![সংকট নিরসন ও নির্বাচনের লক্ষ্যে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে](https://cdn.dhakapost.com/media/imgAll/BG/2025February/meet-bg-20250213082933-20250213101523.jpg)
দেশের চলমান সংকট নিরসনে এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য সব রাজনৈতিক দলকে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে মনে করেন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা। তারা বলেন, গণতন্ত্রের পথে যাওয়ার প্রথম ধাপ নির্বাচন। ২০২৪ সালে রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যের বিনিময়ে গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে স্বৈরাচার শেখ হাসিনাকে বিতাড়িত করা সম্ভব হয়েছে।
বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় রাজধানীর একটি হোটেলে ‘সংকট থেকে মুক্তি পেতে রাজনৈতিক ঐকমত্যের বিকল্প নেই’ শীর্ষক চা চক্রে বক্তারা এ মত পোষণ করেন। নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না এই চা চক্রের আয়োজন করেন।
এখন রাজনৈতিক ঐক্য করতে কোনো ফ্যাসিবাদ বাধা দিলে তাদেরকেও প্রতিহত করতে হবে বলে হুঁশিয়ারি দেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।
বক্তারা বলেন, বিগত ১৬ বছরের আন্দোলন সংগ্রাম ও জুলাই-আগস্টের ৩৬ দিনের আন্দোলনের মধ্যে বড় একটা সর্ম্পক রয়েছে। সবাই ফ্যাসিস্ট ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ছাত্র-জনতার এক লক্ষ্য থাকার কারণে শেখ হাসিনার পতন নিশ্চিত করা গেছে। এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দ্রুত সময়ে নির্বাচনের দিকে যেতে হবে। অন্যথায় বিপ্লব বেহাত হতে পারে। কারণ, নির্বাচন কেন্দ্রিক সংস্কারের পাশাপাশি দ্রুত সময়ে নির্বাচন দিতে বিলম্ব করলে ফ্যাসিস্ট ও তার দোসররা নানা ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখবে।
তারা আরও বলেন, বর্তমানে দেশে একটা সংকট রয়েছে, এজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য করতে হবে। দ্রুততম সময়ে জাতীয় নির্বাচনের জন্য সবাইকে একটা ‘সমঝোতা পরিষদ’ গড়ার কথাও বলেন তারা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গত ৬ মাসে কী কী কাজ করছে তার একটা শ্বেতপত্র প্রকাশেরও দাবি জানান বক্তারা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংবিধানের ৬ অনুচ্ছেদের শপথ নিয়েছে। তার মেয়াদ কত হবে সেটা দেওয়া নেই। নিরপেক্ষ সরকার না থাকলে, নির্বাচন কমিশন যতই নিরপেক্ষ বলুক, সেটি কিন্তু ঠুনকো জগন্নাথ। এই সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। এখন ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে যারা সংগ্রাম করেছে, তাদের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে জাতীয় ঐক্য করতে হবে। কাউকে বাদ দেওয়ার সুযোগ নেই।
তিনি বলেন, সংবিধান নিয়ে বেশি বিরোধ নেই, আমি দেখেছি, সংস্কার কমিশনের প্রধান পাঠিয়েছেন। তবে ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ২৪ এর গণঅভ্যুত্থান তুলনা করা ঠিক হবে না। ফ্যাসিবাদী বিরোধী জাতীয় ঐক্যটাকে সংস্কৃতি হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। কারণ নিজেদের মধ্যে জাতীয় ঐকমত্য না থাকার কারণে অনেক দেশে বিপ্লব হাত ছাড়া হয়ে গেছে।
সালাহউদ্দিন আহমেদ আরো বলেন, যদি আমরা রাজনৈতিক ঐক্যটা ধরে রাখতে পারি তাহলে এটাকে শক্তিতে পরিণত করতে পারবো। ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্য হয়েছে, এখন এটাকে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিণত করতে হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, আমরা দেখেছি, আন্দোলনের পর একটা মার্শাল ল’ আসে। সেটি পাকিস্তান আমল থেকে দেখে আসছি। আন্দোলনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে নির্বাচন দিলে দেশে শান্তি শৃঙ্খলা ফিরে আসে। এবারের আন্দোলন কিন্তু ভিন্ন, আমরা সবাই নির্যাতনের শিকার হয়েছি। ২৪-এ ছাত্র জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে আলো দেখেছি। ড. মুহাম্মদ ইউনূস আমাদের অ্যাসেট। ওনাকে পেয়ে আমরা গর্বিত। কিন্তু এখন সরকারের পথ চলা ভিন্ন দেখছি। স্বল্পকালীন সরকারের জন্য এত বড় ক্যানভাস করা প্রয়োজন ছিল না। শেখ হাসিনা তো ১৫ বছরে সব কিছু ধ্বংস করে দিয়েছে। ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত ছিল নির্বাচনমুখী হওয়া। আমরা সরকারের সংস্কার প্রতিবেদনগুলো ফেলে দেওয়ার কথা বলছি। এগুলো নিয়ে ভাবছি। শেখ হাসিনার পতনের পর কেউ আগের মতো দেশ চালাবে, এটা ভাবা যায় না। আমরা নির্বাচনের পর জাতীয় সরকার গঠন করে দেশ চালাব। যত সমস্যার একমাত্র সমাধান নির্বাচন।
সভাপতির বক্তব্যে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, দেশে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ হয় নির্বাচনে। নির্বাচন যত তাড়াতাড়ি হবে, বিএনপির ফল তত ভালো হবে। তাদের কাছে অনুরোধ রাষ্ট্রক্ষমতায় এলে তারা যেন সংস্কারগুলো ঠিকমতো করে। একই সঙ্গে সতর্ক চোখ রাখতে চাই, তারা যেন ভুল না করে। এজন্যই ঐক্য দরকার।
