গণতন্ত্রে বিশ্বাস করলে ভোটে অংশগ্রহন করতেই হবে-মির্জা ফখরুল
ব্যাপক গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে জালিম সরকারের পতন ঘটাতে হবে-মেজর অব হাফিজ
বিএনপি এখন খন্ড বিখন্ড, কেউ কারো কথা শোনে না-গয়েশ্বর চন্দ্র রায়
বিশেষ প্রতিনিধি
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম হর হামেশাই বলেন, আমরা নির্বাচনের মাধ্যমেই সরকার পরিবর্তন করতে চাই। গণতন্ত্রে বিশ্বাস করলে ভোটে অংশগ্রহন করতেই হবে। ঠিক এই সময়ে বিএনপি মহাসচিবের ১৮০ ডিগ্রী বিপরীত কথা বলেছেন দলটির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী মেজর (অব:) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ। সোমবার (১৬ নভেম্বর) এক আলোচনা সভায় তিনি বলেছেন, ব্যাপক গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমেই ভোটারবিহীন জালিম সরকারের পতন ঘটাতে হবে। তিনি আরো বলেছেন, জনগণ যেহেতু ভোট কেন্দ্রে যেতে পারছে না, ভোটের মাধ্যমে যেহেতু সরকার পরিবর্তনের সুযোগ নাই, তাই একমাত্র উপায় গণঅভ্যুত্থান। আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন মেজর হাফিজ। একই সঙ্গে জাতীয় সংসদের শূন্য আসনে উপ-নির্বাচনসহ বিভিন্ন নির্বাচনে বিএনপি’র অংশ গ্রহনের বিষয়ে কঠোর সমালোচনার পাশাপাশি কেন এসব নির্বাচনে অংশ নেয়া হয়, এনিয়ে প্রশ্ন রেখেছেন বিএনপি’র এই সিনিয়র নেতা।
অথচ ঢাকা-১৮ আসনে নির্বাচনের দুইদিন পর দলটির মহাসচিব গত ১৪ নভেম্বর জাতীয় প্রেক্লাবের সামনে এক মানব বন্ধনে বলেছেন, নির্বাচনের মাধ্যমেই এই সরকারের পরিবর্তন চায় বিএনপি। দখলদার শেখ হাসিনা সরকারের কাছেই সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অনুনয় বিনয় করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করুন। দেখবেন জনগণ কাকে ভোট দেয়। গত ২০ অক্টোবর ঠাকুরগাঁওয়ে স্থানীয় সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময়ের সময়ও বিএনপি মহাসচিব জোর দিয়ে বলেছেন, “আমরা নির্বাচনের মাধ্যমেই সরকার পরিবর্তন চাই। গণতন্ত্রে বিশ্বাস করলে ভোটে অংশগ্রহন করতেই হবে।”
এদিকে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য বাবু গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ২০ অক্টোবর ঢাকার নয়াপল্টনে ব্যক্তিগত অফিসে কৃষক দলের আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বলেছেন, বিএনপি এখন খন্ড-বিখন্ড। কেউ কারো কথা শোনে না। একজন আরেকজনকে খাটো করা এবং একজন আরেকজনকে ব্যর্থ করায় ব্যস্ত থাকে। তিনিও সব ভেদাভেদ ভুলে দলকে আন্দোলনমুখি করার প্রতি জোর দেন।
দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা নেতাদের প্রকাশ্যে এরকম বিপরীতমুখি বক্তব্য প্রায়ই শোনা যায়। এতে স্পষ্ট বিএনপি’র দলীয় নিশানা এখনো নির্দিষ্ট নয়। আন্দোলনের মাধ্যমেই সরকারের পরিবর্তন নাকি আগামী নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করে নির্বাচনে অংশ নেয়া এনিয়ে মতবিরোধ রয়েছে দলটির সিনিয়র নেতৃবৃন্দের মধ্যে।
