ঢাকা
মূলধন ঘাটতি পূরণসহ মূলধন ভিত জোরদার ও বৈশ্বিক পরিসরে ব্যাংক তথা দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে ব্যাংকটি অর্থ মন্ত্রণালয়ের শরণাপন্ন।
সরকারকে বিনা মূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে ৫১ ধরনের সেবা দেওয়ার কথা জানিয়ে রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী ব্যাংক ১৩ বছরে ১৮ হাজার ১১৮ কোটি টাকা ক্ষতির হিসাব দিয়েছে। ব্যাংকটির দাবি, তারা কখনো সরকারের বিশেষ ঋণপত্র (এলসি) খুলছে, আবার কখনো নিজস্ব অর্থায়নে সঞ্চয়পত্র ও বিনিয়োগ বন্ডের মূল্য পরিশোধ করছে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) নিয়মিত ঋণকে কম সুদের বন্ড ছাড়ার মাধ্যমে সমন্বয় করার কথাও জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়কে।
সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আফজাল করিম সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহর কাছে পুঞ্জীভূত ক্ষতির কথা জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন।
সরকার ঘোষিত সেবার বিপরীতে ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে মুনাফা বৃদ্ধি, মূলধন ঘাটতি পূরণসহ মূলধন ভিত শক্তিশালীকরণ এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে ব্যাংক তথা দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে ব্যাংকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সহযোগিতা চেয়েছে। এ জন্য সেবার বিপরীতে যৌক্তিক কমিশন নির্ধারণ এবং ২০২১ থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত দেড় বছরে কয়েকটি খাতে সুযোগ ব্যয় বিবেচনা করার অনুরোধ জানায় ব্যাংকটি।
বয়স্ক ভাতা, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতা, প্রতিবন্ধী শিক্ষা উপবৃত্তি, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা, পৌর কর সংগ্রহ, পোশাক খাতের শ্রমিকদের হিসাব পরিচালনাসহ ৫১ ধরনের সেবা দেওয়ার একটি তালিকাও দিয়েছে সোনালী ব্যাংক।
ব্যাংকটির এমডি মো. আফজাল করিম গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘৫১ ধরনের সেবার মধ্যে ৩৯টিতেই আমরা কোনো কমিশন পাই না। মূলধন ঘাটতি এখন চার হাজার কোটি টাকার মতো। ১৩ বছরে সেবামূল্যের বিপরীতে আমাদের পুঞ্জীভূত ক্ষতি হয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকা।’
গত ৩০ জুন পর্যন্ত সোনালী ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ১২৬ কোটি টাকা, যা শতকরা হিসাবে ১৮ শতাংশ।
রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের এলসি কমিশন
চিঠিতে সোনালী ব্যাংক বলেছে, ২০১৭ সালে রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে সরকার সোনালী ব্যাংকে ৯৪ হাজার ২২৬ কোটি টাকার বিশেষ এলসি খোলে। যেকোনো এলসির বিপরীতে কমিশনের হার দশমিক ৪ শতাংশ, যা ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে আরোপযোগ্য। এলসির সম্পূর্ণ নিষ্পত্তির মেয়াদ সাত বছর ধরা হলে কমিশন আরোপযোগ্য হবে সাড়ে তিন বছরের। সেই হিসাবে ব্যাংকটির কমিশন পাওয়ার কথা ৫ হাজার ২৭৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। কিন্তু সরকার মাত্র ২০ কোটি টাকা কমিশন দিতে রাজি হয়েছে। বাকি ৫ হাজার
২৭৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকা উপার্জন থেকে বঞ্চিত থাকছে ব্যাংকটি।
বিপিসি, বিজেএমসি ও বিশেষ বন্ড
বিপিসিকে দেওয়া ঋণ ২০০৭ সালে ৫ শতাংশ সুদে ১৫ বছর মেয়াদে বন্ডে সমন্বয় করা হয়েছিল, যার স্থিতি ৮৬৫ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। ১০ বছর মেয়াদে ৭ শতাংশ সুদে ২০১৩ সালে ছাড়া আরেক বন্ডের বর্তমান স্থিতি ৮২১ কোটি টাকা। এ দুটিসহ ছয় থেকে ১৫ বছর মেয়াদি সরকারি বন্ডগুলোর বিপরীতে ব্যাংকের ঋণের সুদ ৯ শতাংশ বিবেচনায় নেওয়া হলে পুঞ্জীভূত ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৬৮৩ কোটি ৪৮ লাখ টাকা।
বিজেএমসির কাছ থেকে ২০১১ সালে পাওয়া বন্ডের মেয়াদ শেষে ক্ষতি দাঁড়াবে ২০৪ কোটি টাকা। ওরিয়ন গ্রুপ ও আইসিডিকে দেওয়া ঋণ এবং সুদ মওকুফের বিপরীতে ৫ শতাংশ সুদে সাত বছরমেয়াদি বিশেষ ট্রেজারি বন্ডের ক্ষেত্রেও ব্যাংকের ঋণের গড় সুদের হার ৯ শতাংশ বিবেচনায় সোনালী ব্যাংকের পুঞ্জীভূত ক্ষতি দাঁড়াবে ১৬৭ কোটি টাকা।
সঞ্চয়পত্র বিক্রি ও নগদায়ন
সোনালী ব্যাংক ৩৯টি শাখার মাধ্যমে সঞ্চয়পত্র বিক্রি ও নগদায়নের কাজ করে। এ কার্যক্রমের জন্য তৈরি রাখতে হয় ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এ টাকা থেকে ব্যাংকের কোনো আয় হয় না। আমানতকারীদের আমানতের অর্থ থেকে পরিশোধ করতে হয় বলে বছরে গড়ে তহবিল খরচ (কস্ট অব ফান্ড) বহন করতে হচ্ছে ১২৬ কোটি টাকা। প্রতিটি শাখায় দুজন করে মোট ৭৮ জন কর্মীকে এ কাজে নিয়োজিত থাকতে হচ্ছে। তাঁদের বেতন-ভাতা ও আসবাবপত্র বাবদ ব্যয়সহ ১৩ বছরে মোট ২ হাজার ২৮৩ কোটি ২১ লাখ টাকা ব্যয় করতে হয়েছে। বিজেএমসির অধীন ২৫ পাটকলের অবসরে যাওয়া শ্রমিকদের জন্যও ৭২ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে সোনালী ব্যাংকের।
সুযোগ ব্যয়ের হিসাব ও অন্যান্য
সোনালী ব্যাংক বলেছে, এসব কাজে ব্যাংকের ২ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা নিয়োজিত থাকে। পুলিশ প্রহরা ও ভল্টের সুরক্ষার জন্যও ব্যাংকের কর্মীদের নিয়োজিত রাখতে হয়। এতে ৭৩২টি শাখায় ব্যাংকের মোট ক্ষতি হয় ৪ হাজার ২৭ কোটি টাকা।
চিঠি দেওয়ার পর আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ কোনো উদ্যোগ নিয়েছে কি না, জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের এমডি আফজাল করিম বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমরা কিছু জানতে পারিনি।’
কার্যালয়ে গিয়ে ও মোবাইল ফোনে চেষ্টা করেও এ ব্যাপারে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।