- সৌমদীপ সেন
- ২১ অক্টোবর ২০২২, ১৯:৩৪
ভারতের হিন্দু ডানপন্থীরা দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বজুড়ে তাদের রূপকল্পের কথা বলে আসছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টি বিজেপির বিদেশী শাখাগুলো এতে সহায়তা করছে। যেমন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বা ওয়ার্ল্ড হিন্দু কাউন্সিলের মতো মিত্র গোষ্ঠীগুলোও সাহায্য করছে। যুক্তরাজ্যের লেস্টারে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো ইঙ্গিত দেয়, তাদের হিন্দুত্ববাদ প্রচারের স্বপ্ন, তাদের রাজনৈতিক দর্শন ভারত থেকে সুদূরে নগরগুলোর রাস্তায় নতুন পন্থায় অর্থাৎ সহিংসভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে।
১৭ সেপ্টেম্বর তরুণ হিন্দুরা ‘জয় শ্রী রাম’ স্লোগান (যা এখন একটি হিন্দু জাতীয়তবাদী গোষ্ঠীর যুদ্ধের স্লোগান) দিতে দিতে লেস্টারের রাস্তায় মিছিল করে ও মুসলমানদের ওপর আক্রমণ চালায়। উত্তেজনা আপাতত বন্ধ করা হয়েছে। মে মাসে বিনা প্ররোচনায় হিন্দু জনতার আক্রমণে আহত এক মুসলিম যুবককে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল। আগস্টে একটি ক্রিকেট ম্যাচে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের জয়ের পর একটি হিন্দু গ্রুপ একজন শিখ ব্যক্তিকে আক্রমণ করার আগে রাস্তায় ‘পাকিস্তান মুরদাবাদ’ ‘পাকিস্তানের মৃত্যু হোক’ স্লোগান দিয়ে মিছিল করছিল। দুই দেশের মধ্যে দ্বিতীয় ক্রিকেট ম্যাচের পরও একই ধরনের খবর পাওয়া গেছে, যেটাতে ভারত হেরেছিল। প্রতিক্রিয়াস্বরূপ মুসলমান পুরুষদের একটি দলও বিক্ষোভ করেছে। উদাহরণস্বরূপ একজন ব্যক্তি একটি হিন্দুধর্মীয় কেন্দ্রের বাইরে থেকে একটি পতাকা নামিয়ে ফেলেছে।
এটি অবশ্য ঠিক যে, যুক্তরাজ্যে হিন্দু জাতীয়তাবাদী ও কনজারভেটিভ পার্টির যৌথভাবে চলার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ২০১৬ সালের লন্ডনের মেয়র নির্বাচনের আগে কনজারভেটিভ প্রার্থী জ্যাক গোল্ডস্মিথ তার মুসলিম প্রতিপক্ষ লেবার পার্টির প্রার্থী সাদিক খানকে নিচু করে দেখানোর জন্য হিন্দু ও শিখদের কাছে মুসলিমবিরোধী প্রচারপত্র পাঠান। ২০১৯ সালের যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে এমন খবর শোনা গিয়েছিল যে, দেশের হিন্দু জাতীয়তাবাদী দলগুলো কনজারভেটিভ প্রার্থীদের পক্ষে সক্রিয়ভাবে প্রচারণা চালাচ্ছে। কেননা, লেবার পার্টির তৎকালীন নেতা জেরেমি করভিন ভারতশাসিত কাশ্মিরে মোদি সরকারের ২০১৯ সালের ক্র্যাকডাউনের সমালোচনা করেছিলেন। হিন্দু জাতীয়তাবাদী এই দলগুলোর অনেকেরই বিজেপির সাথে সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে এবং তাদের পদক্ষেপগুলো বিদেশী নির্বাচনকে প্রভাবিত করার প্রচেষ্টার প্রতিনিধিত্ব করে। যাই হোক, এটি শুধু যুক্তরাজ্যের সমস্যা নয়, হিন্দু জাতীয়তাবাদের অভিশাপ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে।
হোয়াইট হাউজে প্রকৃত বন্ধু
