এক ভারতীয় ভাইয়ের প্রশ্ন: ১৯৭১ সালে ১ কোটি বাংলাদেশি শরনার্থীদের জন্য ভারতের দুর্বল অর্থনীতি যে বোঝা টেনেছিল

কিছু তথ্য দিয়ে উত্তরটি দিলাম। শেষ পর্যন্ত পড়ে যান আশা করি উত্তরটি বুঝতে পারবেন।
প্রথমেই ১) দূর্বল অর্থনীতি নিয়ে শরণার্থী বোঝা, ২)যুদ্ধে ভারতের প্রাপ্ত লভ্যাংশ,৩) ভারতীয় সেনাদের বাংলাদেশ লুট ৪)কেন বৈধ নয় তার ব্যাখা করছি। সবশেষে, বাংলাদেশ কি করেছে ভারতের জন্য।
১. দূর্বল অর্থনীতি নিয়ে শরণার্থী বোঝাঃ
এটি সত্য। তখন ভারতের অর্থনীতি একদমই ভালো ছিল না। তার উপর প্রায় ১ কোটি শরণার্থী দেখাশোনা,খাওয়া দাওয়া ইত্যাদির বোঝা টানা। অনেক ভারতীয় মনে করেন ভারত নিজে একাই এই মহানুভবতার কাজটি করেছে। যেটি একটি ভুল ধারণা। এই শরণার্থীদের জন্য কিন্ত ভারতকে বিদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ কোটি ডলারের সাহায্যসহ জাতিসংঘের অনেক অনুদান এসেছে। যার অর্থ পরিমাণ নিচে ছবিতে দেওয়া হল। এটা নিতান্তই কম নয়। ৯ মাস হিসেবে যথেষ্ট। তাছাড়া বাংলাদেশ স্বাধীন হবার ফলে ভারতের যে বড় একটা ভৌগলিক,অর্থনৈতিক লাভ হয়েছে তার জন্য এইটুকু কষ্ট ভারতকে করতেই হত।প্রমাণ: চিত্রে দেওয়া আছে।
২.ভারতের প্রাপ্ত লভ্যাংশঃ
যুদ্ধে পাকিস্থান আত্নসমর্পন করে যৌথ কমান্ডের কাছে। এর কারণ ছিল যদি শুধু মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্নসমর্পন করে যারা একটি মিলিশিয়া তবে পাকিস্থানি সেনাদের কচুকাটা করতো মুক্তিবাহিনী। তাই পাকিস্থান ভারতের কাছে আত্নসমর্পন করে যেন ভারত জেনেভা চুক্তি অনুযায়ী পাকিস্থানিদের পাকিস্থানে নিরাপত্তার সাথে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য থাকে।যদিও চুক্তিতে ভারত ও বাংলাদেশ উভয়েরই নাম উল্লেখ ছিল। এসবের বিনিময়ে ভারতকে পাকিস্থান একটি খুবই ভারী অংকের টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেয়। যা ভারত একাই নিয়ে নেয়। বাংলাদেশকে এর কোন ভাগ দেয়া হয়নি।যদিও বাংলাদেশের এই ক্ষতিপূরণ দরকার ছিল বেশি।বাংলাদেশ দীর্ঘ ৯ মাসের রণক্ষেত্রে ধ্বংসের স্তুপে পরিনত হয়েছিল। যুদ্ধ তো চলছিল পাকিস্থান আর মুক্তিবাহিনী বা বাংলাদেশের। কিন্তু বাংলাদেশ এ নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য করেনি যেহেতু মুক্তিবাহিনী কে অস্ত্র ও শরণার্থীদের সাহায্য করেছে ভারত।
ভারতীয় অফিসিয়াল হিসেবে মোতাবেক পাকিস্তানের কাছ থেকে ভারত সর্বমোট ৫৪৩ কোটি ৫১ লাখ ১৪ হাজার দুইশত চুরানব্বই রুপি ক্ষতিপূরণ আদায় করে।
প্রমাণ: চিত্রে দেওয়া আছে।
উক্ত ছবিটি Official history of the 1971 India Pakistan War নামের নথি থেকে নেয়া হয়েছে। ১৯৯২ তে history Division of the Ministry of Defence of India লেখা।
৩.ভারতীয় সেনার বাংলাদেশে লুটপাট-
ভারত পরবর্তীতে পাকিস্তানীদের ফেলে যাওয়া সকল অস্ত্র এবং ৮৭ টি ট্যাংক নিয়ে যায় যার মূল্য ৭৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। নিজের চোখে দেখা এসব কর্মকান্ডে খুলনার ডিসি কামাল সিদ্দিকি তার বইতে লিখেন ভারতীয় সৈন্যদের লুটপাটের মধ্যে অস্ত্র ছাড়াও ছিল :-
