‘শান্তিরক্ষীর ডায়েরি’

logo

মো. মনিরুজ্জামান

(১৩ ঘন্টা আগে) ১ মার্চ ২০২৩, বুধবার, ৭:০১ অপরাহ্ন

mzamin

যশোর জেলার এক নিভৃতপল্লীতে স্কুলমাস্টারের ঘরে আমার জন্ম। বেড়ে ওঠাও নিত্যদিনের আটপৌঢ়ে পরিবেশে, শান্ত-সুনিবিড় আলো-হাওয়ায়। আমি লেখক নই, কোনোকালে লেখক হওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ, অতি ক্ষীণ। সংগত কারণেই প্রশ্ন উঠতে পারে, তবে কেন এই প্রয়াস। সে প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চেষ্টাই এখানে।

আমার ছোট্ট এ জীবনে গর্ব করার মতো খুব একটা কিছু নেই। ছোটবেলায় বা একটু বড় হয়েও নিজ পরিমণ্ডলে মোটামুটি ভালো ছাত্র হিসেবে পরিচিত ছিলাম। বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম, যদিও বিজ্ঞান সাধনা সে অর্থে করা হয়ে ওঠেনি তেমন একটা। বাবা-মা, পরিবার-পরিজন ভাবতেন, বিজ্ঞানী না হোক বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক কিংবা তালেবর কিছু একটা হবেই তাদের ছেলে। আমিও এর বাইরে খুব একটা ভাবিনি জীবনের একটা সময় পর্যন্ত। নব্বই দশকের শুরুতে আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে স্বপ্ন দেখছি আমাকে নিয়ে দেখা আমার প্রিয়জনদের স্বপ্নপূরণে কিছু একটা করার, সে সময় আমার পরিবারের ওপর দিয়ে বয়ে গেল সন্ত্রাসের বিভীষিকা।

শারীরিক, আর্থিক, সামাজিক এবং বিশেষভাবে মানসিক নির্যাতনে পর্যুদস্ত হলাম আমি ও আমার পরিবার। চাঁদা না দেয়ায় সন্ত্রাসীরা আমাদের পারিবারিক সম্পত্তিতে প্রকাশ্য দিবালোকে তাণ্ডব চালালো, শারীরিকভাবে আক্রান্ত হলাম আমি এবং আমার ভাই। বিচার তো পেলামই না, এমনকি থানায় মামলা বা অভিযোগও করতে পারলাম না। এখানে-সেখানে ধরনা দিলাম। সবাই আশ্বাস দিলো, সহানুভূতি দেখালো এবং বেলাশেষে তাদের অপারগতা জানালো। বয়সটা অল্প ছিল, সেই অল্প বয়সেই বোধে এলো এই সোসাইটিতে টিকে থাকতে হলে মাস্তান হতে হবে, ভদ্রলোকদের এখানে টিকতে হলে থাকতে হবে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে। সন্ত্রাসী-মাস্তানির বাইরে পুলিশের একটু ইজ্জত বা সম্ভ্রম নিয়ে টিকে থাকার সুযোগ আছে, কারণ সাধারণত মাস্তানরা তাদের ঘাঁটায় না। 

জীবনের অনেকগুলো বসন্ত পেরিয়ে এসেছি, এখন আর মাস্তান হওয়া সাজে না, আর মাস্তানি তো রক্তেও নেই। আমি সারা জীবনের ভোলেভালে আদমি। সিদ্ধান্ত নিলাম পুলিশ হবো, মাথা উঁচু করে বাঁচবো। যারা নিরীহ মানুষের শান্ত-নিস্তরঙ্গ জীবনে অকারণে অপছায়া ফেলে, অন্যের মাথা যারা অকারণে নিচু করতে চায়, তাদের টুঁটি চেপে ধরবো। পরম করুণাময় আমার সহায় হলেন। আমি নাম লেখালাম বাংলাদেশ পুলিশের খেরোখাতায়। এবং সেই থেকে নিতান্তই সাধারণ এই আমি একটু গর্ব করেই বলি ‘I am a police officer by choice and not by chance’. আমি দেখেশুনে বিষ করেছি পান। দেশে পাঁচ বছর আমার মনের মতো করে পুলিশিং করার পর সুযোগ আসে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী হিসেবে যুদ্ধবিধ্বস্ত কসোভোতে শান্তিরক্ষী হিসেবে কাজ করার। স্ত্রী, কন্যা, পরিবার রেখে দুরুদুরু বক্ষে নাম লেখালাম আকাশি-নীল পতাকা আর ব্লু ব্যারেটের শান্তিরক্ষী হিসেবে।