যুক্তরাজ্যের মতো হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও ডানপন্থী ইসলামোফোবিক প্রার্থীদের জন্য সক্রিয়ভাবে প্রচারণা চালায়। এটি ২০১৬ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় প্রকাশ পায়, যখন হিন্দু দলগুলো রিপাবলিকান প্রার্থীদের জন্য হিন্দু আমেরিকানদের মাঠে নামানোর সব ধরনের চেষ্টা চালিয়েছিল। ২০১৫ সালে শিকাগোভিত্তিক ব্যবসায়ী শালভ কুমার একটি ভারতীয় আমেরিকান লবি রিপাবলিকান হিন্দু কোয়ালিশন চালু করেন, মোদির সাথে যার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। এর সদস্যরা সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারাভিযানে আর্থিক সহায়তা দিয়েছিল এবং রাষ্ট্রপতি পদে লড়াই করার সময় আরএইচসি তাকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছিল। ভোটের আগে এই গোষ্ঠীর সাথে এক অনুষ্ঠানে ট্রাম্প ঘোষণা করেছিলেন, ‘হোয়াইট হাউজে ভারতীয় ও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন একজন সত্যিকারের বন্ধু পাবে।’ তিনি মোদিরও প্রশংসা করে তাকে মহামানব বলে অভিহিত করেন। তিনি হিন্দু আমেরিকানদের সমর্থন লাভের জন্য একটি নির্বাচনী ভিডিও প্রকাশ করেন।
২০২০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে মোদি অনেকটা ট্রাম্পের প্রচারক হিসেবে কাজ করেছিলেন। তিনি রিয়েলটর ও রাজনীতিবিদের দু’টি যৌথ র্যালির আয়োজন করেন। একটি ভারতের আহমেদাবাদে, অপরটি টেক্সাসের হিউস্টনে। শেষের র্যালিতে মোদিকে ট্রাম্পের পুনঃনির্বাচনী প্রচারাভিযানের পূর্ণ সহায়তা করতে দেখা যায়। এমনকি তিনি এ স্লোগানও দেন- আব কী বার, ট্রাম্প সরকার, অর্থাৎ এবারো ট্রাম্প সরকার গঠন করতে চলেছেন।
যাই হোক, যুক্তরাজ্যের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হিন্দু অধিকার এখন নির্বাচনী প্রভাব থেকে রাস্তায় শক্তি প্রদর্শনের দিকে এগিয়ে গেছে। চলতি বছরের আগস্টে মোদি ও উত্তর প্রদেশের বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী যোগি আদিত্যনাথের পোস্টারে সজ্জিত বুলডোজার নিউজার্সির এডিসনে ভারতের স্বাধীনতা দিবসের প্যারেডে প্রদর্শিত হয়। দৃশ্যত ভারতে স্থানীয় সরকার কর্তৃক মুসলমানদের বাড়িঘর ভেঙে ফেলার বিরক্তিকর প্রবণতাকে উদযাপন করা হয়। সমালোচনার পর আয়োজক ইন্ডিয়ান বিজনেস অ্যাসোসিয়েশন এ ঘটনার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে।
প্রকাশ্য হুমকি
কানাডাতেও হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা ঢেউ সৃষ্টি করেছে। একটি শিখ স্কুলের বাইরে শিখবিরোধী স্লোগান দেয়া হয় এবং হিন্দু স্বস্তিকা প্রদর্শিত হয়। ভারতের মোদি সরকারের সমালোচনা করায় বিদেশে বসবাসরত হিন্দুত্ব সমর্থকদের কাছ থেকে কানাডিয়ান শিক্ষাবিদরা হয়রানির শিকার হন এবং মৃত্যু ও ধর্ষণের হুমকির মুখোমুখি হন। জুন মাসে কানাডিয়ান হিন্দু জাতীয়তাবাদী রণ ব্যানার্জি প্রকাশ্যে মুসলিম ও শিখদের গণহত্যার আহ্বান জানান। ব্যানার্জি একটি ইউটিউব চ্যানেলকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘মোদি যা করছেন, তা দারুণ’। ওই সাক্ষাৎকারে তিনি আরো বলেন, ‘আমি ভারতের প্রজাতন্ত্রে মুসলিম ও শিখদের হত্যাকে সমর্থন করি। কারণ তারা মরারই যোগ্য।’
অস্ট্রেলিয়াতেও মুসলিম ও শিখদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের বিদ্বেষমূলক অপরাধের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এরকমই এক আক্রমণকারী বিশাল সুদকে অবশেষে শিখদের ওপর একের পর এক আক্রমণের জন্য গ্রেফতার করা হয় এবং তার ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার অপরাধে তাকে দেশ থেকে বের করে দেয়া হয়। তিনি যখন ভারতে ফিরে আসেন, তখন বীরের অভ্যর্থনা পান। অস্ট্রেলিয়ায় ভারতীয় সরকারের