জোটের অভিজ্ঞতা : যুক্তফ্রন্ট থেকে ২০ দলীয় জোট

Daily Nayadiganta

জোটের অভিজ্ঞতা : যুক্তফ্রন্ট থেকে ২০ দলীয় জোট – ছবি : সংগৃহীত

আজকের কলামের প্রেক্ষাপট
আমি কখনোই আজকের বিষয়বস্তুটি নিয়ে কলাম লিখতাম না, যদি না মাহমুদুর রহমান মান্না অতি সম্প্রতি বিষয়টি সামনে আনতেন। সরকারি নথিপত্র বা সরকারি খবরাখবর প্রসঙ্গে গোপনীয়তা রক্ষার বিধান আছে। সামরিক বাহিনীর অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে চাই, সর্বাধিক গোপনীয় বিষয়কে বলা হয় টপ সিক্রেট, অতঃপর হয় সিক্রেট, তারপর কনফিডেনশিয়াল, তারপর রেস্ট্র্রিকটেড। যে প্রসঙ্গে কোনো প্রকারের গোপনীয়তা বা শর্ত বা সীমাবদ্ধতা প্রয়োজন নেই, তাকে বলা হতো আনক্লাসিফাইড। পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশেই গোপনীয় বা শ্রেণীভুক্ত নথিপত্র জনগণের সামনে তথা গবেষকদের সামনে উন্মুক্ত করার জন্য নীতিমালা বা আইনের বিধান আছে। কোনো দেশে ৪০ বছর পর, কোনো দেশে ৩০ বছর পর, কোনো দেশে ২৫ বছর পর সরকারি নথিপত্র জনগণের জন্য উন্মুক্ত করার বিধান আছে। কিন্তু এই বিধান রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, রাজনৈতিক বক্তব্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। সুতরাং এক বছর আগে হোক আর তিন বছর আগে হোক বা ৩০ বছর আগে হোক, কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তির রাজনৈতিক উক্তি বা কোনো একটি রাজনৈতিক ঘটনার মূল্যায়ন জনগণের সামনে তথা মিডিয়ার সামনে উপস্থাপিত হতেই পারে। গত দুই সপ্তাহের মধ্যে নিউজটোয়েন্টিফোর নামে টেলিভিশন চ্যানেল একাধিক রাজনৈতিক ব্যক্তির ইন্টারভিউ-ভিত্তিক সংক্ষিপ্ত রিপোর্ট করেছে। এরকমই একটি রিপোর্ট ছিল নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নার ইন্টারভিউ। ইন্টারভিউ নিয়ে রিপোর্ট করেছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক তৌহিদ শান্ত। মান্নার আলোচনার মৌলিক মর্ম ছিল, ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট কেন রাজনৈতিকভাবে ব্যর্থ হলো, সেই প্রশ্নের উত্তর এবং ওই আমলের বিএনপি নেতৃত্বাধীন রাজনীতির মূল্যায়ন। নিউজের সংশ্লিষ্ট অংশটি, অর্থাৎ নিউজ প্রেজেন্টারের বক্তব্য, রিপোর্টার তৌহিদের কথা এবং মাহমুদুর রহমান মান্নার মুখের কথাগুলো টেলিভিশন নিউজ থেকে (ফুটেজ) শুনে শুনে হুবহু নিচে লিখলাম। প্রত্যেকের বক্তব্য আলাদা শিরোনামের নিচে দিলাম যেন বুঝতে কষ্ট না হয়।

নিউজ প্রেজেন্টার-
‘কামাল হোসেনকে রাষ্ট্রপতি করার আশ্বাস দিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। কিন্তু কে হবেন এই জোটের প্রধানমন্ত্রী, এটা নির্ধারণ করতে না পারায় ছিল জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যর্থতা। এমনটা বলছেন, বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম উদ্যোক্তা মাহমুদুর রহমান মান্না। তিনি বলেন, নির্বাচনের ১৫ দিন আগে র‌্যাবের কাছ থেকে প্রস্তাব এসেছিল। কিন্তু বিএনপির সিদ্ধান্তহীনতায় শেষ পর্যন্ত সব বাহিনী একতরফাভাবেই আওয়ামী লীগের দিকেই ঝুঁকে যায়। বিস্তারিত জানাচ্ছেন- তৌহিদ শান্ত।’

