- মাসুম খলিলী
- ১১ মে ২০২১
একের পর এক মেগা প্রকল্প নিতে গিয়ে বাংলাদেশ কি ঋণের ফাঁদে আটকে যাচ্ছে? স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে নানা ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হয়েছে। কিন্তু ৪০ বছরে দেশের যে বৈদেশিক দায়দেনা হয়েছে, গত ১০ বছরে হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি। এত দিন ধরে বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছিল বিশ্বব্যাংক, এডিবি এবং জাপানের মতো প্রতিষ্ঠান ও দেশের রেয়াতি ঋণ সহায়তায়। ফলে এই ঋণের সুদের বোঝা ছিল কম এবং পরিশোধের সময়সীমা ছিল দীর্ঘ। এখনকার বড় আকারের প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে তুলনামূলক স্বল্পমেয়াদি এবং বাণিজ্যিক শর্তে। এর ফলে এ মুহূর্তে হয়তো বিদেশী ঋণের দায় পরিশোধের অঙ্ক খুব বড় দেখাচ্ছে না। কিন্তু অচিরেই এটি অনেক বড় অঙ্কের বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে সরকারের ওপর।
অনেক অর্থনীতিবিদের শঙ্কা এভাবে ঋণ নিয়ে বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার অবস্থার দিকে এগোচ্ছে। দেশটি মধ্য আয়ের স্তরে যাওয়ার পর বাণিজ্যিক শর্তে ঋণ নিয়ে বন্দর ও মহাসড়কের মতো বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। কিন্তু এর দায় শোধ না করতে পেরে হাম্বানটোটার মতো সমুদ্রবন্দর চীনকে ৯৯ বছরের জন্য ইজারা দিতে হয়েছে। দেশটি যে রাজস্ব আয় করে তার ৯০ শতাংশ চলে যাচ্ছে বিদেশী দেনার দায় পরিশোধ করতে গিয়ে।
১১ বছরে বিদেশী ঋণ প্রায় তিন গুণ
২০০৯ সালে বাংলাদেশের মোট বিদেশী ঋণের স্থিতি ছিল ২৫.৩ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২০ সালের ডিসেম্বরে এসে দাঁড়িয়েছে ৭০.৭ বিলিয়ন ডলারে। ১১ বছরে বিদেশী ঋণ বেড়েছে ১৮০ শতাংশ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঋণ বৃদ্ধির এই হার অনেক বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২০ সালের ডিসেম্বরে যে ৭০.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশী ঋণ তা আগের মাত্র ৯ মাসে ১৬ শতাংশ বেড়েছে। মোট বৈদেশিক ঋণের মধ্যে সরকারি খাতের অংশ একই সময়ে ৪৪.৮ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫২.২ বিলিয়ন ডলারে। আর গত ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতের বিদেশী ঋণ আগের মার্চ মাসের চেয়ে ১২ শতাংশ বেড়ে ১৪.৮ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। ক্রেতাদের ঋণই বিদেশী দায়দেনাকে দ্রুত বৃদ্ধি করছে। এই সময়ে সরকারের সার্বভৌম গ্যারান্টি দেয়া ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩.৮ বিলিয়ন ডলার।
এর আগে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৯ সালে বাংলাদেশের মোট বিদেশী ঋণের স্থিতি ছিল ২৫.৩ বিলিয়ন ডলার, যা ২০১৯ সালে ১২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৭ বিলিয়ন ডলার। দেখা যাচ্ছে, এর পরের বছর ১৩ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি বিদেশী ঋণ বেড়েছে। স্বাধীনতার পর ৪০ বছর ধরে যে বিদেশী ঋণ জমা হয়েছে, এই এক বছরে বেড়েছে তার অর্ধেকেরও বেশি।
বাংলাদেশের মেগা প্রকল্প
বাংলাদেশের হঠাৎ করে বিদেশী দায়দেনা বেড়ে যাওয়ার পেছনে মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে উচ্চ ব্যয়সম্পন্ন মেগা প্রকল্পগুলোকে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে আবার ক্ষমতায় আসার পর কয়েকটি বড় প্রকল্পের কাজ শুরু করে এবং শেষ পর্যন্ত সরকারের অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্প হিসেবে এগুলো বাস্তবায়নে বিশেষ উদ্যোগও নেয়া হয়।
