সরকারের দেশী-বিদেশী ঋণের পরিমাণ ক্রমেই বাড়ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধে ব্যয় (ডেবট সার্ভিসিং কস্ট)। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারের ঋণ পরিশোধে ব্যয় হয়েছে ২৩ দশমিক ৩২ বিলিয়ন (প্রায় ২ হাজার ৩৩২ কোটি) ডলারের বেশি। আন্তঃব্যাংক লেনদেনে সর্বশেষ ঘোষিত বিনিময় হার (প্রতি ডলার ১১০ টাকা ২৫ পয়সা) অনুযায়ী টাকার অংকে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ২ লাখ ৫৭ হাজার ১৫৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিদেশী ঋণ পরিশোধে ব্যয়ের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারের বিদেশী ঋণ পরিশোধে ব্যয় ৩৮৮ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে, যা টাকার অংকে ৪২ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
আইএমএফের পর্ষদ সভায় গত মঙ্গলবার (১২ ডিসেম্বর) বাংলাদেশের জন্য ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় অনুমোদন করা হয়। এর আগে গত ৪ থেকে ১৯ অক্টোবর আইএমএফের রিভিউ মিশন বাংলাদেশ সফর করেছে। মঙ্গলবারের পর্ষদ সভায় সংস্থাটির কর্মকর্তারা বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে তাদের মূল্যায়ন পর্ষদের সামনে তুলে ধরেন। এরপর বাংলাদেশ নিয়ে আইএমএফের কর্মকর্তাদের মূল্যায়ন, ঋণ কর্মসূচির আওতায় শর্ত ও সংস্কার বাস্তবায়নের অগ্রগতি বিষয়ে শুক্রবার (১৫ ডিসেম্বর) একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এ প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সরকারের ঋণ ও ঋণ পরিশোধের চিত্র তুলে ধরা হয়।
আইএমএফের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে সরকারের ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৬৬৬ কোটি ডলারে। এ সময় সরকারের ঋণ পরিশোধে ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৩৩২ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এর মধ্যে বিদেশী ঋণ পরিশোধে ব্যয় ছিল ৩৮৮ কোটি ৬০ লাখ ডলার। আগের অর্থবছরে (২০২১-২২ অর্থবছর) এ ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ২১০ কোটি ডলার।
২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারের বিদেশী ঋণ পরিশোধে ব্যয়কৃত ৩৮৮ কোটি ৬০ লাখ ডলারের মধ্যে ৩৬৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার খরচ হয়েছে মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বাবদ। এক্ষেত্রে বহুপক্ষীয় ঋণদাতা তথা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন দাতা সংস্থার ঋণ পরিশোধে ব্যয় হয়েছে ২০৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার। এর মধ্যে ২৭ কোটি আইএমএফের, ৬৮ কোটি ৭০ লাখ বিশ্বব্যাংকের, ৯৩ কোটি ৮০ লাখ এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ও ১৬ কোটি ২০ লাখ ডলার বহুপক্ষীয় অন্য ঋণদাতাদের ঋণ পরিশোধে ব্যয় হয়েছে।
দ্বিপক্ষীয় ঋণদাতাদের ডলারের ঋণ পরিশোধে এ সময় সরকারের ব্যয় হয়েছে ৮৮ কোটি ২০ লাখ ডলার। এর মধ্যে প্যারিস ক্লাবভুক্ত (যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, জাপান ও পশ্চিমা বৃহৎ অর্থনীতির দেশ) দেশগুলোর ক্ষেত্রে এ ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৫১ কোটি ৮০ লাখ ডলার। এর মধ্যে জাপান ও রাশিয়ার ঋণ পরিশোধে ব্যয় ছিল যথাক্রমে ১৪ কোটি ৫০ লাখ ও ৩৩ কোটি ডলার। প্যারিস ক্লাব-বহির্ভূত দেশগুলোর ঋণ পরিশোধে ব্যয় হয়েছে ৩৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার। এর মধ্যে চীন ও ভারতের ক্ষেত্রে ব্যয়ের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ২৫ কোটি ১০ লাখ ও ৭ কোটি ডলার। এছাড়া গত অর্থবছরে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর ঋণ পরিশোধে ব্যয় হয়েছে ৭৩ কোটি ৬০ লাখ ডলার। স্বল্পমেয়াদি ঋণের জন্য ব্যয় হয়েছে ২১ কোটি ডলার।
স্থানীয় উৎস থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে সরকারের নেয়া ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ২৬৪ কোটি ৮০ লাখ ডলার। আইএমএফের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে স্থানীয় উৎস থেকে গৃহীত ঋণ ও ঋণের সুদ (অভ্যন্তরীণ) পরিশোধে সরকারের ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ৯৪৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার। এক্ষেত্রে ট্রেজারি বিলের জন্য ৪১ কোটি ৩০ লাখ, ট্রেজারি বন্ডে ৫৯৫ কোটি ৭০ লাখ, সুকুকে ৮ কোটি ৫০ লাখ ও সঞ্চয়পত্রের বিপরীতে ১ হাজার ২৯৮ কোটি ৪০ লাখ ডলার ঋণ পরিশোধে ব্যয় হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘চলতি অর্থবছরে স্থানীয় উৎস থেকে সরকারের ঋণ আরো বাড়বে, কারণ ট্রেজারি বিলের সুদের হার দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে এবং এটি সরকারকে পরিশোধ করতে হবে। বিদেশী ঋণের ক্ষেত্রেও সুদের হার বাড়ছে এবং একই সঙ্গে ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে সামনের দিনগুলোয় আমাদের ঋণ পরিশোধের চাপ আরো বাড়বে।’