তৌহিদ শান্তর উপস্থাপনা শুরু-
‘২০১৮ সালের নভেম্বর মাসের একটি তারিখে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের সাথে সংবাদমাধ্যম ও পত্রিকাগুলোর সম্পাদকদের সাথে একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই সংবাদ সম্মেলনের তথা সভার ভিডিও ফুটেজ দেখিয়ে তৌহিদ শান্ত বলেন, ‘রাজধানীর একটি হোটেলে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ২০১৮ সালের নভেম্বরে। একাদশ জাতীয় নির্বাচনের এক মাস আগে অনুষ্ঠিত এই সভায় সম্পাদকরা জানতে চেয়েছিলেন, বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে জয়ী হলে কে হবেন প্রধানমন্ত্রী? এর কারণ, বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া তখন জেলে। আর ঐক্যফ্রন্টের প্রধান নেতা কামাল হোসেন নির্বাচনেই অংশ নিচ্ছেন না। কোনো উত্তর ছিল না ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের কথায়। এটি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ভরাডুবির অন্যতম প্রধান কারণ। দুই বছরেরও বেশি সময় পর নিউজটোয়েন্টিফোরকে এই কথা বললেন, মাহমুদুর রহমান মান্না।’

মাহমুদুর রহমান মান্না-
‘তারেক জিয়া এবং বেগম জিয়া সম্ভবত মনে করছেন যদি ড. কামাল প্রধানমন্ত্রী হয়ে যান তাহলে আমাদের তো জায়গা থাকবে না! তাহলে ইনটেরিম ব্যবস্থা কী হবে? সেদিন কি বেগম জিয়া প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন, তারেক জিয়া হতে পারবে? ইনটেরিম কাউকে দিতে হবে। এটি বেগম জিয়া, তারেক জিয়া দেবেন না, বেগম জিয়া বরঞ্চ রিকোয়েস্ট করলে- আপনি চিন্তা করবেন না, আমরা হলে- আমরা আপনাকে দেশের প্রেসিডেন্ট বানাব। ড. কামাল তো প্রেসিডেন্ট হতে চান না।’

তৌহিদ শান্ত-
তৌহিদ জানান, ‘সামরিক-বেসামরিক সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পক্ষ থেকেও তাদের সাথে যোগাযোগ করা হচ্ছিল।’

মাহমুদুর রহমান মান্না
মান্না- ‘পুলিশের লোক আমাদের সাথে যোগাযোগ করছে, করে বলছে, ভাই তাহলে আমাদের ব্যবস্থা কী হবে বলেন। পাওয়ার চেঞ্জ হলে আমরা কোথায় থাকব? আর্মির লোকজন জিজ্ঞাসা করছে। আমি তো বলছি ভাইয়া, আমি তো বলতে পারব না। তখন কয়দিন ঘুরতে ঘুরতে তারা ভাবল, দূর এদের সাথে কথা কইয়ে কী লাভ? এইটা আওয়ামী লীগ গ্রাস করল এবং তাদেরকে দিলো। ফলে ইলেকশনের ১০-১৫ দিন আগে পুলিশসহ সমস্ত ফোর্স আওয়ামী লীগের সাথে ট্যাগড হয়ে গেল।’

তৌহিদ শান্ত
তৌহিদ- ‘একটি নির্বাচনী জোটকে দিকনির্দেশনা দিতে চরমভাবে ব্যর্থ হয় বিএনপি এই অভিযোগ করেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম প্রধান এই উদ্যোক্তা।’

মাহমুদুর রহমান মান্না-
‘আমি প্রস্তাব করলাম, ভাই যত বড় ঘটনা ঘটছে, মিনিমাম চার দিনের একটা লাগাতার কর্মসূচি লাগবে। আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই মির্জা ফখরুল বলল, আমাদের পক্ষে সম্ভব না।’