সরকারের এই মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে, পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প, ঢাকায় মেট্রোরেল প্রকল্প, পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্প, দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু হয়ে ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প, কয়লাভিত্তিক রামপাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, পায়রা বন্দর নির্মাণ প্রকল্প এবং সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প।
এর মধ্যে সাতটি মেগা প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে দুই লাখ ৭৪ হাজার ৫৩৬ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। এতে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ৮৭ হাজার ২৯৪ কোটি ৫৫ লাখ টাকা, বৈদেশিক সহায়তা থেকে এক লাখ ৮৫ হাজার ১২৩ কোটি ৩৩ লাখ টাকা এবং বাস্তবায়নকারী সংস্থার তহবিল থেকে দুই হাজার ১১৮ কোটি ৭৭ লাখ টাকা জোগান দেয়া হচ্ছে। প্রকল্পগুলোর জন্য শুরু থেকে গত জুলাই পর্যন্ত মোট খরচ হয়েছে এক লাখ ছয় হাজার ৫৭২ কোটি ১৬ লাখ টাকা।
সরকারের সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত পদ্মা সেতু প্রকল্প। ব্যাপক বিতর্ক আর আলোচনায় কয়েক বছরের বিলম্বের পর ২০১৪ সালে এই সেতুর নির্মাণকাজ নিজস্ব অর্থে সম্পন্ন করার ঘোষণা দেয় সরকার। সেতুটি ২০২১ সালের জুন নাগাদ যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ চলার কথা বলা হচ্ছে। এ সেতু নির্মাণে মোট ব্যয় হবে ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
২০২০ সালের প্রথম দিনে ঢাকার উত্তরার দিয়াবাড়ীতে মেট্রোরেলের বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন ও রেল ট্র্যাক বসানোর কাজ শুরু হয়। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল প্রকল্পের সাড়ে আট কিলোমিটার এমআরটি লাইন ৬ এখন দৃশ্যমান। ২০২১ সালের ডিসেম্বর নাগাদ এতে যাত্রী চলাচল শুরু করবে বলে আশা করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত এ প্রকল্পে মোট ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ২২ হাজার কোটি টাকা।
পদ্মা সেতু রেল সংযোগটি ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, নড়াইল ও যশোরের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের কথা। ২০১৮ সালের অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী মাওয়ায় পদ্মা সেতু ও রেল সংযোগ নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন। এই রেলপথের দৈর্ঘ্য মোট ১৭২ কিলোমিটার যশোর পর্যন্ত; যদিও অগ্রাধিকার হলো মাওয়া থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত। পুরো প্রকল্পের জন্য ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময় দেয়া আছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এই প্রকল্পের ব্যয় ৪০ হাজার ৮০ কোটি টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
