সংঘাত-সহিংসতা, আচরণবিধি লঙ্ঘন ও প্রাণহানির মধ্য দিয়ে শেষ হলো দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচার। আওয়ামী লীগের বাইরে এই নির্বাচনে থাকা অন্য দলগুলোর প্রচার এবার খুব একটা চোখে পড়েনি। গত ১৮ ডিসেম্বর নির্বাচনী প্রচার শুরুর পর থেকে ৪ জানুয়ারি (গতকাল বৃহস্পতিবার) পর্যন্ত ১৮ দিনে দেশে নির্বাচনী সংঘাতে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে মুন্সিগঞ্জ ও পিরোজপুরে সংঘাতে আহত দুজনের মৃত্যু হয়েছে গতকাল।
নির্বাচনী প্রচারে প্রাণহানির প্রথম ঘটনা ঘটে গত ২৩ ডিসেম্বর, মাদারীপুরের কালকিনিতে। সেদিন স্বতন্ত্র প্রার্থীর এক সমর্থককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। প্রথম আলোর হিসাব অনুযায়ী, গত ১৮ দিনে মোট ১৫৬টি জায়গায় নির্বাচনী সংঘাত ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে।
এবার ভোটের প্রচারের শুরু থেকেই প্রতিপক্ষকে হুমকিসহ আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিভিন্ন ঘটনা দেখা গেছে। রাজধানী ঢাকার ১৫টি আসনের মধ্যে প্রায় সব কটিতে মানুষের চলাচলের পথ আটকে বিভিন্ন জায়গায় ফুটপাত–সড়কে নির্বাচনী ক্যাম্প (কার্যালয়) করা হয়েছে। কোথাও কোথাও বিধি লঙ্ঘন করে রঙিন পোস্টার-ব্যানার টাঙাতে দেখা গেছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে ভোটের প্রচারে বিধি লঙ্ঘনের এসব ঘটনা বেশি দেখা গেছে। কোথাও কোথাও স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও (আওয়ামী লীগের নেতা) বিধি লঙ্ঘন করে প্রচার চালিয়েছেন।
এবারও জাতীয় পার্টি ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী দলটিরই নেতাদের একাংশ, যাঁরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। সেটিও অবশ্য সব আসনে নয়। সব মিলিয়ে ৩০০ সংসদীয় আসনের মধ্যে ১৩০টিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে।
প্রচারের শেষ বিকেলে গতকাল নারায়ণগঞ্জে নির্বাচনী জনসভা করেন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের তাঁর নির্বাচনী এলাকা রংপুরে কয়েকটি পথসভা ও জনসভা করেন। এ ছাড়া ‘তারকা’ প্রার্থীদের মধ্যে মাগুরা-১ আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের পক্ষে প্রচারে অংশ নিয়েছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা। তিনি নিজেও নড়াইল-২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এবং বর্তমান সংসদ সদস্য। গতকাল মাগুরা-১ আসনে সাকিবের প্রচারে মাশরাফি ছাড়াও ছিলেন ক্রিকেটার সৌম্য সরকার, সাব্বির রহমান, রনি তালুকদার, আবু হায়দার রনি ও শামসুর রহমান। নড়াইল-২ আসনে মাশরাফির সে অর্থে শক্ত কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই।
‘তারকা’ প্রার্থীদের মধ্যে গতকাল ইশতেহার ঘোষণা করেছেন রাজশাহী-১ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও চলচ্চিত্র নায়িকা মাহিয়া মাহি (শারমিন আক্তার)।
মুন্সিগঞ্জে গুলিতে নিহত ১
মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলায় নৌকার প্রার্থীর এক সমর্থককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকেরা জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। গত বুধবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে উপজেলার মোল্লাকান্দি ইউনিয়নের মুন্সিকান্দি গ্রামে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। নিহত ব্যক্তির নাম ডালিম সরকার (৩৫)।
মুন্সিগঞ্জ-৩ (মুন্সিগঞ্জ সদর ও গজারিয়া) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ ফয়সালের (কাঁচি প্রতীক) সমর্থক ও মোল্লাকান্দি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রিপন হোসেন পাটোয়ারীর ছোট ভাই শিপন হোসেনের নেতৃত্বে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মৃণাল কান্তি দাস।
স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ ফয়সাল মুন্সিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য। তিনি মুন্সিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র ছিলেন। তাঁর বাবা মো. মহিউদ্দিন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান।
পুলিশ ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, বুধবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে মুন্সিকান্দি গ্রামে নৌকার প্রচার ক্যাম্পের পাশে অবস্থান করছিলেন ডালিম, সোহেলসহ কয়েকজন। এ সময় কাঁচি প্রতীকের সমর্থক শিপন ও সোহাগের নেতৃত্বে ১০ জনের একটি দল নৌকার ক্যাম্পে হামলা চালায়। সেখানে সোহেলকে পেটাতে শুরু করেন হামলাকারীরা। একপর্যায়ে ডালিম ও সোহেলকে লক্ষ্য করে শটগানের গুলি চালানো হয়। এতে গুলিবিদ্ধ হন ডালিম। পরে হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়।