তৌহিদ শান্ত
‘মানুষ যখন সরকারের বিভিন্ন কাজের সমালোচনামুখর, এমন কঠিন পরিস্থিতিতেও বিএনপির রাজনৈতিক পদক্ষেপগুলো তাকে হতাশই করে চলছে। এমনটাই বলছিলেন ডাকসুর সাবেক এই ভিপি।’

মাহমুদুর রহমান মান্না
‘একটা পলিটিক্যাল পার্টি কী রকম করে বলতে পারে যে’-

২০ দলীয় জোট গঠন প্রক্রিয়া
১০ বছর আগে ২০১১ সালে রমজান শুরু হয়েছিল আগস্ট মাসে। রমজান শুরুর ১৫-২০ দিন আগে থেকেই বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা (তৎকালে বিদ্যমান) চারদলীয় জোটের বাইরের কয়েকটি রাজনৈতিক দলের প্রধান ব্যক্তিদের সাথে সাক্ষাৎ করা শুরু করেন। উদ্দেশ্য ছিল, চারদলীয় জোট সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ওই সব রাজনৈতিক দলগুলোকে বৃহত্তর জোটে যোগদানের দাওয়াত দেয়া। এই প্রক্রিয়া রোজার মাসের পরও চলতে থাকে। চার-পাঁচ মাস আলাপ-আলোচনার পর বৃহত্তর জোটের আকৃতি চূড়ান্ত হয়েছিল। ১৬ এপ্রিল ২০১২ সন্ধ্যার পর গুলশানে অবস্থিত বিএনপি চেয়ারপারসন কার্যালয়ে আগ্রহী সব দলের বা চূড়ান্ত হওয়া সব দলের প্রধানদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বৃহত্তর জোটের ঘোষণাপত্র স্বাক্ষরের জন্য উপস্থাপিত হলে দেখা গেল যে, মোট ১৬টি দলের নাম টাইপ করা আছে। কিন্তু ওই সন্ধ্যায় এলো ১৭টি দল, স্বাক্ষর করল। কারণ সর্বশেষ দলের নামটি চূড়ান্ত হয়েছে ঘোষণাপত্র টাইপ করার পর এবং ওই দলের নামটি হাতে কলম দিয়ে লেখা ছিল।

