিপরীতে দেশে এক-দুটি জ্বালানি তেল পরিশোধনাগার স্থাপনের উদ্যোগকে গলাটিপে মেরে ফেলা হলো।
এত কিছুর পরও বলব, দেশে বিনিয়োগ ও অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির সঙ্গে জ্বালানি তেলের চাহিদাও যেহেতু বাড়বে, সেহেতু সে বর্ধিত চাহিদা মোকাবেলার জন্য বিলম্বে হলেও একাধিক জ্বালানি তেল শোধনাগার স্থাপনের উদ্যোগ যত দ্রুত গ্রহণ করা হবে, ততই মঙ্গল। বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণের বিষয়ে রাজনীতিক ও আমলা উভয়কেই মাঝে মাঝে উৎসাহব্যঞ্জক কথাবার্তা বলতে শোনা যায়। তো, সেসব কথাবার্তাকে জ্বালানি তেল শোধনাগার স্থাপনের মতো কাজে রূপান্তর করা যায় না কি? ভোজ্যতেল পরিশোধনের জন্য দেশের বেসরকারি খাতে এখন বহুসংখ্যক শোধনাগার রয়েছে এবং এগুলো চালিয়ে তারা রমরমা ব্যবসাও করছেন। ফলে সুযোগ দেয়া হলে জ্বালানি তেল শোধনাগার স্থাপনেও বেসরকারি উদ্যোক্তারা উৎসাহী হবেন বলে আশা করা যায়।
পরিশেষে বলব, সিঙ্গাপুর যদি জ্বালানি তেল পরিশোধন করে জিডিপিতে ৫ শতাংশেরও বেশি অবদান যুক্ত করতে পারে এবং সেক্ষেত্রে সমুদ্রবন্দর যদি হয় অন্যতম নিয়ামক, তাহলে অনুরূপ দৃষ্টান্ত বাংলাদেশের পক্ষে স্থাপন করাও সম্ভব। কারণ বাংলাদেশও অচিরেই প্রায় অনুরূপ গভীর সমুদ্রবন্দরের অধিকারী হতে যাচ্ছে এবং তার লাভজনক পরিধিতেই রয়েছে একাধিক এশীয় দেশ যারা এ বন্দরের মাধ্যমে উপকৃত হতে চাইবে। তবে সমস্যা একটিই, সমুদ্রবন্দর ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে অদক্ষ ও হয়রানিপূর্ণ দেশগুলোর একটি, যেখানে সিঙ্গাপুর বন্দরের অবস্থান প্রায় এক বা দুইয়ের মধ্যে ওঠানামা করে। বন্দর দক্ষতার ক্ষেত্রে বিরাজমান এ বিশাল ব্যবধান কমিয়ে আনা সম্ভব হলে বাংলাদেশও জ্বালানি তেল পরিশোধন ও রফতানি ব্যবসার ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যতম অংশীদার হয়ে উঠতে পারবে। কিন্তু গোষ্ঠীস্বার্থ বিসর্জন দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা সেটি করতে সম্মত হবেন তো?
আবু তাহের খান: সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন, শিল্প মন্ত্রণালয়