পক্ষ থেকে মোদি ও তার হিন্দু জাতীয়তাবাদী নীতির সমালোচকদের মুখ বন্ধ করে দেয়ারও চেষ্টা করা হয়। মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্ট্রেলিয়া ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট থেকে ১৩ জন একাডেমিক ফেলো ইন্ডিয়ান হাইকমিশনের হস্তক্ষেপ এবং গবেষণা ও লেখালেখিতে বিধিনিষেধ প্রয়োগের চেষ্টা করার কারণে পদত্যাগ করেছেন, যা ভারতের নির্লজ্জতার চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ।
হিন্দুত্ববাদ কেন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ল
নিঃসন্দেহে বিশ্বব্যাপী হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থানের সাথে মোদির উত্থানের অনেক সম্পর্ক রয়েছে। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে তিনি একটি অত্যন্ত বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনের তত্ত্বাবধান করছেন, যা মুসলিম নাগরিকদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ করে। তিনি জম্মু-কাশ্মিরের সাংবিধানিকভাবে গ্যারান্টিযুক্ত স্বায়ত্তশাসন বাতিল করেছেন এবং ১৯৯২ সালে হিন্দু কট্টরপন্থীদের দ্বারা ভেঙে ফেলা একটি ঐতিহাসিক মসজিদের স্থানে একটি মন্দির নির্মাণ করছেন। বিরোধী দলের নেতাকর্মী ও সমালোচকদের পিছু ধাওয়া করছেন।
দেশের ভেতর হিন্দুত্ববাদের প্রতিশ্রুতি পূরণে মোদির সাফল্যে তার প্রবাসী সমর্থকদের নৈরাজ্যবাদী গর্বের অনুভূতি প্রকাশ করতে অনুপ্রাণিত করছে। তবে বিশ্ব নেতারাও মোদিকে বৈধতা দেয়ার জন্য দায়ী। তারা হিন্দু প্রবাসীদের এই ধারাকে এমন আশ্বাস দিয়েছেন, তাদের কট্টর দৃষ্টিভঙ্গির কিছু বৈশ্বিক ভাণ্ডার রয়েছে। ট্রাম্প থেকে নিয়ে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ও ইসরাইলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু থেকে নিয়ে ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি জাইর বলসোনারুসহ একাধিক ডানপন্থী রাজনীতিবিদ নিজেদের মোদির ‘বন্ধু’ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। এমনকি সেই সমস্ত পশ্চিমা নেতা, যাদের কাছে বিশেষভাবে ঘোষিত কোনো ডানপন্থী অ্যাজেন্ডা নেই, তারা মোদি সরকারের মানবাধিকারের নৈরাশ্যজনক রেকর্ডের ক্ষেত্রে চোখ বন্ধ রেখে ভারতের সাথে তাদের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ক স্থাপন ও উন্নয়নে আগ্রহী।
এর পরে কী
ইসলামোফোবিয়া এখন ভারতের জনসাধারণ ও পররাষ্ট্রনীতির বিষয় বলে মনে হচ্ছে। যুক্তরাজ্যে ভারতীয় হাইকমিশন লেস্টারের ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় বিশেষভাবে শুধু সেখানকার হিন্দু সম্প্রদায়ের উদ্বেগের কথা উল্লেখ করেছে। যাই হোক, লেস্টারের উচিত একটি জাগরণের ডাক দেয়া। ভারতীয় ইস্যু হিন্দু জাতীয়তাবাদকে ঘরোয়া ভেবে উপেক্ষা করা যাবে না। এ আন্দোলন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এটি বিভিন্ন দেশে ক্রমবর্ধমান সহিংস রূপ ধারণ করছে। এটি এখন সর্বত্র গণতান্ত্রিক নীতি, সাম্য ও মানবাধিকারের জন্য হুমকিস্বরূপ। মোদির নেতৃত্বে ভারত এদিকে মনোযোগ দেবে না। বিশ্বকেই এ নিয়ে ভাবতে হবে।
আল-জাজিরার সৌজন্যে
ভাষান্তর- ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
সৌমদীপ সেন : অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, রসকিল্ড ইউনিভার্সিটি, ডেনমার্ক