আওয়ামী লীগের প্রার্থী মৃণাল কান্তি দাসের অনুসারী ও মোল্লাকান্দি ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মহসিনা হক দাবি করেন, এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে নির্বাচনী বিরোধ রয়েছে। তিনি বলেন, রিপন (মোল্লাকান্দি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান) কাঁচির সমর্থক। নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করতে কয়েক দিন ধরে রিপন হোসেন ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ফরহাদ খাঁ তাঁদের লোক দিয়ে এলাকায় ঝামেলা তৈরি করছিল। গতকাল রাতে রিপনের ভাই শিপনসহ তাঁর লোকজন নৌকার ক্যাম্পে হামলা চালায়। এ সময় একজনকে গুলি করে মেরেছে তারা।
পরিবার জানায়, ডালিমের দুই ছেলে-মেয়ে রয়েছে। তিনি গ্রিসে থাকতেন। পাঁচ বছর আগে দেশে ফেরেন। পরে পারিবারিক ব্যবসায় (গবাদিপশুর খাবার বিক্রি) যুক্ত হন।
হামলা ও গুলির ঘটনার বিষয়ে বক্তব্য জানতে মোল্লাকান্দি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রিপন হোসেনের সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেছে প্রথম আলো। কিন্তু তাঁর ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। তাঁর ভাই শিপনও এলাকাছাড়া।
অবশ্য এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে নির্বাচনী বিরোধ নেই বলেই প্রাথমিকভাবে মনে করছেন নিহত ডালিমের বড় বোন রুখসানা বেগম। তিনি বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত যে কয়েকজনের নাম জানতে পেরেছি, তাঁদের দু-তিনজনের সঙ্গে পারিবারিক ঝামেলা রয়েছে আমাদের।’
মুন্সিগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার থান্দার খায়রুল হাসান বলেন, যাঁরা ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তাঁদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালানো হচ্ছে।
পিরোজপুরে একজনের মৃত্যু
পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার বাদুরা গ্রামে নির্বাচনী সহিংসতায় আহত স্বতন্ত্র প্রার্থীর এক কর্মীর মৃত্যু হয়েছে। গতকাল সকালে হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। নিহত জাহাঙ্গীর পঞ্চায়েত (৫০) উপজেলার বাদুরা গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন।
পিরোজপুর-৩ (মঠবাড়িয়া) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী শামীম শাহনেওয়াজ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। এই আসনের আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য রুস্তম আলী ফরাজী (ঈগল প্রতীক)।
নিহত জাহাঙ্গীরের স্ত্রী বুলি বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী স্বতন্ত্র প্রার্থী শামীম শাহনেওয়াজের সমর্থক হওয়ায় তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আমি স্বামী হত্যার বিচার চাই।’
অবশ্য পুলিশ বলছে, জাহাঙ্গীরের মৃত্যু নির্বাচনী সহিংসতায় হয়নি। পিরোজপুরের পুলিশ সুপার মুহাম্মদ শরীফুল ইসলাম গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি পূর্বশত্রুতার জের ধরে ঘটেছে।
পুলিশ ও দলীয় সূত্রে জানা যায়, গত বুধবার দুপুরে বাদুরা গ্রামে স্বতন্ত্র প্রার্থী রুস্তম আলী ফরাজীর (ঈগল) সমর্থকদের সঙ্গে আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী শামীম শাহনেওয়াজের (কলার ছড়ি) সমর্থকদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এরপর বিকেলে জাহাঙ্গীর বাড়ি থেকে বাদুরা বাজারে যাওয়ার পথে রুস্তম আলী ফরাজীর সমর্থক সিরাজুল ফরাজীর সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে সিরাজুল ধারালো অস্ত্র দিয়ে জাহাঙ্গীরের মাথায় আঘাত করেন। পরে হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়।
‘সহিংসতার ঘটনা আছে’
ভোটের প্রচারে নির্বাচনী সহিংসতা নিয়ে গতকাল বিকেলে রাজধানীর একটি হোটেলে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, সহিংসতার ঘটনা আছে। তবে খুব কম।
এবার ভোটের প্রচারে আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে নির্বাচন কমিশন (ইসি) তুলনামূলক কমই ব্যবস্থা নিয়েছে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে গত বুধবার পর্যন্ত নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটিগুলো মোট ৫৮৯টি আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ আমলে নিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে। তবে অনুসন্ধান কমিটিগুলো আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্ত করতে পারে; তবে তারা নিজেরা কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। কমিটিগুলোর সুপারিশের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয় ইসি। অবশ্য ইসি মনে করছে, এবার আগের তুলনায় আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা কম।
সংঘাত থামানো ও প্রার্থীদের আচরণবিধি মানতে বাধ্য করার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন সময় প্রশ্ন তুলেছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলেছেন, আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনায় ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে বর্তমান কমিশন শেষ পর্যন্ত তেমন কোনো কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারেনি। কাজটি করতে পারলে সংঘাত-সহিংসতা আরও কম হতো।
প্রথম আলো