বনের জায়গা নিয়ে সমস্যা হওয়ায় দোহাজারী-রামু-ঘুমধুম রেল প্রকল্পের কাজ শুরুতে বিলম্ব হলেও ইতোমধ্যে এর উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কাজ শেষ হয়েছে। নির্ধারিত ২০২২ সালের মধ্যেই এ প্রকল্পটি সম্পন্ন করার ব্যাপারে আশা প্রকাশ করা হয়েছে। ১০০ কিলোমিটার নতুন রেললাইন স্থাপনের জন্য ১৮ হাজার ৫০২ কোটি টাকার এ প্রকল্পের মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে ছয় হাজার কোটি টাকা আর বাকিটা জোগান দেবে এশীয়া উন্নয়ন ব্যাংক-এডিবি।
২০১৫ সালের ডিসেম্বরে পাবনার রূপপুরে দুই হাজার চার শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে রাশিয়ার এটমস্ট্রয় এক্সপোর্ট নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি সই করে সরকার। চুক্তি বাস্তবায়নের সময়কাল সাত বছর ধরা হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট ২০২৩ সালে এবং দ্বিতীয় ইউনিট ২০২৪ সালের অক্টোবরে উৎপাদনের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। এক লাখ এক হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে রাশিয়ার সহযোগিতায় বাংলাদেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের এই প্রকল্প তৈরি করা হচ্ছে পাবনার রূপপুরে, যেখানে দু’টি ইউনিটে ১২০০ মেগাওয়াট করে ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে।
মংলা-খুলনা মহাসড়কের পাশে বাগেরহাটের রামপালে প্রায় ১,৮৩৪ একর জমির ওপর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ করছে বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড এবং এতে ব্যয় হবে ১৬ হাজার কোটি টাকা। সরকারের প্রত্যাশা, ২০২১ সালের শেষ দিকেই রামপাল থেকে বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে আসতে শুরু করবে। শুরু থেকে এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নিয়ে বিতর্ক চলছে।
মহেশখালীর মাতারবাড়ী ও ধালঘাটা ইউনিয়নের এক হাজার ৪১৪ একর জমিতে মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পটি নির্মাণ করা হচ্ছে। ২০২৩ সালে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এর প্রকল্প ব্যয় ৩৫ হাজার ৯৮৪ কোটি ৪৫ লাখ টাকার মধ্যে জাপান সরকারের কাছ থেকে ঋণ সহায়তা হিসেবে পাওয়া গেছে ২৮ হাজার ৯৩৯ কোটি তিন লাখ টাকা।
পটুয়াখালীর পায়রা বিদ্যুৎ নির্মাণ প্রকল্প প্রকল্প পরিচালক জানান, এর প্রথম ইউনিটে ৬৬০ মেগাওয়াটের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। এরপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে মার্চ নাগাদ বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা। আর দ্বিতীয় ইউনিটের কাজ শেষে মে মাসে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে। তবে মোট ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎতের জন্য সরবরাহ লাইন তৈরি করার কাজ এখনো শেষ হয়নি। ফলে এখানে বিদ্যুৎ উৎপাদন হলেও তা কাজে লাগানো যাবে না।
২০১৩ সালে এক হাজার ১২৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকা ব্যয়ে পায়রা বন্দরের প্রথম টার্মিনাল নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিল। ২০১৮ সালের জুনের মধ্যে তা শেষ হওয়ার কথা ছিল। সরকারের লক্ষ্য, ২০২৩ সালের মধ্যে ১৬ মিটার গভীরতায় চ্যানেল ড্রেজিং সম্পন্ন করে পূর্ণাঙ্গ বন্দর সুবিধা গড়ে তোলা। গত বছরের মার্চে ওই টার্মিনাল নির্মাণের ব্যয় প্রায় দুই গুণ বাড়িয়ে তিন হাজার ৩৫০ কোটি টাকা আর সময় আরো দুই বছর বাড়ানো হয়। সর্বশেষ খবর অনুসারে পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর করা হচ্ছে না। এর পরিবর্তে এটাকে সমুদ্রবন্দর হিসেবে নির্মাণ করা হবে।
বাংলাদেশ কি ঋণফাঁদে আটকা পড়ছে?
