অনলাইন ডেস্ক
০৩ মে ২০২৩ dailyinqilab.com
বৈদেশিক মুদ্রার সংকট মেটাতে রিজার্ভ থেকে প্রতিনিয়তই বাজারে ডলার ছাড়তে হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংককে। পাশাপাশি পরিশোধ করতে হচ্ছে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) বিল। এতে দেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভে বড় ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে। বর্তমানে রিজার্ভ আছে ৩০ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলার। চলতি সপ্তাহে আকু বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ নামবে ২৯ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলারে। ফলে সাত বছর পর রিজার্ভ ৩০ বিলিয়নের নিচে নেমে আসছে। এর আগে ২০১৫-১৬ অর্থবছর শেষে রিজার্ভ ছিল ৩০ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, এ রিজার্ভ দিয়ে পাঁচ মাসের কিছু বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে। তবে আইএমএফের হিসাবে ব্যবহারযোগ্য যে রিজার্ভ রয়েছে তা দিয়ে চার মাসের আমদানি ব্যয়ও মেটানো যাবে না। এতে দেশে বিদেশি মুদ্রার সংকট আরও প্রকট আকার ধারণ করবে।
এদিকে আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী, আগামী জুনে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ থাকতে হবে ২৪ বিলিয়ন ডলার। এ শর্তপূরণে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলে (ইডিএফ) থেকে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার কমিয়ে আনা হয়েছে। তবুও আকু বিল পরিশোধের পর ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ নেমে আসছে ২২ বিলিয়নে। বিশ্লেষকরা বলছেন, আমদানি কমানো ও রপ্তানি বৃদ্ধি করা না গেলে চলতি বছরের শেষ নাগাদ বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়তে হবে বাংলাদেশকে।
এদিকে একধাপেই ডলারের দাম ১ টাকা ৫০ পয়সা বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গতকাল মঙ্গলবার ডলারপ্রতি ১০৪ টাকা ৫০ পয়সায় দরে ব্যাংকগুলোর কাছে ৫৬ মিলিয়ন ডলার বিক্রি করে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণ সংস্থাটি। এতে রিজার্ভ নেমে দাঁড়ায় ৩০ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলার। এর আগে ব্যাংকগুলোর কাছে ১০৩ টাকায় ডলার বিক্রি হচ্ছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি সূত্র বলছে, আগামী জুনের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম ১০৬ টাকায় তুলবে। আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী ডলারের একক রেট বাস্তবায়নেই এমন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে হলে ডলারের রেট বৃদ্ধির বিকল্প নেই। অর্থাৎ বাজারে পণ্যের সংকট তৈরি না করে যদি দাম বৃদ্ধি পায় তাহলে বাজার অস্থিতিশীল হয় না। আবার মানুষ তাদের সাধ্য অনুযায়ী ক্রয় কমিয়ে দেয়। ঠিক একইভাবে ডলারের সরবরাহ ঠিক রেখে দাম বৃদ্ধি করলে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হবে না। আবার বাজারে ডলারের চাপও কমে আসবে।
আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব থেকে আরও ৬ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার বাদ দিতে হবে। তাহলে রিজার্ভ দাঁড়াবে ২২ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার।
আকু হলো একটি আন্তঃদেশীয় লেনদেন নিষ্পত্তি ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, নেপাল ও পাকিস্তানের মধ্যকার লেনদেনের দায় পরিশোধ করা হয়। এ ব্যবস্থায় সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতি দুই মাস অন্তর সুদসহ আমদানির অর্থ পরিশোধ করে। ইরানের রাজধানী তেহরানে আকুর সদর দপ্তর। দায় পরিশোধের মতো রিজার্ভ না থাকায় গত বছরের অক্টোবরে আকু থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে চরম আর্থিক সংকটে থাকা শ্রীলঙ্কা।
ব্যাংকারদের মতে, বৈশ্বিক মুদ্রাবাজারে স্বস্তি ফেরাতে আমদানি দায় কমানোর উদ্যোগের মধ্যেও সংকট যায়নি। নতুন এলসি কমলেও আগের দায় পরিশোধের চাপ রয়েছে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে। এ কারণে সংকট কাটছে না অর্থনীতিতে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আইএমএফের ঋণের প্রথম কিস্তি ছাড়ের পর গত ২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল্যায়ন ও শর্ত বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে আইএমএফ। সেখানে বাংলাদেশের নিট রিজার্ভ কখন কত হবে, তার প্রক্ষেপণ দিয়েছে সংস্থাটি।
আইএমএফের মতে, জুনে রিজার্ভ বেড়ে হবে ২৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার। আর সেপ্টেম্বরে ২৫ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার এবং ডিসেম্বরে ২৬ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়াবে রিজার্ভ। এ ছাড়া চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষে বাংলাদেশের গ্রস রিজার্ভ কমে ৩০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়াবে। তবে পরের অর্থবছরের থেকে ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকবে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রিজার্ভ বেড়ে ৩৪ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে উঠবে। আর ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৪০ বিলিয়ন ডলার এবং ২০২৫-২৬ অর্থবছের ৪৬ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়াবে। কিন্তু ধারাবাহিকভাবে রিজার্ভ থেকে বাজারে ডলার সরবারহ করায় আগামী জুনে রিজার্ভ ২৪ বিলিয়নে ওঠা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
আইএমএফ মনে করে, বাংলাদেশ তাদের ঋণ না নিলে রিজার্ভের অবস্থা আরও খারাপ হতো। এ ঋণের ফলে ধীরে ধীরে বাংলাদেশের রিজার্ভ উন্নত হবে। তবে আইএমফের ঋণ না নিলে বিদ্যমান নিট রিজার্ভ দিয়ে আড়াই মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া তথ্যমতে, ২০২২ সালের মে মাসে দেশের রিজার্ভ ছিল ৪২ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরের শুরুতে তা নেমে দাঁড়ায় ৪১ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলারে। ডলার বিক্রি, আকু বিল পরিশোধসহ নানা কারণে ১ ফেব্রুয়ারি রিজার্ভ নেমে যায় ৩২ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলারে। গত ২ ফেব্রুয়ারি রাতে আইএমএফের ঋণের ৪৭৬.১৭ মিলিয়ন বা ৪৭ কোটি ৬১ লাখ ডলার রিজার্ভের সঙ্গে যুক্ত হয়। এতে রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়ায় ৩২ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু বাজারের ডলার সংকট কমাতে অব্যাহত ডলার বিক্রির কারণে গতকাল রিজার্ভ নেমেছে ৩০ দশমিক ৮৭ বিলিয়নে। অর্থাৎ গত এক বছরে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে ১৩ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১৬ সালের এপ্রিলে প্রথমবারের মতো ২৯ বিলিয়ন ডলারের ঘর অতিক্রম করে রিজার্ভ। ওই অর্থবছরের শেষে রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। সাত বছর পর আবারও ২৯ বিলিয়নের ঘরে নেমে আসছে রিজার্ভ।
ডলারের সংকট কাটাতে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সেও ডলারের দাম ১ টাকা বাড়িয়ে ১০৮ টাকা করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আর রপ্তানি বিল পরিশোধে ১ টাকা বাড়িয়ে ১০৬ টাকা করা হয়েছে। গত রবিবার বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) এক ভার্চুয়াল সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।