যা বলেছেন মেজর অব: হাফিজ উদ্দিন আহমেদ:
মেজর অব: হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ভোটে নয়, রাজপথেই ব্যাপক গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে এই ভোটারবিহীন জালিম সরকারের পতন ঘটাতে হবে। তিনি আরো বলেন, ‘যতদিন এই সরকার ক্ষমতায় আছে ততদিন ভোট কেন্দ্রে সাধারণ নাগরিক যেতে পারবে না। জনগণের ভোটের মাধ্যমে যেহেতু সরকার পরিবর্তনের আর সুযোগ নেই, তাই একমাত্র উপায় গণঅভ্যুত্থান।’
সরকার পরিবর্তনের জন্য রাস্তায় রাজপথের আন্দোলনে জোর দিয়ে তিনি বলেন-‘জনগণ যদি রাস্তায় নেমে আসে ওই যে আমি বলেছি, দুই লাখ লোক দু’দিন রাস্তায় থাকেন পালিয়ে যাবে তারা (আওয়ামী লীগ সরকার)। সেই সাহস সঞ্চয় করে আসুন আমরা আগামী দিনে এই সরকারকে বিতাড়িত করতে রাজপথে আবার নেমে আসি।’
সোমবার (১৬ নভেম্বর) দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবে জিয়াউর রহমান সমাজকল্যাণ পরিষদের উদ্যোগে ‘ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর বিপ্লব ও সংহতি দিবসের তাৎপর্য এবং গৃহবন্দি থেকে নিঃশর্ত মুক্তির করণীয়’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি একথা বলেন।
প্রেসক্লাবের তোফাজ্জ্বল হোসেন মানিক মিয়া হলে সংগঠনটির সভাপতি গিয়াস উদ্দিন খোকনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক সাবেক প্রতিমন্ত্রী আ ন ম এহছানুল হক মিলন, লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি কাদের গনি চৌধুরী, জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) প্রেসিডিয়াম সদস্য আহসান হাবিব লিংকন,প্রফেসর শাহ আলম, স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় নেতা একেএম আবুল কালাম আজাদ, কৃষকদল নেতা কে এম রকিবুল ইসলাম রিপন প্রমুখ।
বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধিনে নির্বাচনে দলের অংশ গ্রহনের বিষয়ে প্রশ্ন তুলে হাফিজ উদ্দিন বলেন, ‘‘ কেনো আমরা এই ধরনের নির্বাচনে যাই? যখন নির্বাচনে যাওয়া উচিত না তখন যাই, যখন যাওয়া উচিত তখন যাই না। যে দিন সংসদে যাওয়া উচিত না সেই সংসদে গিয়ে আমরা বসে থাকি। যার জন্য আজকে বিএনপিকে চার‘শ ভোট দেয়। সিরাজগঞ্জ-১ আসনে ওদের প্রার্থী পেয়েছে এক লাখ ৮৮ হাজার ভোট আর আমাদের প্রার্থী পেয়েছে ৪‘শ ভোট।”
এ প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, ‘‘ আরে বিএনপির এজেন্টই তো হাজারেরও বেশি। আমাদের কোনো এজেন্ট ভোট কেন্দ্রে যেতে পারেন না, কোনো ভোটার ভোট কেন্দ্রে যেতে পারে না, এমনকি আওয়ামী লীগের সমর্থকরা ভোট কেন্দ্রে যেতে পারে না-এই হলো বাংলাদেশের গণতন্ত্র।”
তিনি বলেন, ‘‘ যদি আমরা জিয়াউর রহমানের আদর্শের অনুসারী হয়ে থাকি তাহলে আমাদের দলেও তার প্রতিফলন থাকতে হবে।জিয়াউর রহমানের মত সততা থাকতে হবে, তার মতো সাহসী হতে হবে এবং দেশের স্বার্থে কখনো কোনো ধরনের আপোষ করা যাবে না।”