‘ঋণফাঁদ কূটনীতি’ হলো একটি শক্তিশালী ঋণদানকারী দেশ বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক একটি ঋণগ্রহীতা দেশকে প্রচুর ঋণ দিয়ে আটকানো, যাতে দেশটি এর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ‘ঋণ-জাল কূটনীতি’ শব্দটি ভারতীয় বিশ্লেষক ব্রহ্ম চেলানি ২০১৭ সালের গোড়ার দিকে চালু করেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের ঋণ নীতিমালাকে দোষারোপ করার জন্য এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। অবশ্য চ্যাথাম হাউজ এবং প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় বলেছে, চীনা বিনিয়োগের প্রসঙ্গে ‘ঋণ-জাল কূটনীতি’র বিবরণটি মিথ্যা।
দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ঋণ জালে আটকা পড়া দেশ হিসেবে শ্রীলঙ্কার কথাই সবার আগে চলে আসে। বলা হয়, দ্বীপদেশটির পর পাকিস্তান ও বাংলাদেশ সেই পথে এগোচ্ছে। শ্রীলঙ্কায় হাম্বানটোটা বন্দর তৈরির জন্য চীন থেকে নেয়া ঋণকে ঋণ-জাল কূটনীতির উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। সরকারি মালিকানাধীন চীনা সংস্থা চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং সংস্থা এবং সিনোহাইড্রো করপোরেশনকে ৩৬১ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে বন্দর তৈরি করার জন্য নিয়োগ দেয়া হয়েছিল, যার ৮৫ শতাংশ অর্থায়ন ছিল চীনের এক্সিম ব্যাংকের, যার সুদ ছিল বার্ষিক ৩ শতাংশ। শ্রীলঙ্কার বন্দর কর্তৃপক্ষ ঋণের দায় পরিশোধে অক্ষম হলে বন্দরটি ২০১৭ সালে চীনা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চীন মার্চেন্টস পোর্ট হোল্ডিংস কোম্পানি লিমিটেডকে ৯৯ বছরের ইজারা দেয়া হয়। এতে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও ভারত উদ্বেগ প্রকাশ করে বলে যে, এই বন্দরটি চীনের ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীগুলোকে নজরে রাখতে চীনা নৌঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।
দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে পাকিস্তানে চীনা বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি। ১৯৫০ সাল থেকে পাকিস্তান বিশ্বব্যাংকের ৪২.৭ বিলিয়ন ডলার সহায়তা পেয়েছে যার মধ্যে ৩৩.৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ এবং ৯.৩ বিলিয়ন ডলার অনুদান। এটি বিশ্বব্যাংককে দেশটির পাবলিক কন্ট্রাক্ট অফার এবং স্টেট ব্যাংকের গভর্নর নিযুক্তির মতো সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব রাখার সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
পাকিস্তানের জন্য উদ্বেগের বিষয় হলো, দায়দেনার সাম্প্রতিক উল্লম্ফন। স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের তথ্যানুসারে, ২০১৭ সালে পাকিস্তানের চীনা ঋণ ছিল ৭.২ বিলিয়ন ডলার, যা এপ্রিল ২০১৮ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯ বিলিয়ন ডলারে আর ২০২০ সালে তা ৩০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। এর বেশির ভাগই ‘সিপিসিই’ প্রকল্পে ঋণ গ্রহণের কারণে এসেছে।
বিশেষজ্ঞদের অনুমান, চীনের এই ঋণ পরিশোধে পাকিস্তানের প্রায় ৪০ বছর সময় লাগবে। সিপিসি এবং এর ফলস্বরূপ চীনের ঋণ যে অর্থনৈতিক নির্ভরতা তৈরি করবে তা পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকিতে পরিণত হতে পারে। এ ছাড়া ২০১৭ সালে চীন ও পাকিস্তান ৫০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে পাঁচ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের জন্য একটি চুক্তি করেছে। পাকিস্তানি-আমেরিকান স্কলার হাসান আব্বাসের মতে, প্রকল্পের বিলম্বের কারণে এই ব্যয় বেড়ে হতে পারে ৯৮ বিলিয়ন ডলার। প্রতি বছরে প্রায় পাঁচ বিলিয়ন ডলারের সুদ জমা হওয়ার কারণে, পাকিস্তানকে ২০ বছরের মধ্যে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ডলার চীনকে দিতে হবে এবং জলবিদ্যুৎ ঋণ চীনকে পাকিস্তানের বিষয়ে প্রভাব বিস্তারে বিশেষ অবস্থান তৈরি করে দেবে। বাংলাদেশের মেগা প্রকল্পগুলোর সাথে শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের বৃহদাকার প্রকল্পের তুলনা করা হলে অনেক ক্ষেত্রেই এর মিল পাওয়া যায়।
বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন?
অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, মেগা প্রকল্পগুলোর অর্থায়ন, স্বচ্ছ অর্থনৈতিক কার্যক্রম, দুর্বল রাজস্ব আদায় এবং সরকারের কোভিড-সংক্রান্ত ব্যয়ের কারণে বিদেশী ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা এই ঋণের খেলাপি হওয়া এড়াতে ধার করা তহবিলের যথাযথ ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন। বিদেশী ঋণের দায় সময় মতো পরিশোধে অক্ষমতা দেশের ক্রেডিট রেটিংকে নামিয়ে দিতে পারে। এ ছাড়াও বিদেশী উৎস থেকে এ জাতীয় উচ্চঋণ নেয়ার অনেক ঝুঁকি রয়েছে। সীমিত আয় দিয়ে ঋণের দায় পরিশোধে বাংলাদেশ সমস্যার মুখোমুখি হতে পারে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, জিডিপির তুলনায় বিদেশী ঋণ এখনো কম। তবে ক্রমবর্ধমান ঋণের দায় মেটানোতে বাংলাদেশের সম্পদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিদেশী ঋণের পরিমাণ জিডিপির প্রায় সমান। তবে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির এই দেশ অনেক বেশি কর আদায় করে থাকে। সুতরাং, ঋণের দায় পরিশোধে কোনো সমস্যা তারা অনুভব করে না। অন্য দিকে বাংলাদেশের কর আদায় অনেক নিচু পর্যায়ে রয়েছে। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের তুলনার কোনো যৌক্তিকতা নেই।
ড. মনসুর বলেন, ঋণের একটি বড় অংশ সারা দেশে বাস্তবায়িত হওয়া মেগা প্রকল্পগুলোতে ব্যয় করা হচ্ছে। বিদেশী ঋণের মাধ্যমে অনেক বড় বড় প্রকল্পের অর্থায়ন করায় পরিস্থিতি আরো খারাপ হচ্ছে। অথচ বর্তমানে নির্মাণাধীন বেশির ভাগ বড় প্রকল্পের কোনো আর্থিক আয় হবে না। সুতরাং ঋণের দায় আরো বাড়বে।
অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেছেন, কোভিড-১৯-এর কারণে ২০২০ সালে ঋণ বেড়েছে। বহুপক্ষীয় প্রতিষ্ঠান থেকে নেয়া ঋণের একটি বড় অংশ কোভিড-১৯ সম্পর্কিত পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য। ঋণের উদ্দেশ্য ঠিক আছে; তবে আমরা যদি অর্থ সঠিকভাবে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হই, তাহলে এটি অর্থনীতিতে একটি অপ্রয়োজনীয় বোঝা তৈরি করবে।
ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তফা কে. মুজেরির মতে, সরকারের বিদেশী ঋণ কমানোর এটাই সর্বোচ্চ সময় । অন্যথায় এটি জাতির জন্য একটি বড় বোঝা হয়ে উঠতে পারে। বিদেশী উৎস থেকে অনেক বেসরকারি সংস্থাও ঋণ নিয়ে আসায় বাংলাদেশের বৈদেশিক দায় বাড়ছে। অতীতে বিদেশী ঋণের অপব্যবহারের অনেক নজির রয়েছে। আর এর ফলে ঋণের দায় পরিশোধে যেকোনো ব্যর্থতা দেশের ক্রেডিট রেটিংকে কমিয়ে দেবে।
সঙ্কট কোথায়?
বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে মেগা প্রকল্পগুলোকে সরকারের মর্যাদার প্রতীক বানানো হয়েছে। এসব প্রকল্প যেহেতু উন্নয়নের দৃশ্যমান কাঠামো হিসেবে কাজ করে তাই এগুলোকে রাজনৈতিক প্রচারণার হাতিয়ার করা সহজ। এর মধ্যে কিছু প্রকল্প রয়েছে অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হিসেবে বিবেচিত। আর কিছু প্রকল্পের আর্থিক গ্রহণযোগ্যতার জন্য প্রচ্ছন্ন সুবিধা লাভের জন্য বা পরোক্ষ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিবেচনা করে ‘লাভজনক’ হবে বলে যুক্তি দেখানো হয়েছে। এসব বৃহদাকার প্রকল্প অনুমোদনকালে এর অর্থনৈতিক লাভজনকতার বিষয় প্রকাশ করা হয় না। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রকল্প অনুমোদনের সময় যে অর্থের কথা বলা হয়, পরে বারবার সংশোধনের মাধ্যমে এর খরচের অঙ্ক কয়েকগুণ বাড়ানো হয়। তখন প্রাথমিক লাভ-ক্ষতির যে হিসাব সেটি ঠিক থাকে না।
সাধারণভাবে যেকোনো প্রকল্প গ্রহণের সময় এর ব্যয়ের সাথে অর্থনৈতিক সুবিধা বিশ্লেষণ করা হয়। যেমন পদ্মা সেতুতে যদি ৩০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয় তাহলে এর মোট মেয়াদে যানবাহন চলাচল থেকে যে রাজস্ব পাওয়া যাবে তা প্রকল্প ব্যয় এবং এর জন্য সুদ পরিশোধের মিলিত অঙ্কের চেয়ে বেশি হতে হবে। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের সময় এই হিসাব করা হলেও শেষ পর্যন্ত কোনো ক্ষেত্রেই এটি ঠিক থাকে না।
মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে বড় একটি অংশ হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প। দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ও সরবরাহের সম্ভাব্য দীর্ঘমেয়াদি যে দৃশ্যপট সামনে রেখে এই প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়েছে সেই সম্ভাব্যতা এখন ঠিক নেই। ফলে এর মধ্যে ছোটখাটো অনেক বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিদ্যুৎ না নিয়েই সরকারকে এর বিল দিতে হচ্ছে। পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের মতো বৃহদাকার প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে একই অবস্থা হলে তা অর্থনীতির জন্য অনেক বড় চাপ হয়ে দাঁড়াবে।
মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের জন্য যেসব দেশের সাথে চুক্তি করা হয়েছে তার মধ্যে চীন জাপান ভারত ও রাশিয়া প্রধান। এর বাইরে বিশ্বব্যাংক ও এডিপি রয়েছে অর্থায়নকারী সংস্থা হিসেবে। মেগা প্রকল্পগুলো দীর্ঘ মেয়াদে বাস্তবায়ন হতে থাকায় চুক্তিবদ্ধ দেশগুলো যেকোনো রাজনৈতিক পরিবর্তন বা অস্থিরতার ক্ষেত্রে সরকারকে রক্ষায় সচেষ্ট থাকে। আর এসব প্রকল্প তাদের সাথে রাজনৈতিক ও কৌশলগত বোঝাপড়ার হাতিয়ার হিসাবে কাজে লাগানো হয়।
অর্থনৈতিক বিবেচনার বাইরে এই ধরনের কৌশলগত ও রাজনৈতিক বিবেচনা যখন স্থান পায়, তখন এসব প্রকল্পের এক দিকে খরচ ও মান প্রতিযোগিতামূলক থাকে না, অন্য দিকে অথনৈতিক লাভের বিষয়টি নিশ্চিত হয় না। আর প্রকল্পের অর্থায়ন রাষ্ট্রের ওপর এমন দীর্ঘমেয়াদি দায় তৈরি করে যা সে প্রকল্পের সুবিধা থেকে পরিশোধ করা যায় না। সার্বিকভাবে দেশের মানুষের ওপর এই দায় চেপে বসে। শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান, দুই দেশের ক্ষেত্রেই এটি দেখা গেছে। বাংলাদেশও সেই ধরনের ‘একটি ঋণফাঁদের দিকে এগোচ্ছে বলে মনে হয়; যদিও সরকারিভাবে বিদেশী ঋণ এবং জিডিপির অনুপাত এবং রফতানি আয়ের সাথে ঋণের দায় পরিশোধের অনুপাত দেখিয়ে বলা হচ্ছে, এটি আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য মাত্রার অনেক নিচে। অতএব, বাংলাদেশের কোনো বিপদ নেই।’ কিন্তু এই দায় যেভাবে বাড়ছে এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন ব্যয় যেভাবে তুলনীয় দেশের চেয়ে দ্বিগুণ তিন গুণ হচ্ছে, তাতে অচিরেই বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতিতে পড়তে পারে। এক প্রকল্পের দায় শোধ করতে আরেক প্রকল্প গিলতে হবে যার কোনোটাতেই জাতীয় স্বার্থ বিবেচনার সে রকম সুযোগ থাকবে না।