অতএব ওই সন্ধ্যায় ১৭টি দলের স্বাক্ষরে, একটি বৃহত্তর জোট কাগজ-কলমে জন্ম নিলো, আনুষ্ঠানিক ঘোষণার অপেক্ষায় থাকল। ১৮ এপ্রিল ২০১২ অপরাহ্ণে, ঢাকা মহানগরের কাকরাইল এলাকায় অবস্থিত ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের তৃতীয় তলার অডিটোরিয়ামে জোট ঘোষণার আনুষ্ঠানিক সভা হয়। সেদিন মঞ্চ থেকে ঘোষণা করা হয় ১৮টি দলের নাম এবং সেই জোটের নাম হয় ১৮ দলীয় জোট। দ্রষ্টব্য : পরবর্তীতে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে আগে এই জোটটি ২০ দলীয় জোটে রূপান্তরিত হয়েছিল এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে-পরে অল্প কিছুদিনের জন্য এই জোটে ২৩টি দল ছিল। ২০১২ সালের এপ্রিল থেকে, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর পর্যন্ত সাড়ে ছয় বছর দীর্ঘ সময়ের জোটের রাজনৈতিক কার্যক্রমের আলোচনা আজকের কলামে করব না। আমরা এক লাফে ২০১৮ সালের অক্টোবরে চলে আসি।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো বিদ্যমান। এর জন্ম ২০১৮ সালের নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ আগে। এই ঐক্যফ্রন্টের গঠন প্রক্রিয়ার সাথে আমি বা আমার দল জড়িত ছিল না বিধায়, আমি সুনির্দিষ্ট বর্ণনা এখানে দেবো না। আমরা লোক মারফত এবং মিডিয়া মারফত জানতে পারতাম বা জানছিলাম যে, বিএনপির নেতৃত্বে আরেকটি জোট গঠিত হচ্ছে। এ ধরনের পদক্ষেপ চূড়ান্ত করার আগে বা রাজনৈতিক জোট গঠনের আগে, স্বাভাবিকভাবেই কিছু প্রস্তুতিমূলক বা ইশারামূলক কর্মকাণ্ড লক্ষণীয় ছিল। এরকম দু-একটি প্রস্তুতিমূলক সভায় বা ফাংশনে ২০ দলীয় জোটের কেউ কেউ উপস্থিত ছিলেন এবং তাদের অভিজ্ঞতা পুরোপুরি আনন্দদায়ক ছিল না। অক্টোবরের শেষের দিকে ২০ দলীয় জোটের একটি মিটিং অনুষ্ঠিত হয়। এরূপ মিটিংগুলো বিএনপি চেয়ারপারসন কার্যালয়ের দোতলায় অনুষ্ঠিত হতো। ওই দিনের মিটিংয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং ২০ দলীয় জোটের সমন্বয়ক নজরুল ইসলাম খান উভয়েই উপস্থিত ছিলেন। আলোচনাটি দীর্ঘ ছিল। অনেকেই আলোচনা করেন। সেই মিটিংয়ে বিএনপি মহাসচিব প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে ২০ দলীয় জোটের নেতাদের সামনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের প্রয়োজনীয়তা এবং গঠনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। তিনি আহ্বান জানান, ‘আসুন আমরা সবাই ওই ঐক্যফ্রন্টে যোগদান করি, যেন আমরা আগামী নির্বাচনটি শক্তভাবে, ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবেলা করতে পারি।’ মির্জা ফখরুলের বক্তব্যের পর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। শেষের দিকে একপর্যায়ে আমি অনুমতি নিয়ে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছিলাম। আমি ঐক্যফ্রন্টে যোগদানের ব্যাপারে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির পক্ষ থেকে অপারগতা প্রকাশ করি। আমার অপারগতার পেছনে ছোট ছোট যে দু’টি যুক্তি ছিল, সেগুলো ছিল নিম্নরূপ- প্রথমত, কার সঙ্গে ঐক্য, কতদিনের জন্য ঐক্য, কিসের জন্য ঐক্য, কার নেতৃত্বে ঐক্য- এ বিষয়গুলো আমি বা আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। অতএব, আমি লাফ দিয়ে ঐক্যফ্রন্টে যোগ দেবো না। দ্বিতীয়ত, ২০ দলীয় জোটের রাজনৈতিক ভাগ্য কী হবে এ প্রসঙ্গে কোনো সিদ্ধান্ত আমরা জানি না। এ ব্যাখ্যার পর আমি নিজে প্রস্তাব করি, ২০ দলীয় জোটের সবার প্রতিনিধি হিসেবে প্রধান শরিক বিএনপি যদি ঐক্যফ্রন্টে যায় এবং ঐক্যফ্রন্টে থাকে, তাহলেই যথেষ্ট এবং আমাদের সম্পৃক্ততা আছে বলে ধরে নেয়া যাবে। আমি এই বক্তব্যটি দিয়েছিলাম, একটি মাত্র উদ্দেশ্যে। সেই উদ্দেশ্যটি ছিল এই- ঐক্যফ্রন্ট গঠন যেহেতু আমরা বন্ধ করতে পারব না, সুতরাং সেটি এগিয়ে যাক এবং একই সাথে ২০ দলীয় জোটকেও বাঁচিয়ে রাখি। এ ছাড়াও আমি আবেদন করি যে, ২০ দলীয় জোটে বিএনপি নেতাদের বাইরে, রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠতম হলেন ডক্টর কর্নেল অলি আহমেদ বীর বিক্রম। সেই কর্নেল অলি আহমেদ গত পাঁচ-সাত মাস (অর্থাৎ ২০১৮ সালে বেগম জিয়া গ্রেফতারের পর) যাবত জোটের কর্মকাণ্ড বা মিটিংয়ে প্রায়ই অসম্পৃক্ত বা অদৃশ্য। সেই কর্নেল অলি আহমেদ বীর বিক্রমকে ২০ দলীয় জোটের কর্মকাণ্ডে নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে সম্পৃক্ত করলে ভালো। তাহলে এক দিকে ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে বিএনপি এগিয়ে যাবে আবার একই সাথে বিএনপি ২০ দলীয় জোট নিয়েও এগিয়ে যাবে।

