সংকটের মধ্যে সরকারের ‘গাড়িবিলাস’

করোনাকালে দেশের অর্থনীতি সংকটে পড়েছিল। এখন চলছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধপরবর্তী সংকট। এই সংকটে সরকার মিতব্যয়িতা, অর্থাৎ কৃচ্ছ্রসাধনের ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু এর মধ্যেই চলছে সরকারি কর্মচারীদের জন্য গাড়ি কেনা।

সরকারি কর্মচারীদের সরকার সুদমুক্ত ঋণে গাড়ি দেয়। এর বাইরে নতুন করে জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) জন্য গাড়ি কেনা হচ্ছে। ১৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের জন্য গাড়ি কেনার প্রস্তাব জমা হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ে। প্রকৌশলী ও পুলিশের গাড়ি কেনার প্রস্তাবও জমা আছে।

সরকার গাড়ি কেনার ব্যয়সীমাও সম্প্রতি বাড়িয়েছে। এখন ৯৪ লাখ টাকার বদলে সর্বোচ্চ ১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা দামের গাড়ি কেনা যাবে।

যদিও সরকার টাকার সংকটে রয়েছে। কয়েকটি খাতে ভর্তুকির অর্থ যথাসময়ে দেওয়া হচ্ছে না। জ্বালানি খাতে ভর্তুকি তুলে নেওয়া হয়েছে। সারে ভর্তুকি কমাতে দাম বাড়ানো হয়েছে দুই দফা। বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়ানো হয়েছে দফায় দফায়। চিনি ও ভোজ্যতেলের মতো কিছু খাদ্যপণ্যে শুল্কছাড়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব নাকচ করে দেওয়া হয়েছে।

এখন ডলার–সংকট চলছে। এই সময়ে গাড়ি কেনা অগ্রাধিকারে থাকা উচিত নয়। আর কঠিন সময় না হলে সরকারি কর্মচারীদের গাড়ি দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠত না। প্রশ্ন উঠছে কারণ, মানুষ কষ্টে আছে।

সেলিম রায়হান, অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

কৃচ্ছ্রসাধনের জন্য চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের আওতায় সরকারি দপ্তরে সব ধরনের যানবাহন কেনা বন্ধ থাকবে বলে গত জুলাইয়ে পরিপত্র জারি করে অর্থ মন্ত্রণালয়। পরিপত্রে বলা হয়েছিল, ১০ বছরের পুরোনো গাড়ি প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে অর্থ বিভাগের অনুমোদন নিতে হবে।

গাড়ি কেনা বন্ধের কথা জানিয়ে ২০২০ সালের জুলাইয়ে এবং ২০২২ সালের জুলাইয়ে দুটি পরিপত্র জারি করেছিল অর্থ বিভাগ।

অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি চাকরিজীবী ও সাধারণ মানুষ একই পরিবার। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সরকারি চাকরিজীবীরা বেশি গুরুত্ব পাচ্ছেন। তিনি বলেন, বাজেটে সরকার কৃচ্ছ্রসাধনের ঘোষণা দিয়েছিল। ব্যয় কমানোর দুটি খাতের একটি পরিচালন ব্যয়ে কাটছাঁট, অন্যটি উন্নয়ন ব্যয়ে অগ্রাধিকার ঠিক করা। তবে ভ্রমণ, ভবন, গাড়ি, আপ্যায়ন ইত্যাদি খাতে ব্যয় খুব একটা কমানো গেছে, তা দেখা যাচ্ছে না। উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রেও মিতব্যয়ী হওয়ার লক্ষণ অনুপস্থিত।

ডিসি ও ইউএনওদের জন্য ২৬১টি নতুন গাড়ি কিনতে ৩৮০ কোটি টাকা ব্যয়ের একটি প্রস্তাবে গত ২৭ আগস্ট অনুমোদন দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। ৬৪ জেলার মধ্যে ৬১ জেলার ডিসিরা পাবেন নতুন গাড়ি। আর ইউএনওদের জন্য কেনা হচ্ছে ২০০টি গাড়ি। শর্ত শিথিল করে তাঁদের ২৭০০ সিসির (ইঞ্জিনক্ষমতা) গাড়ি দেওয়া হচ্ছে, যা গ্রেড-১ ও ২ (সচিব ও অতিরিক্ত সচিব) পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের প্রাধিকার।

১৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের জন্য নতুন গাড়ি কিনতে ২০ কোটি টাকা চেয়ে ১১ সেপ্টেম্বর অর্থ বিভাগকে চিঠি দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)।

গাড়ি চান স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপজেলা প্রকৌশলীরাও। তাঁরা চান ৪৩৩টি গাড়ি। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির গত ২৭ আগস্টের একটি বৈঠকের কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, ওই প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পায়নি। তাই রাজস্ব বাজেট থেকে ক্রমান্বয়ে কেনা হবে।

পুলিশ গত বছর সেপ্টেম্বরে গাড়িসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম কিনতে একটি প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে। এর মধ্যে গাড়ি কিনতে চাওয়া হয়েছে ২২৬ কোটি টাকা।

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, কাজকর্মের জন্য গাড়ি দরকার আছে। এখন যেসব গাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে, সেগুলো প্রতিস্থাপন করা যায়। নতুনভাবে কাউকে প্রাধিকারভুক্ত করার সময় এখন নয়।

৬৪ জেলার মধ্যে ৬১ জেলার ডিসিরা পাবেন নতুন গাড়ি। আর ইউএনওদের জন্য কেনা হচ্ছে ২০০টি গাড়ি।

সুদমুক্ত ঋণে গাড়ি

সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে যুগ্ম সচিব থেকে শুরু করে ওপরের পদের কর্মকর্তারা প্রাধিকারপ্রাপ্ত হিসেবে সরকারি গাড়ির সুবিধা পেতেন। ২০১৮ সালে সরকার উপসচিব পর্যায় থেকে গাড়িসুবিধা দেওয়া শুরু করে। নীতিমালা জারি করা হয় ২০১৭ সালে। পরে সেটি সংশোধন করে বলা হয়, উপসচিব পদে তিন বছর চাকরি করার পর গাড়ির প্রাধিকারভুক্ত হবেন কর্মকর্তারা।

‘প্রাধিকারপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের সুদমুক্ত ঋণ এবং গাড়িসেবা নগদায়ন নীতিমালা, ২০২০ (সংশোধিত)’ অনুযায়ী, কর্মকর্তারা গাড়ি কিনতে ৩০ লাখ টাকা সুদমুক্ত ঋণ পান। তবে রক্ষণাবেক্ষণ, তেল খরচ ও চালকের বেতন বাবদ মাসে ৫০ হাজার টাকা দিচ্ছে সরকার।

যেসব সরকারি কর্মকর্তা গাড়ির প্রাধিকারপ্রাপ্ত হন, তাঁদের সরকারি যানবাহন অধিদপ্তর (পরিবহন পুল) থেকে গাড়ি ব্যবহারের সুবিধা দেওয়ার কথা। কিন্তু সরকার বিকল্প হিসেবে বিনা সুদে গাড়ি কেনার জন্য ঋণ দিচ্ছে। নীতিমালা অনুযায়ী, ঋণের অর্থ সর্বোচ্চ ১২০টি সমান কিস্তিতে আদায়যোগ্য। প্রতি মাসে বেতন থেকে এই কিস্তি কাটা শুরু হবে।

আরও পড়ুন

‘তবে’ দিয়ে সরকারি কর্মচারীদের বিদেশ ভ্রমণের শর্ত শিথিল

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, গাড়ি কিনতে বিনা সুদে ঋণ দেওয়া শুরুর পর প্রায় ২ হাজার ৩০০ কর্মকর্তা এই সুবিধা নিয়েছেন। এর মধ্যে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এই সুদমুক্ত ঋণসুবিধা নিয়েছেন ১ হাজার ২৩৪ কর্মকর্তা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে নিয়েছেন ৮৪৭ জন। মানে হলো, বেশির ভাগ কর্মকর্তা শুরুতেই সুবিধাটি নিয়েছেন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২০০ জনের মতো, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫৯ জন এবং সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২১ জন কর্মকর্তা বিনা সুদের ঋণ নিয়ে গাড়ি কিনেছেন।

