সরকার দেশের অর্থনীতির অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, সরকার বারবার বহিরাগত সমস্যাকে সামনে এনেছে। ভেতরের সমস্যা দিন দিন গুরুতর হয়েছে। ব্যাংকিং, দুর্নীতি, অপচয়, প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয়—এই বিষয়গুলোকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়েছে।
আজ বুধবার রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত ‘ক্রান্তিকালে বাংলাদেশ: নির্বাচন, অর্থনীতি এবং বহিঃসম্পর্ক’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট অতিথিরা এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস)। অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে অংশ নেন সাবেক আমলা, কূটনীতিবিদ, সাবেক গভর্নর, অর্থনীতিবিদ, মানবাধিকারকর্মী, নির্বাচনবিশেষজ্ঞ ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকেরা।
আলোচনায় অংশ নিয়ে সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বর্তমানে দেশের অর্থনীতিতে দুটি চ্যালেঞ্জ। একটি অভ্যন্তরীণ, আরেকটি বহির্বিশ্বের সঙ্গে সমস্যা। সরকার বারবার বহিরাগত সমস্যাকে সামনে এনেছে। ভেতরের সমস্যা দিন দিন গুরুতর হয়েছে। ব্যাংকিং, দুর্নীতি, অপচয়, প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয়—এই বিষয়গুলোকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়েছে। মার্চে ঠিক হয়ে যাবে, এপ্রিলে রপ্তানি বাড়বে—এসব কথা বলে লোকজনকে বোকা বানানোর চেষ্টা হয়। এসব সমস্যা অনুধাবন না করতে পারলে সমাধান হবে না।
সরকারের ভ্রান্ত নীতি এবং নীতির বাস্তবায়ন না হওয়ায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে মন্তব্য করেন সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানগুলো দিন দিন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর দক্ষতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি নেই। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার দেশ। একটু নাড়াচাড়া লাগলেই রপ্তানি হবে না। পোশাক খাতের কিছু হলে দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে। তার মানে বিকল্প রপ্তানি খোঁজা হয়নি।
সরকার প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে, তা ভুল বলে মনে করেন সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, কীভাবে প্রবৃদ্ধি হঠাৎ ৭ শতাংশ হয়ে যায়? প্রবৃদ্ধিই সব নয়। আয় ও সম্পদের বৈষম্য তো বাড়ছে। সরকারি তথ্য-উপাত্ত খুবই বিভ্রান্তিকর। রপ্তানি নিয়ে সরকারের একেক সংস্থা একেক তথ্য দিচ্ছে।
ঋণের টাকায় সরকারি প্রকল্পের ব্যয় ও সময় বৃদ্ধির সমালোচনা করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সাবেক গভর্নর। তিনি বলেন, ‘৫ বছরের প্রকল্প ১০ বছর হয়ে যায়। ৫ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প ৩০ হাজার কোটি টাকা হয়ে যায়। বিদেশ থেকে আনা ঋণের টাকা অপচয় করছি। ১০ টাকার জিনিসে ৫০ টাকা ব্যয় করলে কীভাবে ফেরত দেব? মানুষ কী চায়? টানেল চায় নাকি কালভার্ট চায়? বিশাল হাসপাতাল করলেন, ডাক্তার নাই।’
সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, অনেকে বলেন, আমেরিকাতেও দুর্নীতি হয়। সেখানে জেল থেকে বের হলে কিছুই থাকে না। আর এখানে ঋণখেলাপি, চুরি করা লোকজন মহা আনন্দে বাড়ি কিনছেন, গাড়ি কিনছেন। বাইরে দুর্নীতি হলে সেটার বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এখানে তো জবাবদিহি নেই, আইনের শাসন নেই। রাজনীতি ঠিক না হলে জবাবদিহি, নীতি ঠিক হবে না। এই বিষয়গুলো না দেখলে সামনে এগিয়ে যাওয়া কঠিন হবে।
উন্নয়নের বয়ান বাস্তবতার সঙ্গে মেলে না
সরকার উন্নয়নের যে বয়ান দিচ্ছে, তার সঙ্গে মানুষের জীবনযাত্রার মান, ভোগান্তির চিত্র মিলছে না বলে মনে করেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, রাজস্ব, আমদানি, রপ্তানি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের সূচক নিম্নমুখী। সরকার জিডিপির যে সংখ্যা দিচ্ছে, তাতে মনে হয়, শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি করছে।
সরকার জিডিপির যে দাবি করে তা ধোপে টেকে না বলে মন্তব্য করেন আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, জিডিপি তুখোড় বেগে এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু বাকি সূচক নিচে নামছে। উন্নয়নের বয়ান দিয়ে চলা যায়, কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন করা যায় না। সরকার মূল্যস্ফীতিকে চাপিয়ে রাখছে। ১০ শতাংশ পার করতে দেয় না।
নির্বাচনের পর সরকারের সামনে আরও চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে বলে মনে করেন আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, যে নকশাতেই নির্বাচন হোক, অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোকে গুরুত্ব না দিলে তা আত্মঘাতী হয়ে যেতে পারে।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সিজিএসের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী। সঞ্চালনা করেন সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান।
প্রথম আলো