কোথায় দেওয়া হয় ট্রেনে আগুন

কোথায় দেওয়া হয় ট্রেনে আগুনআগুনে পুড়ে যাওয়া মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের বগি

ট্রেনে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় জড়িতদের শনাক্ত করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাদের চিহ্নিত করতে বিমানবন্দর থেকে তেজগাঁও স্টেশন পর্যন্ত রেলপথের দু’পাশের বিভিন্ন স্থাপনার সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। তবে আগুন লাগার স্থান নিয়ে সংস্থাগুলোর মতপার্থক্য রয়েছে। রেলওয়ে গত মঙ্গলবার নথিতে লিখেছিল, ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন ছাড়ার পর মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে আগুন দেখা যায়। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ কেউ ধারণা করছিলেন, বিমানবন্দর স্টেশনে আগুন দিয়ে নাশকতাকারীরা নেমে যায়।

আগুন লাগানোর প্রায় ১৫ মিনিট পর কেন ট্রেনটি থামানো হলো– তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। তবে রেলের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা এ প্রশ্নকে ভিত্তিহীন বলছেন। তারা সমকালকে জানিয়েছেন, ভোর ৪টা ৪০ মিনিটে বিমানবন্দর স্টেশন ছাড়ে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস। ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে পৌঁছাতে আট মিনিট লাগে। এরপর আগুন দেখে গার্ড ট্রেন থামাতে লোকোমাস্টারকে (চালক) সংকেত দেন। ভোর ৪টা ৫৮ মিনিটে ট্রেন থামানো হয়। যদিও মঙ্গলবার রাতে ঢাকা রেলওয়ে থানায় অচেনা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের পরিচালক (গার্ড) খালেদ মোশারেফের মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ভোর ৪টা ৪৩ মিনিটে আগুন দেওয়া হয়।

এদিকে আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া অপর দু’জনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। তাদের একজন নেত্রকোনার ব্যবসায়ী রশিদ ঢালী (৬০), অপরজন পোশাক শ্রমিক খোকন মিয়া (৩৫)। গতকাল বুধবার তাদের লাশ স্বজনের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

এর আগে মঙ্গলবারই গৃহবধূ নাদিরা আক্তার পপি ও তাঁর তিন বছরের ছেলে ইয়াসিন আরাফাতের লাশ শনাক্ত করেন স্বজনরা।

ঢাকা রেলওয়ের পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন সমকালকে বলেন, সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ ছাড়াও ট্রেনটির যাত্রীসহ প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলা হচ্ছে। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন পার হওয়ার পর আগুন দেখা যায়। সে ক্ষেত্রে নাশকতাকারীরা যাত্রীবেশে উঠে ট্রেনের ভেতরেই ছিল। তেজগাঁও স্টেশনে ট্রেন থামানোর পর বা কাছাকাছি সময়ে তারা নেমে যায়। দ্রুতই তাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে বলে আশা করছি।

এর আগে মঙ্গলবার ভোরে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে দুর্বৃত্তের দেওয়া আগুনে পুড়ে চারজনের মৃত্যু হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য অনুযায়ী, বিমানবন্দর স্টেশন ছাড়ার কিছু সময় পর তারা আগুন দেখতে পান। পরে তেজগাঁও স্টেশনে ট্রেন থামিয়ে আগুন নেভানো হয়।

মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনসহ (পিবিআই) বিভিন্ন সংস্থা ঘটনাটির ছায়াতদন্ত করছে। ডিবি সূত্র জানায়, গাজীপুরের নাশকতায় জড়িত পলাতক সদস্যরা ঢাকায় ট্রেনে আগুন দিয়েছে বলে প্রাথমিক তথ্য মিলেছে।

দাহ্য পদার্থ দিয়ে অগ্নিসংযোগ

এজাহারে বলা হয়েছে, ট্রেনটি মোহনগঞ্জ থেকে সোমবার রাত ১১টায় ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে আসে। ৪টা ৪০ মিনিটে বিমানবন্দর স্টেশন থেকে যাত্রার তিন মিনিট পর দুষ্কৃতকারীরা ‘জ’ এবং ‘ঝ’ বগির মাঝামাঝি স্থানে দাহ্য পদার্থ দিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। ট্রেনের ভেতর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়লে ‘জ’ বগিতে কর্তব্যরত স্টুয়ার্ড মাঈন উদ্দিন মানিক স্টুয়ার্ড ম্যানেজার রাহাত মিয়াকে জানান। রাহাত মিয়া বিষয়টি জানান পরিচালক (গার্ড) খালেদকে। তবে এর আগেই ট্রেনটি তেজগাঁও রেলস্টেশনে প্রবেশের সময় দরজায় দাঁড়িয়ে বগির ভেতর থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখেন তিনি। এক পর্যায়ে তিনি এয়ার প্রেশার ড্রপ করে মোবাইল ফোনে ট্রেনচালক দিলীপ কুমার মণ্ডলের সঙ্গে যোগাযোগের পর ৪টা ৫৮ মিনিটে তেজগাঁও স্টেশনে ট্রেনটি থামানোর ব্যবস্থা করেন। এ সময় আগুন ‘ছ’ বগিতেও ছড়িয়ে পড়ে। এজাহারে আরও বলা হয়, অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতকারীরা পূর্বপরিকল্পিতভাবে ট্রেনে আগুন লাগিয়ে চার যাত্রীকে হত্যা ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