তিনি বলেন, ‘‘বেগম খালেদা জিয়া আপোষ করেননি। কিন্তু আমরা অনেকে আপস করে বসে আছি। আজকে দূঃখের বিষয় খালেদা জিয়ার মতো নেত্রী বছরের পর বছর জেলে কাটালেন আমরা কী করতে পেরেছি?।”
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, ‘‘ সবচাইতে বড় অশনিসংকেত আমি দেখতে পারছি- বিএনপি তো এখন ডাক দিলে রাস্তায় নামাতে পারে না। আমাদের এতো শক্তিশালী ছাত্র দল ছিলো তারাও রাস্তায় নামাতে পারে না। কেনো তাদের নামাতে পারেনা আমি জানি না। কারণ আমি এই দলের এতো বিরাট নেতাও না। কিন্তু অন্যদিকে যে,..। তোমারে বধিবে সে, গকুলে বাড়িছে সে। ইসলামী দল গুলোর মিছিল দেখেন, তাদের সংখ্যা দেখেন রাজপথে।”
তিনি আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলেন, ‘‘যদি আমরা ব্যর্থ হই। এই সরকার তো যাবে, আওয়ামী জাহিলাতের অবসান হবেই। এই ধরনের একটা নষ্ট পঁচা সরকারকে বাংলাদেশের মানুষ বেশিদিন সহ্য করবেনা। কিন্তু তার পরিবর্তন কীভাবে আসবে? কারা এদেরকে সরাবে-এটাই দেখার বিষয়। আমরা যেটা দেখতে পারবো, এটা বেশি দূরে নয়। তবে এই রাষ্ট্র যদি উদার রাজনৈতিক ধারা থেকে বেরিয়ে গিয়ে আবার অন্য কারো খপ্পরে পড়ে এই জন্য শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ দায়ী থাকবেন। আমরা এই ধরনের পরিস্থিতি চাই না।”
হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘‘দুঃখ লাগে এই সামরিক বাহিনী আমরা সৃষ্টি করেছি। কত সন্মানের পাত্র ছিলো তারা। নির্বাচনের সময়ে সেনা বাহিনী যেখানে যেতো দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যেতো। আর এখন। গত নির্বাচনের আগের রাত্রে সব ভোট দিয়ে ফেললো আর সেনা প্রধান বললেন, এতো ভালো ভোট আমি জীবনে দেখিনি।”
সেনাবাহিনীকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের যে শেষ ভরসার স্থল সেটিও চিন্তাভাবনার বিষয় তাদের অবস্থান কী? অত্যন্ত দূঃখ লাগে সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে যাক, এই সেনাবাহিনীর জন্য কষ্ট লাগে- আমরা এই সেনা বাহিনী সৃষ্টি করেছি একাত্তর সালে। পাকিস্তান আর্মিতে আমরা যারা ছিলাম আমরা বিদ্রোহ করে মুক্তিবাহিনী এবং বাংলাদেশ সেনা বাহিনী গড়ে তুলেছি। গত ৫/৭ বছরে এরা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এখনো সাধারণ সৈনিকেরা ভালো আছে, জুনিয়র অফিসার-মিড লেভেল অফিসাররা ভালো আছে। শীর্ষ পর্যায় কয়েকজন নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আমরা সেনাবাহিনীকে রাজনীতি মুক্ত চাই। সেনাবাহিনী যেন বাংলাদেশের কোনো দলের সেনাবাহিনী নয়, জনগনের সেনাবাহিনী হয়-এটাই আমরা আশা করি।”
৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতা বিপ্লবে কর্ণেল তাহের সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করে দেয়ার ষড়যন্ত্র করেছিলো উল্লেখ করে তিনি বলেন, জিয়াউর রহমানের সাহসী ভুমিকায় সেদিন সেনাবাহিনী ও দেশ রক্ষা পেয়েছিল।