স্বচ্ছ স্মৃতিচারণ
আজ, ২০২১ সালের জুন মাসের এই কলামে আমি অক্টোবর ২০১৮ সালের জোটের শীর্ষনেতাদের মিটিংয়ের স্মৃতিচারণ করে বলতে চাই, ওই মিটিংয়ে আমার মনের ভেতর কী চলছিল। প্রথমেই আমার উপলব্ধি হচ্ছিল যে, ২০ দলীয় জোট পরোক্ষভাবে ভেঙে দেয়া হচ্ছে বা নিষ্ক্রিয় করা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, বিএনপির ফোকাস ঐক্যফ্রন্টের দিকেই যাবে। বাস্তবেও এটাই হয়েছিল। ২০ দলীয় জোটের কোনো মিটিং হয়নি, যেখানে নির্বাচনী আসন নিয়ে আলোচনা হবে। ২০ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে কোনো নির্বাচনী বড় সভা হয়নি, ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে হয়েছে। চট্টগ্রাম মহানগরে কাজীর দেউরিতে অবস্থিত বিএনপি অফিসের সামনে সড়কের উপর ঐক্যফ্রন্টের মিটিংয়ে আমিও উপস্থিত ছিলাম এবং সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখার সুযোগ পেয়েছিলাম। ব্যানারটি ছিল ঐক্যফ্রন্টের। আমি স্মৃতিচারণ করে বলতে চাই, ঐক্যফ্রন্ট নামক তত্ত্ব এবং ঐক্যফ্রন্ট নামক বাস্তবতা এবং ২০ দলীয় জোটের তত্ত্ব ও বাস্তবতা এর মধ্যে কোনোদিনই হ্যাপি ম্যারেজ বা সুখের মিলন হয়নি। কিন্তু জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট এবং ২০ দলীয় জোটের দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের মধ্যে বেশির ভাগই পরস্পরের সাথে অতি সুপরিচিত এবং তাদের মধ্যে আন্তরিক সম্পর্ক ছিল। কিন্তু ‘ম্যাচমেকার বা ঘটক’এর দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে, ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মধ্যে মেলবন্ধন সৃষ্টি হয়নি, হওয়ার মতো সময় বা প্রয়োজন আর নেইও।

