সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান ও তাঁর স্ত্রীর তিন দেশের ৫৮০টি বাড়ি ও সে দেশের ব্যাংকে থাকা হাজার হাজার কোটি টাকা ক্রোক ও অবরুদ্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকার মহানগর দায়রা জজ ও সিনিয়র বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন এই নির্দেশ দেন।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) বিশেষ পিপি মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর বিষয়টি আজকের পত্রিকাকে নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আদালতের আদেশ থেকে দেখা যায়, তিন দেশে সাইফুজ্জামান ও তাঁর স্ত্রী রুকমিলা জামানের নামে থাকা বাড়িগুলো ক্রোকের নির্দেশ দিয়েছেন। এইচএম ল্যান্ড রেজিস্ট্রি ইংল্যান্ড ও ওয়েলস, সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) দুবাই ল্যান্ড ডিপার্টমেন্ট ও যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক ও ফ্লোরিডার এস্টেট রেজিস্ট্রারকে এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধের আদেশ দেওয়া হয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান, ফার্স্ট আবুধাবি ব্যাংকের চেয়ারম্যান/প্রধান নির্বাহী এবং যুক্তরাষ্ট্রের টিডি ব্যাংকের চেয়ারম্যান/প্রধান নির্বাহীকে।
তবে এই আদেশ কার্যকর করতে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সংশ্লিষ্ট তিন দেশের কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ পাঠাতে হবে।
পারস্পরিক সহায়তা আইন অনুযায়ী এই অনুরোধ পাঠাতে হবে। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) চুক্তি অনুযায়ী অবৈধ উপায়ে অর্জিত সম্পদ ক্রোক ও অবরুদ্ধ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে বলে আদেশে বলা হয়েছে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ অপরাধ সম্পর্কিত বিষয়ে পারস্পরিক সহায়তা আইন, ২০১২ বলবৎ রয়েছে। বিদেশের কোনো আদালতের নির্দেশে বাংলাদেশেও অন্য দেশের অপরাধ সম্পর্কিত সম্পদ ক্রোকের ও অবরুদ্ধের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, গত ১৬ অক্টোবর দুদকের উপপরিচালক রামপ্রসাদ মণ্ডল ঢাকার আদালতে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান ও তাঁর স্ত্রী রুকমিলা জামানের বিদেশে থাকা বাড়ি ও সে দেশের ব্যাংকে থাকা অর্থ ক্রোক ও অবরুদ্ধের নির্দেশ দেওয়ার জন্য আবেদন করেন।
আবেদনে বলা হয়, সাবেক ভূমিমন্ত্রী ও তাঁর স্ত্রী ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধ অর্থ অর্জনপূর্বক তা হস্তান্তর, স্থানান্তর ও রূপান্তর করতেন। বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার করে লেয়ারিংয়ের আশ্রয় নিয়ে যুক্তরাজ্য, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও যুক্তরাষ্ট্রে সম্পদ গড়েছেন তাঁরা। এই তিন দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে নিজেদের নামে ও প্রতিষ্ঠানের নামে হিসাব খুলে অবৈধ অর্থ লেনদেন করেছেন। এসব সম্পদ ও অর্থ অবিলম্বে ক্রোক ও অবরুদ্ধ করা অত্যাবশ্যক।
আবেদনে আরও বলা হয়েছে, সাইফুজ্জামান চৌধুরী সরকারের প্রতিমন্ত্রী থাকাকালীন এবং ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকাকালে এবং তাঁর স্ত্রী রুকমিলা ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকাকালে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদ অর্জন করেছেন। সাইফুজ্জামান ও তাঁর স্ত্রী যুক্তরাজ্যে ৩৪৩টি, আরব আমিরাতে ২২৮টি এবং যুক্তরাষ্ট্রে ৯টি বাড়ি/অ্যাপার্টমেন্টসহ আরও সম্পদ অর্জন করেছেন। সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর ল্যান্ড রেজিস্ট্রি ও প্রাপ্ত অন্যান্য তথ্য ও রেকর্ডপত্র পর্যালোচনায় এগুলো জানা গেছে।
এই সম্পদ ২০১৫ সাল থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে কেনা হয়েছে এবং ওই সময় সাইফুজ্জামান ভূমি প্রতিমন্ত্রী ও মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে তিনি ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০১৭ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত তাঁর স্ত্রী ওই ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন। ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়ে তাঁরা বিদেশে পাচার করেছেন।
দুদকের উপপরিচালক আবেদনে আরও বলেন, সাইফুজ্জামান ও পরিবারের সদস্যদের আয়কর নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিদেশে বিভিন্ন সম্পদ অর্জন ও বাড়ি কেনার জন্য তাঁরা বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন নেননি। এমনকি আয়কর নথিতে তাঁরা বিদেশের সম্পদ প্রদর্শন করেননি। নির্বাচনী হলফনামায় এসব তথ্য এড়িয়ে গেছেন।
তিন দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে তাঁদের কত টাকা জমা আছে সে বিষয়ে আবেদনে উল্লেখ না থাকলেও ব্যাংক হিসাবের কপি আদালতে দাখিল করা হয়েছে। জানা গেছে, তিন দেশের ব্যাংকে সাইফুজ্জামান ও তাঁর স্ত্রীর ২ হাজার কোটি টাকার বেশি রয়েছে।
উল্লেখ্য, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকে সাইফুজ্জামান ও তাঁর পরিবারের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ হাজার ৭৯২ কোটি টাকার মতো বলেও জানা গেছে।
এর আগে গত ৭ অক্টোবর সাবেক মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী রুকমিলা জামানের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন আদালত।
এ ছাড়া আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রীর নামে থাকা সব ধরনের ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। পরে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর ২৩ (১) (গ) ধারা অনুযায়ী সাইফুজ্জামানের ভাই আনিসুজ্জামান চৌধুরী, আনিসুজ্জামানের স্ত্রী ইমরানা জামান চৌধুরী ও মেয়ে আনিছা জামানের ব্যক্তিগত হিসাব এবং তাঁদের ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের নামে পরিচালিত হিসাবের লেনদেন প্রথম দফায় ৩০ দিনের জন্য স্থগিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
ajker patrika