তিনি বলেন, আগস্টের পর অপার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, সেই সঙ্গে চ্যালেঞ্জও তৈরি হয়েছে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে ঐকমত্যের বিকল্প নেই। ঐকমত্যের মাধ্যমে সব সম্ভব। জাতীয় ঐকমত্যের জন্য কমিশন গঠন করা হয়েছে, যার প্রধান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কাস পার্টি সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, সরকারের নিরপেক্ষতা যদি প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তাহলে কিন্তু সরকার হোঁচট খাবে। ইতোমধ্যে এই সরকারের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সরকার অদলীয় নাকি নিরপেক্ষ সরকার? বিশেষ কোনো আইডিওলজি, বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দল বা ছাত্রদের প্রতি যদি পক্ষপাতিত্ব কাজ করে তাহলে সরকারের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। সরকারের নিরপেক্ষতা যদি প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তাহলে আগামীতে এই সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা যাবে কিনা, সেই প্রশ্ন বড় আকারে আসবে। এই সরকারের নিরপেক্ষতা যদি প্রশ্নবিদ্ধ হতে থাকে তাহলে আগামীতে রাজনৈতিক দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তুলবে কিনা সেটা জানি না। কিন্তু আমি দেখতে চাই, সরকার সফল হবেন। কার্যকর হবেন। তাদের মধ্যে যে একদিকে ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা, সরকার ও দেশের জন্য ভালো লক্ষণ না। অব্যাহত সমঝোতা নতুন সংকট তৈরি করতে পারে। আমি চাইবো সরকারের নিরপেক্ষ বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ন রাখবেন। যাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি না তুলতে হয়। আমরা সরকারকে সফল করতে চাই, কার্যকর করতে চাই। আমরা সহযোগিতা যোগাতে চাই। আপনারা জানা-অজানা কোনো এজেন্ডা নিয়ে কাজ করবেন না। আপনার যে দেশ চালাতে পারছেন না এটা দেশের মানুষ জানে। কিন্তু তারপরও আমরা সমালোচনা করি সরকার যেন সঠিক পথে থাকে।
গণসংহতি আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, রাষ্ট্রীয় কাঠামো পরিবর্তন করতে হবে, যেটি ব্যবহার করে এক দলীয় বা ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠে। সেটির বিলোপ করতে হবে। ৭২-এর সংবিধানের হাত ধরে আওয়ামী লীগ বারবার ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠেছিল। জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান একটা বিপ্লবের সম্ভাবনা তৈরি করেছে। মানুষের নতুন স্বপ্ন তৈরি হয়েছে। ৭২- এর সংবিধানের একদলীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে প্রতারণা, আওয়ামী লীগকে ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠার যন্ত্র। যেটাকে পুরোপুরি বাতিল করতে হবে। বর্তমানে মানুষের অধিকারের আন্দোলনকে সামনে রাজনৈতিক সংকট হতে পারে বলে বাধা দেওয়া যাবে না।
গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি সুব্রত চৌধুরী বলেন, জাতীয় নেতৃত্ব বের করতে ছাত্রদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিত্তিক ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিন। এতে করে নেতৃত্ব বের হয়ে আসবে। ক্ষমতার পেছনে না ঘুরে। এখন আমাদের ভেতরে কথার ফুলঝুড়ি উঠেছে। কোনো ঐকমত্য নেই। যত দিন যাচ্ছে সব কিছু ঝুলে যাচ্ছে। তাই সরকারকে বলি, বেশি বেশি সংস্কারের কথা বলে, কুসংস্কার করবেন না। যত দ্রুত নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতা ছেড়ে দিন। না হলে মঈন উদ্দিন, ফখরুদ্দিনের মতো পালাতে হবে। এখন তো দেখি সরকার থেকে কিংস পার্টি করার পাঁয়তারা করা হচ্ছে।
বাসদ-এর সাধারণ সম্পাদক কমরেড বজলুর রশিদ ফিরোজ বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকে ৬ মাসের জবাবদিহিতা চাওয়া দরকার। কী কী করেছে ৬ মাস? ১২ জনের মতো বিচার বহির্ভূত হত্যা হয়েছে এ সরকারের আমলে, এমন কি শিক্ষকদের ওপর হামলা চালিয়েছে পুলিশ সদস্যরা। এর কোনো প্রতিকার দেয়নি সরকার।
ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক রফিকুল ইসলাম বাবলু বলেন, ৭১-কে বাদ দিয়ে কিছু করতে দেওয়া হবে না। কেউ বলে মহান গণঅভ্যুত্থান, কেউ বলে বিপ্লব? কিন্তু বিপ্লব ও মহান অভ্যুত্থান আলাদা সংজ্ঞা রয়েছে। দেশ নতুন করে স্বাধীন হয়নি, স্বাধীন হয়েছে ৭১ সালেই।
এসময় আরও বক্তব্য দেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) সাধারণ সম্পাদক শহিদ উদ্দিন স্বপন, দৈনিক সমকাল পত্রিকার উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান, জাতীয় নাগরিক কমিটির যুগ্ম সদস্য সচিব রাফে সালমান রিফাত, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি’র সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, সমাজকর্মী রুবি আমাতুল্লাহ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি আরিফুর রহমান, জাতীয় নাগরিক কমিটির আরিফুর ইসলাম আদীব প্রমুখ।
এএইচআর/জেডএস