তাবৎ বিশ্বের সবচেয়ে বড় সংস্থা জাতিসংঘ, আর জাতিসংঘের সবচেয়ে কোর একটিভিটি হচ্ছে শান্তিরক্ষা কার্যক্রম। সেই কার্যক্রমে একজন ফ্রন্টলাইনার শান্তিরক্ষী হিসেবে কাজ করা এখনো পর্যন্ত আমার জীবনের অন্যতম গর্বের বিষয়। কিন্তু একটুও সহজ ছিল না সেই জার্নি। যুদ্ধাবস্থার দেশ, বৈরী প্রকৃতি ও পরিবেশ, পরিবার বিচ্ছিন্নতাসহ নানা টানাপড়েনের তিনশ’ পঁয়ষট্টি দিনের প্রতিটি দিনই ছিল দারুণ রঙিন, ঘটনাবহুল। জাতিগত দাঙ্গা, যুদ্ধ-উত্তর দেশ গঠনের নানা আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট, যুদ্ধদেশের মানবিক বিপর্যয়, অ্যাডভেঞ্চার, থ্রিল, যুদ্ধদেশে ব্যক্তিমানুষের যাপিত জীবনের ক্লাইমেক্স সবই প্রত্যক্ষ করেছি। পুলিশিংয়ের মতো চ্যালেঞ্জিং একটি পেশায় জড়িত থাকলেও আমার ভেতরেই আমি টের পাই কুল কুল করে বয়ে যাওয়া আশৈশব এক বৈরাগী মন। আমি আমার দিব্যচক্ষুতে প্রত্যক্ষ করেছি যুদ্ধদেশের কঠিন বাস্তবতা, এঁকে ফেলেছি স্মৃতির এপিসোডে। আমি আগেই বলেছি- আমি লেখক নই, একেবারেই নই, বড়জোর একজন স্টোরি টেলার, গল্পকথক। অনেকটা খেয়ালের বশেই মিশন জীবনের গল্পগুলো কয়েকটি পর্বে বিক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরেছিলাম নিজের ফেসবুক ওয়ালে। সাধারণ এই আমিকে বোধ হয় বড্ড মায়া করেন, ভালোবাসেন কিছু অসাধারণ মানুষ। সেসব অগণিত সুহৃদের অনেকেরই মনে দাগ কাটে আমার ওয়ালের এসব সাতসতেরো সাতকাহন। তারা আমাকে অনুরোধ করতে থাকেন- ‘শান্তিরক্ষীর ডায়েরি’ শিরোনামে ধারাবাহিকভাবে লেখা গল্পগুলোকে মলাটবদ্ধ করার। পেশায় আমি পুলিশ অফিসার। ভেতরে একটু-আধটু বিবাগী মন থাকলেও আমি বাস্তবতা বুঝি। বড় বড়, জ্ঞানীগুণী মানুষের আত্মচরিত বা কথকতা মানুষ সময়, পয়সা নষ্ট করে পড়ে, তা থেকে শিক্ষা নেয়। কিন্তু আমারটা কেন পড়বে? কী আছে এতে? নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করতে থাকি। নিজের ওয়ালে এসব আগডুম-বাগডুম লিখতে লিখতেই অলেখক এই আমার গড়ে ওঠে একটি পাঠকশ্রেণি। তারা আমাকে ক্রমাগত তাগাদা দিতে থাকে বই প্রকাশের অনুরোধ করে। পাঞ্জেরী প্রকাশনীর কর্ণধার সুলেখক কামরুল হাসান শায়ক তাদেরই একজন। আমার অতিপ্রিয়, এই সুহৃদের অনুরোধেই মূলত বই আকারে ‘শান্তিরক্ষীর ডায়েরি’র গোড়াপত্তন হয়। পুলিশের চাকরির কর্মব্যস্ত দিনলিপিতেও হঠাৎ আসা কোনো অলস দুপুর, বিষণ্ন বিকেল কিংবা হঠাৎ ঘুমভাঙা মধ্যরাতে আমার ফেলে আসা দিনগুলো আমাকে দারুণভাবে অনুরণিত করে। আমাকে আমি যতটুকু চিনি, তাতে বুঝি আমি একজন স্মৃতিকাতর মানুষ। শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি এখনো আমাকে ভীষণ নাড়া দেয়। আমার ভাবনাটা এমন যে, যদি বেঁচে থাকি তো আমার যাপিত জীবনের স্মৃতিচারণই হবে আমার অবসরের অন্যতম অনুষঙ্গ। অবসরে আমিই পড়বো আমার ফেলে আসা দিনগুলোর, আমার যাপিত জীবনের খণ্ডচিত্র।