১)মজুদকৃত খাদ্য শস্য,
২)কাঁচা পাট,
৩)সুতা,
৪)গাড়ি,
৫)জাহাজ,
৬)শিল্প প্রতিষ্ঠানের মেশিন ও যন্ত্রাংশ এবং অন্যান্য খাদ্য দ্রব্য।
কামাল উদ্দিন সিদ্দীকি লন্ডন ইউনিভার্সিটিতে করা তার পিএইচডি থিসিসে বাংলাদেশের দরিদ্রতার কারণ হিসেবে বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। তার থিসিসটি পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকারের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান থেকে বই আকারে বের হয়।
কামাল সিদ্দীকির বই- The political economy of rural poverty in Bangladesh / Kamal Siddiqui (Dacca : National Institute of Local Government, 1982) (1st ed.) Page: 427
প্রমাণ: চিত্রে দেওয়া আছে।
কামাল সিদ্দিকীর মতে সব মিলিয়ে কম করে ধরলেও এই লুটপাটের পরিমাণ কেবল খুলনা জেলাতে ছিল তৎকালীন হিসেবে ২.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সারা বাংলাদেশের ১৯টি জেলা থেকে লুটাপাটের পরিমাণ কেমন হতে পারে সেটা অনুমান অসম্ভব নয়।
প্রমাণ: চিত্রে দেওয়া আছে।
২১শে জানুয়ারি ১৯৭২ সালে ব্রিটেনের বিখ্যাত গার্ডিয়ান পত্রিকায় সাংবাদিক মার্টিন ঊলাকট (Martin Woollacott) Indians ‘loot whole factory ‘শিরোনামে লেখায় লিখেন ;
“Systematic Indian army looting of mills, factories and offices in Khulna area has angered and enraged Bangladesh civil officials here. The looting took place in the first few days after the Indian troops arrived in the city on December 17” (Martin Woollacott, Indians ‘loot whole factory, The Guardian, Jan 22, 1972).
প্রমাণ: নিচে চিত্রে দেওয়া আছে।
৪.কেন বৈধ নয়ঃ
১) ভারত বাংলাদেশের কাছে কোন প্রকার ক্ষতিপূরণ চাইতে পারে না। কারণ দুই দেশের মধ্যে এরকম কোন চুক্তি হয় নি যার ভিত্তিতে ভারত এরকম কিছু দাবি করবে।
২) ভারত পূর্ব-পাকিস্থান এ প্রবেশ করেছিল এবং পাকিস্থানি সেনা দ্বারা প্রতিহতে অনেকে নিহত হয়ে ছিল। তাই ভারতের সেনাদের ক্ষতিপূরণ পাকিস্থান দেবার কথা বাংলাদেশ নয়।
৩) ইতিহাস থেকে এটা স্পষ্ট যে বাংলাদেশ ভারতকে পূর্ব পাকিস্থান হামলার জন্য কোন সুবিধা বা কিছু দিবে বলে অঙ্গীকার করে নি।
৪) পূর্ব-পকিস্থান হামলা ভারতের নিজস্ব সিধান্ত ছিল এবং ভারত বাংলাদেশ হামলা করেছিল কারণ ৩ ডিসেম্বর পাকিস্থান ভারতের ১১ টি বিমান ঘাটিতে একসাথে হামলা চালিয়ে ছিল। তাই ভারত পূর্ব পাকিস্থানে হামলা করতে আন্তর্জাতিক কোন বাধা থাকে নি।
৫) ভারত যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সাথে মিত্রবাহিনী হিসেবে যোগ দিয়েছিল কিন্তু যুদ্ধে জয়ী হবার পর পাকিস্থানের ক্ষতিপূরণ নিজে একা গিলে ফেলে। বাংলাদেশকে কিছুই দেয় নি। তাই বাংলাদেশ উল্টো সেই পাকিস্থান প্রদত্ত অর্থের থেকে নিজে কিছু দাবি করতে পারে। কারণ যুদ্ধ কেবল আপনি একা লড়েন নি আমাদের মুক্তিযুদ্ধারাও লড়ে ছিলো।
লেখক- Aslam Mahmud