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারের ঋণ বেড়েছে ২ লাখ ৭৩ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। এ সময়ে স্থানীয় উৎসের তুলনায় বিদেশী উৎস থেকে নেয়া ঋণ বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। যে পরিমাণ ঋণ বেড়েছে, তা গত অর্থবছরে সরকারের আহরিত মোট রাজস্বের প্রায় ৮৩ শতাংশ। এ সময়ে ঋণের বিপরীতে সরকারকে ৯২ হাজার কোটি টাকারও বেশি সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে রাজস্ব আয় হয়েছে ৩ লাখ ৩১ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকার। এ সময়ে সরকারকে ঋণের বিপরীতে ৯২ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকার সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে, যা এ খাতে বাজেট বরাদ্দকে ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে স্থানীয় ঋণের বিপরীতে ৮৩ হাজার ৮৬ কোটি টাকা ও বিদেশী ঋণের বিপরীতে ৯ হাজার ৪৫২ কোটি টাকার সুদ পরিশোধ করেছে সরকার। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে সুদ পরিশোধ বাবদ ৯০ হাজার ১৩ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল।
আইএমএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধে ব্যয়ের সঙ্গে রাজস্ব আয় ও অনুদানের অনুপাত ৭১ দশমিক ৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। রাজস্বের অনুপাতে ঋণ পরিশোধের ব্যয় বাড়ায় সরকারের রাজস্ব আয় বাড়ানো জরুরি হয়ে পড়েছে, যাতে করে দরিদ্রবান্ধব ও সবুজ প্রবৃদ্ধি পুনরুদ্ধারে অতি প্রয়োজনীয় অর্থ ব্যয় করা যায়।
প্রতিবেদনে আইএমএফের নীতিগত সুপারিশে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের কর রাজস্ব বাড়ানো এবং ব্যয় যৌক্তিকীকরণ করা প্রয়োজন, যাতে সামাজিক ও বিনিয়োগ খাতে ব্যয় বাড়ানো যায়।
২০২২-২৩ অর্থবছরে আইএমএফের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় করতে পারেনি বাংলাদেশ। এ বিষয়ে আইএমএফ বলছে, আয় ও ভোগ প্রত্যাশার চেয়ে কম হওয়ার পাশাপাশি আমদানি নিয়ন্ত্রণের কারণে কর রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের জন্য দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ ছাড় অনুমোদনের পর দেয়া বিবৃতিতে সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হয়, সরকার সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের প্রচেষ্টা সন্তোষজনক এবং ঋণ কর্মসূচির বেশির ভাগ লক্ষ্যমাত্রা ও সংস্কারের প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়েছে। তবে ভালো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিতে বেসরকারি খাতের মাধ্যমে পুঁজিবাজারকে গভীর করা প্রয়োজন।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আইএমএফের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ঋণ সংকটের ঝুঁকি কম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে আমাদের ঋণের কিস্তি ও সুদ পরিশোধের বিপরীতে রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহ এবং সহজ শর্তের ঋণ বেশি থাকায় সুদহার কম হওয়ার বিষয়টিকে বিবেচনায় নিয়ে ঋণের ঝুঁকি কম বলা হয়েছে। এখানে ধরে নেয়া হয়েছে ভবিষ্যতে ডলারের যথেষ্ট তারল্য প্রবাহ থাকবে এবং সেটি দিয়ে ঋণ সুদে-আসলে পরিশোধ করা সম্ভব হবে। কিন্তু যখন ডলারের প্রাপ্যতার সংকট তৈরি হয় যেমন আমাদের বর্তমান পরিস্থিতিতে ঋণ ঝুঁকি কম হলেও ঋণ পরিশোধের ঝুঁকি বেড়ে যায়। কারণ যেভাবেই হোক সংকট থাকলেও ঋণ পরিশোধ করতে হবে ডলারেই। এ অবস্থায় আমদানি নিয়ন্ত্রণসহ অন্যান্য খাতে ব্যয় না করে ঋণ শোধ করতে হয়। জিডিপির অনুপাতে বিদেশী ঋণ কম থাকলেই যে তা সমস্যা হবে না সেটি ধরে নেয়া ঠিক না। ডলারের সংকট আমাদের একটি বড় সমস্যা, এর সঙ্গে রয়েছে নিম্ন রাজস্ব আয়। ঋণের অর্থ তো শেষ পর্যন্ত সরকারের রাজস্ব ও অন্যান্য উৎসের আয় থেকেই পরিশোধ করতে হবে। দেশী-বিদেশী ঋণের সুদের পরিমাণ বর্তমানে সরকারের রাজস্ব আয়ের ২০-২৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। আর টাকার অবমূল্যায়ন হলে বিদেশী ঋণের ব্যয় আরো বেড়ে যায়। সাধারণত যেটা বলা হয় যে অন্যান্য দেশের তুলনায় জিডিপির অনুপাতে আমাদের ঋণ কম। যেখানে এটি ৫৫-৬০ শতাংশের নিচে থাকলেই গ্রহণযোগ্য, সেখানে আমাদের ক্ষেত্রে তা ৪০ শতাংশের কাছাকাছি। কিন্তু এটি তখনই প্রযোজ্য হবে যখন আপনার যথেষ্ট রাজস্ব আয় ও হাতে ডলার থাকবে। যদি এ দুটোর কোনোটায় ঘাটতি থাকে তাহলে ঋণের পরিমাণ কম হলেও সেটি বোঝা হয়ে যায়। আমরা এখন সে পরিস্থিতির মধ্যেই আছি।’
সূত্র : বনিক বার্তা