‘শান্তিরক্ষীর ডায়েরি’ প্রকাশের জন্য অযুত কৃতজ্ঞতা পাঞ্জেরী প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী কামরুল হাসান শায়ক ও তার সহকর্মীদের। একুশের বইমেলা সামনে রেখে একেবারেই তড়িঘড়ি করে এর প্রকাশনা। এই স্বল্প সময়ে বইটির সম্পাদনার জন্য পাঞ্জেরী প্রকাশনীর নিলাদ্রি নিলয়কে জানাই অকুণ্ঠ অভিবাদন।
বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে আমার দুঃখ-সুখের, দুর্যোগ-দুঃসময়ের সাথী আমার স্ত্রী ইডেন কলেজের সমাজকর্ম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নাছিমা সুলতানাকে। শান্তিরক্ষী হিসেবে আমার নিযুক্তিতে তিনি যারপরনাই আনন্দিত হয়েছিলেন। কঠিন সেই দিনগুলোতে ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ ভুলে হাসিমুখে সামলেছেন আমাদের সন্তান ও পরিবারকে। বইটি প্রকাশের এই মাহেন্দ্রক্ষণে খুব মনে পড়ছে আমার পরলোকগত মায়ের কথা, মিশনের দিনগুলোতে যিনি প্রতিক্ষণ অপেক্ষায় থাকতেন তার শান্তিরক্ষী পুত্রের কথা শোনার জন্য। পরম করুণাময় তাকে শান্তিতে রাখুন। আমার ব্যক্তিগত বন্ধু-বান্ধব, সুহৃদ, শ্রদ্ধাভাজন প্রিয়জনরা বিগত কয়েক বছরে আমার টাইমলাইনে শান্তিরক্ষীর ডায়েরি হিসেবে লেখালেখিগুলোকে একত্রিত করে বই আকারে প্রকাশে বারবার অনুরোধ করেছেন, নানাভাবে উৎসাহ দিয়েছেন। তাদের কারণেই বই হিসেবে ব্যক্তিগত ডায়েরির এ আত্মপ্রকাশ। তারা উৎসাহ দিয়েই ক্ষান্ত হননি, বইটি প্রকাশিত হবে জানতে পেরে প্রকাশনার আগেই বিপুল পরিমাণ প্রি সেল অর্ডারের মাধ্যমে আমাকে এবং প্রকাশককে ভীষণভাবে উৎসাহিত করে ও কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করেছেন। কসোভো মিশনের শীতার্ত দিনগুলোতে হৃদয়ের উষ্ণতায় আমাকে প্রাণবন্ত রেখেছেন দেশ-বিদেশের নানা জাতি-ধর্মের সহকর্মীরা। তাদেরও স্মরণ করি পরম শ্রদ্ধায়। কসোভো মিশনে কর্মকালে আমার কন্যা প্রিয়ন্তীর বয়স ছিল বছরখানেক, একইভাবে সুদান মিশনে থাকাকালে আমার পুত্র আলিফ ছিল সদ্যজাত। আমার মিশনে থাকার কারণে আমার প্রিয়ন্তী ও আলিফ তাদের বাবার আদর থেকে বঞ্চিত হয়েছে, তাদের জন্যও আমার অনিঃশেষ শুভাশিস। কেন  জানি, আজ ভীষণ মনে পড়ছে আমাদের অকালপ্রয়াত শিশুপুত্র জীবনকে, যার আঠারো দিনের জীবনের আঠারোটি দিনই কেটেছে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন হাসপাতালের আইসিইউতে, ইনকিউবেটরে বা নিজের ছোট্ট দেহটিতে নানা রঙের নল লাগিয়ে। সে কখনো জানতেও পারেনি, কে সে, তার বাবা কে, তার মা কে। সে কখনোই হয়তো জানবে না কতোটা দুঃখ নিয়ে তার বাবা-মা তাকে স্মরণ করে।
নবীন লেখক হিসেবে আমি আমার অনাগত সব বিদগ্ধ পাঠকের স্নেহাশীষ কামনা করি। আমি মানুষটা ছোট হতে পারি কিন্তু লেখনীর ক্যানভাসটি বিশালায়তন, যাকে ফুটিয়ে তোলার সামর্থ্য হয়তো আমার নেই। সেই অর্থে এটি আমার সৃষ্টিশীল প্রথম প্রকাশনা। যাবতীয় ভুল-ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো। বইটি ২০০৫-০৬ এর প্রেক্ষাপটে লেখা। স্মৃতিনির্ভর এই লেখনীতে স্থান, কাল, পাত্র, নাম, ব্যক্তি কিংবা ঘটনায় ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকতে পারে, সেজন্য নিঃশর্ত ক্ষমা চাই সবার কাছে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এ লেখনীর মূল উপজীব্য হলেও কোথাও কোথাও কল্পিত প্লট বা ঘটনার অনুষঙ্গের মিশ্রণ যে হয়নি, সেটি হলফ করে আজ আর বলতে পারি না। ক্ষমা চাই সেজন্যও।

অনাগত দিনের সব পাঠক, প্রকাশনা-সংশ্লিষ্ট সবাইকে, আমার যেসব সহকর্মী আমাকে ও বই প্রকাশে নানাভাবে সহযোগিতা ও উৎসাহ দিয়েছেন তাদের সবার প্রতিও আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা। আমার দীর্ঘদিনের অনুজ সহকর্মী এএসআই ফারুককে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই অফিস আওয়ারের বাইরে টাইপসহ যাবতীয় সহযোগিতার জন্য। আপনাদের মূল্যবান মতামত বা পরামর্শ পেলে পরবর্তী কোনো প্রকাশনায় ত্রুটি-বিচ্যুতি বা অসঙ্গতিগুলোকে অ্যাডজাস্ট করার চেষ্টা করবো- এ কথা বলেই বিদায় নিতে চাই। পরম করুণাময় আমাদের সবার সহায় হোন।

লেখক : মো. মনিরুজ্জামান, বিপিএম (বার), পিপিএম (বার), ডিআইজি, অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট, বাংলাদেশ পুলিশ।