কর্মকর্তাদের অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো, তাঁরা সরকারিভাবে সুদমুক্ত ঋণে গাড়ি কেনার পরও মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা সংস্থার গাড়ি ব্যবহার করেন। মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা থেকে অথবা প্রকল্পের গাড়ি সরকারি পরিবহন পুলে জমা না দিয়ে ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বিভিন্ন সময় প্রকল্পের গাড়ি পরিবহন পুলে জমা দেওয়ার জন্য নির্দেশনা দিয়েছে। তবে তাতে কেউ কান দেয়নি। সর্বশেষ গত ৮ ডিসেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সমাপ্ত উন্নয়ন প্রকল্পের যানবাহন সরকারি পরিবহন পুলে জমা দেওয়ার নির্দেশনা দেয়।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থাকে চিঠি দিয়েছে। এতে সাড়া যে পাওয়া যায়নি তা ফুটে ওঠে অধীন সংস্থাগুলোকে দেওয়া নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের একটি চিঠিতে। গত ৩০ আগস্টের ওই চিঠিতে বলা হয়, সমাপ্ত উন্নয়ন প্রকল্পের যানবাহনের তথ্য জরুরি ভিত্তিতে মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়ার জন্য গত ৪ জানুয়ারি অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু এখনো কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। চিঠিতে তথ্য পাঠানোর জন্য আবার অনুরোধ করা হয়।

সার্বিক বিষয়ে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

ডলারের সংকট, টাকার অভাব

২০২০ সালের মার্চে দেশে করোনা আক্রান্ত রোগী প্রথম শনাক্ত হয়। এরপর শুরু হয় ‘বিধিনিষেধ’। তখন বেসরকারি খাতে ব্যাপক ছাঁটাই হয়েছে। বেতন কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। উৎসব ভাতা দিতে পারেনি অনেক প্রতিষ্ঠান। এরপর ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শুরু হয় রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ। এতে বিশ্ববাজারে জ্বালানিসহ প্রায় সব পণ্যের দাম বেড়ে যায়। আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ কমতে থাকে।

ঠিক দুই বছর আগে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ছিল ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। ১৩ সেপ্টেম্বর রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৭৬৩ কোটি ডলারে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ফর্মুলা অনুযায়ী হিসাবে রিজার্ভ রয়েছে ২ হাজার ১৭১ কোটি ডলার। আর ৮৬ টাকার ডলার এখন উঠেছে ১১০ টাকায়।

যে গাড়িগুলো কেনা হচ্ছে, সেগুলো আমদানি করতে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয় (প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ শুধু সংযোজন করে)। কিন্তু ডলারের অভাবে এখন শিল্পের কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি, খাদ্যপণ্য ইত্যাদির আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। নানা কড়াকড়ি আরোপ ও কর বাড়ানোর ফলে গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের আমদানি ব্যয় প্রায় ১৬ শতাংশ কমেছে।

সরকার টাকার অভাবেও রয়েছে। কারণ, রাজস্ব আদায় কম। ২০২২-২৩ অর্থবছরের জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) প্রায় ৩ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করেছে, যা লক্ষ্যের ৮৯ শতাংশ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, এখন ডলার–সংকট চলছে। এই সময়ে গাড়ি কেনা অগ্রাধিকারে থাকা উচিত নয়। আর কঠিন সময় না হলে সরকারি কর্মচারীদের গাড়ি দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠত না। প্রশ্ন উঠছে কারণ, মানুষ কষ্টে আছে।

সেলিম রায়হান আরও বলেন, এখন সমাপ্ত প্রকল্পের গাড়ি উদ্ধার করে প্রাধিকারভুক্ত কর্মকর্তাদের ব্যবহারের জন্য দেওয়া যেতে পারে।