যুক্তফ্রন্ট নামক জোটের অভিজ্ঞতা
বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির জন্ম ডিসেম্বর ২০০৭ সালে। নির্বাচন কমিশন থেকে নিবন্ধন পেয়েছিলাম নভেম্বর ২০০৮ সালে। আনুমানিক ওই সময়টায় অর্থাৎ অক্টোবর-নভেম্বর ২০০৮ সাল। একটি রাজনৈতিক জোট গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন ফরোয়ার্ড পার্টি নামে একটি রাজনৈতিক দলের আহ্বায়ক আ ব ম মোস্তফা আমিন। তার সাথে পারস্পরিক সহযোগিতায় ছিলেন বিকল্পধারার তৎকালীন মহাসচিব মেজর আবদুল মান্নান। প্রাথমিক প্রস্তুতি সভায় বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি এবং বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ উপস্থিত ছিল। পরবর্তী প্রস্তুতি সভায় বঙ্গবীরের দলকে দেখিনি (তারা নিজেরা আসেননি নাকি তাদের দাওয়াত দেয়া হয়নি, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই)। অতঃপর একপর্যায়ে জোটটি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করার দিন এলো। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে অবস্থিত হোটেল ইম্পেরিয়ালের অষ্টম তলায় কনভেনশন হলে ফাংশনের বন্দোবস্ত করা হয়। জোটের শরিক দল ছিল মোট চারটি যথা- ১. ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরাম; ২. প্রফেসর বি. চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বিকল্পধারা; ৩. মেজর জেনারেল ইবরাহিমের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি ও ৪. মোস্তফা আমিনের নেতৃত্বাধীন ফরোয়ার্ড পার্টি। জোটে শরিক দলের সংখ্যা চারটি হলেও কিন্তু, মঞ্চে চেয়ার দেয়া ছিল দু’টি। একটি হলো জোটের প্রধান ড. কামাল হোসেনের জন্য এবং অন্যটি হলো জোটের যুগ্ম প্রধান প্রফেসর বি. চৌধুরীর জন্য। বাকি দু’টি শরিক দলকে মঞ্চে ডাকার জন্য উপযুক্ত মনে করা হয়নি। এই জোটটি ছিল বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বধীন দু’টি প্রধান জোটের বাইরে। ১৯৫৪ সালের বিখ্যাত নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে বিজয়ী বিখ্যাত জোট যুক্তফ্রন্টের নামানুসারে, ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আগে গঠিত হওয়া এই জোটটিরও নাম করা হয়েছিল যুক্তফ্রন্ট। ওই যুক্তফ্রন্ট নামক জোটের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার দিনেই আমার মন বলেছিল, যুক্তফ্রন্ট নামে জোটটি ব্যর্থতার দিকে পদযাত্রা শুরু করল। সম্মানিত পাঠক, এরূপ মনোভাব সৃষ্টি হওয়ার জন্য কারণগুলো আজ আর এই কলামে প্রকাশ্যে আলোচনা করছি না। তবে রাজনৈতিক স্বচ্ছতার স্বার্থে আমাকে বলতেই হবে, ২০০৮ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে যুক্তফ্রন্ট নামে ওই জোটের সাথে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির অভিজ্ঞতা, ২০১৮ সালের অক্টোবর-নভেম্বরে গঠনাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগদান না করার পক্ষে আমার ওপর প্রভাব বিস্তার করেছিল। বলাই বাহুল্য, ২০০৮ সালের অভিজ্ঞতার আলোকে, আমি ২০১৮ সালে ঐক্যফ্রন্টের গঠন প্রক্রিয়া ও নেতৃত্বের ওপর আস্থাশীল ছিলাম না। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য, বিএনপি ব্যতীত ২০ দলীয় জোটের অন্যান্য শরিক দলের অনুকূলে আসন বণ্টনের ওপর, ঐক্যফ্রন্টের অস্তিত্ব এবং ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে উপস্থাপিত রাজনৈতিক চাহিদা, অবশ্যই প্রভাব বিস্তার করেছিল।

উপসংহার
রাজনৈতিক দলগুলোর জোট বিভিন্ন নামের হয়ে থাকে। জোটগুলোর শরিক দলগুলোর সংখ্যা অনির্ধারিত এবং কমবেশি হতে পারে। জোট গঠনের প্রক্রিয়া কী হবে, সেটি কোনো ছাপানো বইয়ের মধ্যে নেই বা কোনো আইনের বইয়ের মধ্যে নেই। এটা একান্তই নির্ভর করে জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক নেতাদের অভিজ্ঞতা ও আন্তরিকতার ওপর। ২০০৭ সালের ডিসেম্বর থেকে চলমান আমার স্বল্পমেয়াদি রাজনৈতিক জীবনে কিছু দিন স্বতন্ত্র রাজনৈতিক অবস্থানের অভিজ্ঞতা পেয়েছি, যুক্তফ্রন্ট নামে একটি অতি স্বল্পমেয়াদি জোটের শরিক হওয়ার অভিজ্ঞতা পেয়েছি, ২০ দলীয় জোট নামে একটি দীর্ঘমেয়াদি বৃহৎ রাজনৈতিক জোটের শরিক হওয়ার অভিজ্ঞতা পেয়েছি এবং সেই ২০ দলীয় জোটটি যখন বিলুপ্তির হুমকিতে পড়েছিল, তখন সেটিকে রক্ষা করার সংগ্রামেও শরিক হতে পেরেছি। এর জন্য আমি মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করি। সাথে সাথে সুপরিচিত বা সহযোগী সব সম্মানিত রাজনৈতিক নেতার প্রতি ও তাদের দলের প্রতি শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করি। মাহমুদুর রহমান মান্না যেরূপ ইতিবাচক, প্রেরণামূলক দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছেন, সেরূপ স্মৃতিচারণমূলক রাজনৈতিক মূল্যায়নের ধারা যদি বজায় থাকে, তাহলে আমাদের রাজনীতির উপকার হবে বলে আমি মনে করি।

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
ইমেল : [email protected]