চালকের কাছে খবর পৌঁছাতে দেরি কেন

আগুন লাগা বগিতে উপস্থিত ছিলেন স্টুয়ার্ড মাঈন উদ্দিন। এরপরও লোকোমাস্টারের (চালক) কাছে খবর পৌঁছাতে কেন ১৫ মিনিট সময় লেগে গেল– এমন প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। এ বিষয়ে চালক ও গার্ডের বক্তব্য জানতে পারেনি সমকাল।

পিবিআইর তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা জানান, বিমানবন্দর রেলস্টেশন থেকে ১২টি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। এ ছাড়া তেজগাঁও রেলস্টেশনের দুটি এবং গফরগাঁও রেলস্টেশন থেকে একাধিক সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়। দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, গফরগাঁও ও বিমানবন্দর রেলস্টেশনে যেসব যাত্রী ওঠানামা করেছেন এবং আগুন লাগার পর তেজগাঁও স্টেশনে যেসব যাত্রী নেমেছেন, তাদের মধ্যে থেকে অগ্নিসংযোগে জড়িতদের শনাক্তের চেষ্টা চলছে।

ছেলেকে খুঁজে পেলেন বকুল, তবে মৃত

ট্রেনে আগুন লাগার পর নিখোঁজ ছিলেন নারায়ণগঞ্জের পোশাক শ্রমিক খোকন মিয়া। তাঁর মা বকুল আক্তার দুই বছরের নাতনি শারমিনকে কোলে নিয়ে তেজগাঁও স্টেশনের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় ছেলেকে খুঁজছিলেন।

বকুল আক্তার জানান, ছেলে ও নাতনিকে নিয়ে মোহনগঞ্জ ট্রেনে ওঠেন। কমলাপুরে নেমে নারায়ণগঞ্জ যাওয়ার কথা ছিল। মঙ্গলবার ট্রেনে আগুনের ঘটনার পর মা ও মেয়েকে তড়িঘড়ি করে নামিয়ে দেন খোকন। এরপর ছেলের আর খোঁজ পাচ্ছিলেন না বকুল। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে গিয়ে তিনি ছেলের লাশ শনাক্ত করেন। খোকনের লাশ গতকাল মর্গ থেকে বুঝে নেন তাঁর ভাই রোকন মিয়া।

এদিকে রশিদ ঢালীর লাশ বুঝে নেন তাঁর ছেলে মাহবুব হাছান মামুন। তিনি জানান, নেত্রকোনা সদরের উত্তর নাগড়া এলাকায় পরিবারের সঙ্গে থাকতেন তাঁর বাবা। ব্যবসায়িক কাজে তিনি ঢাকায় এসেছিলেন।

নেত্রকোনা জেলা বিএনপির এক নেতা জানান, রশিদ ঢালী নেত্রকোনা পৌর বিএনপির সদস্য ও ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সভাপতি ছিলেন।

আংটি-জুতা দেখে লাশ শনাক্ত

ঢাকা রেলওয়ে থানার এসআই সেতাফুর রহমান জানান, আগুনে পুড়ে বিকৃত হওয়ায় চেহারা দেখে লাশ শনাক্ত করা সম্ভব ছিল না। স্বজনরা পরিধেয় জিনিসপত্র দেখে লাশ শনাক্ত করেন। যেমন– হাতের আংটি ও জুতা দেখে স্বজনরা জানান, লাশটি রশিদ ঢালীর। তাঁর কোমরে তসবিহ গোঁজা ছিল। একইভাবে মুখাবয়ব, শরীরের গড়নসহ অন্য চিহ্ন দেখে খোকনকে শনাক্ত করেন স্বজনরা। তারা জানান, মা ও শিশুসন্তানকে ট্রেন থেকে নামানোর পর তিনি আবার ট্রেনে উঠেছিলেন মালপত্র নেওয়ার জন্য। আর নামতে পারেননি। রেল পুলিশ জানায়, লাশ হস্তান্তর করা হলেও ডিএনএ নমুনা সংরক্ষণ করা হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা: পুলিশ

ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপারেশন) বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, যারা ট্রেনে আগুন দিয়েছে, দু-একটি বাস পুড়িয়ে হয়তো আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারছে না আন্দোলনকারীরা। তারা মনে করছে, এমন নৃশংস-পৈশাচিক ঘটনা ঘটাবে, যাতে আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়। তবে এটি তাদের বিকৃত মস্তিষ্কের বহিঃপ্রকাশ।

গতকাল বুধবার ডিএমপি সদরদপ্তরে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।

তিনি আরও বলেন, নির্বাচন বানচাল করতে যে গোষ্ঠী কাজ করছে, তারা ট্রেনে আগুন দেওয়ার ঘটনায় জড়িত থাকতে পারে। এ ঘটনা রেলওয়ে থানার অধীন। তবে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মামলাটি ডিএমপিতে আনা হবে।

সমকাল