সংকট কাটাতে ‘মধ্যবর্তী নির্বাচন’ চান ড. ইউনুস

সংকট কাটাতে ‘মধ্যবর্তী নির্বাচন’ চান ড. ইউনুস

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সংকট উত্তরণের জন্য জনগণের ম্যান্ডেট দিয়ে গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনার জন্য স্বল্প সময়ে মধ্যবর্তী নির্বাচনের পক্ষে মত দিয়েছেন প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনুস।

শুক্রবার ভারতের দ্য হিন্দু পত্রিকায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে নোবেল বিজয়ী এই অর্থনীতিবিদ বলেন, “অবশ্যই, নির্বাচনই সব রাজনৈতিক সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান। যখন কোন রাষ্ট্রকাঠামোর কিছু কাজ করে না, তখন জণগনের কাছে ফিরতে হবে। তারাই দেশের চূড়ান্ত মালিক। সঠিক প্রক্রিয়া নির্বাচন হতে হবে গণতন্ত্রের জন্য, কোন জাদুকরী নির্বাচন নয়।

সামাজিক ব্যবসার উদ্ভাবক ড. ইউনুস অলিম্পিক অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে যোগ দিতে এখন ফ্রান্সের প্যারিসে অবস্থান করছেন। বাংলাদেশের গত কয়েকটি নির্বাচনে ‘জাদুকরের’ প্রভাব পরেছে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে প্রধান বিরোধী দল (বিএনপি) ও মিত্ররা সাধারন নির্বাচন বয়কট করলে বিতর্কের মধ্যে চতুর্থবারের মেয়াদে ক্ষমতায় আসেন শেখ হাসিনা।

প্রফেসর ইউনুস বলেন, “জনগণের ম্যান্ডেট পান, অবাধে এবং ন্যায্যভাবে। এটাই নিয়ম। গণতন্ত্র জনগণের অংশগ্রহনের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করে, কারণ রাষ্ট্র জনগণের, সরকারের কিছু সুবিধাভোগীর নয়।

সাংবাদিক সুহাসিনী হায়দারের সাথে সাক্ষাৎকারে, নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ দাবি করেন যে বাংলাদেশ বর্তমান ক্ষমতাসীনদের আচরন অনেকটা অন্য দেশ থেকে আসা বিদেশী বাহিনীর মতো, যারা বুলেটের মাধ্যমে আন্দোলনকারিদের দমন করছে।

প্রফেসর ইউনুস বলেন, “বিষয়টি হল ক্ষমতাসীনরা (অথরিটি) পরিস্থিতির সাথে বিরূপ আচরণ করছে। যেন একটি বিদেশী সেনাবাহিনী বাংলাদেশে আক্রমণ করছে… সেনাবাহিনী ও আধাসামরিক (বিজিবি) বাহিনীকে গুলি করে বিক্ষোভকারীদের দমন করার জন্য অনুমতি দেয়া হয়েছে। তারা সাধারণ নাগরিকদের দমনের মেজাজে আছে, শৃঙ্খলা আনার জন্য নয় ।

ড. ইউনুস ছাত্র ও সাধারণ মানুষকে এলোপাতাড়ি হত্যার নিন্দা করেছেন যেন তারা অন্য দেশের আগ্রাসী শক্তি। বাংলাদেশে হত্যা বন্ধ করা যায় কিনা তা দেখার জন্য বিশ্বনেতাদের কাছে আবেদন জানিয়ে আসছেন এই নোবেলজয়ী।

তিনি নোবেল জয়ের পর ‘নাগরিক শক্তি’ নামে একটি রাজনৈতিক দলে আত্নপ্রকাশের ঘোষনা দেন। সেই থেকেই রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হচ্ছেন ড. ইউনুস।

বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীনদের সমালোচনা করে ড. ইউনুস বলেন, (বর্তমানে বাংলাদেশে যেটা হচ্ছে) এটা আমি সহ্য করতে পারি না। বাংলাদেশিরা আজ লাখ লাখ সন্ত্রাসীর মাঝে বেচে আছে। গণতন্ত্র মানুষের জীবনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়। গণতন্ত্র হল ধর্ম, রাজনৈতিক মতামত বা মতের অন্য কোন পার্থক্য নির্বিশেষে মানুষকে, সকল মানুষকে রক্ষা করা। একজন নাগরিক যদি অন্য একজনকে হত্যা করতে চায়, তাহলে রাষ্ট্রের প্রথম দায়িত্ব হবে হামলার শিকার ব্যক্তিকে (ভিকটিম) রক্ষা করা”।

নাগরিককে হত্যা কোন সমাধান আনতে পারে না উল্লেখ করে প্রফেসর ইউনূস বলেন, বাংলাদেশে বর্তমান ক্ষমতাসীনরা (আওয়ামী লীগ) আক্রমণাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে হামলা করে।

তিনি বলেন, বিক্ষোভকারীরা কাউকে হত্যা করার জন্য রাস্তায় নামেনি। তাদের দাবি সরকারের কাছে অপ্রীতিকর হতে পারে। তবে গুলি করে শীক্ষার্থীদের হত্যা করা শুধুমাত্র কর্তত্ববাদী সরকারের পক্ষেই সম্ভব।

ড. ইউনুস আশা করছেন যে বিশ্ব নেতারা তাদের ব্যাক্তিগত সম্পর্ক এবং অনানুষ্ঠানিক চ্যানেল ব্যবহার করে বাংলদেশের গণতন্ত্রের বিকাশে আন্তর্জাতিক মত গঠন করতে ভূমিকা রাখবেন।

উদাহরন দিয়ে তিনি বলেন, শুধুমাত্র ফোনটি তুলে (আপনার প্রভাবশালী বন্ধুকে) বলুন, সেখানে (বাংলাদেশে) কী হচ্ছে? বন্ধুরা বন্ধুদের জন্য যে ধরনের কাজ করে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রের কিছু উদ্যোগ মানুষের জীবন বাঁচাতে পারে।

ভারত ও বাংলাদেশ ঐতিহাসিক বন্ধু উল্লেখ করে প্রফেসর ইউনুস বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে আন্দোলনের সামান্যতম ছোঁয়া নেই। ভারত আগেই বিবৃতি দিয়ে বলেছে, এটা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়।

আমাদের এখনও সার্কের স্বপ্ন আছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। প্রফেসর ইউনুসের ভাষ্য, আমরা একে অপরকে সাহায্য করি। আমাদের মধ্যে আঞ্চলিক বন্ধন আছে। এক দেশে কিছু ঘটলে অন্য দেশেও ছন্দপতন ঘটতে পারে।

ঢাকায় সাম্প্রতিক ছাত্র বিক্ষোভের বিষয়ে প্রফেসর ইউনুস পুলিশ, প্যারা মিলিটারি ও সেনাবাহিনীর হাতে ছাত্র ও নিরীহ মানুষ হত্যার নিন্দা জানান। তিনি বলেন, ‘এটি একটি খুব অদ্ভুত পরিস্থিতি। শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ মোকাবেলায় সেনাবাহিনী আনতে হবে কেন? এখন আপনি বলেন, ভিতরে কিছু শত্রু আছে। কারা সেই শত্রু? তাদের চিহ্নিত করুন এবং তাদের মোকাবেলা করুন, ছাত্রদের হত্যা করে নয়।

ড. ইউনুস বলেন, ‘মুল ইস্যুটি হল গণতন্ত্র, আইনের শাসন, মানবাধিকার এবং বিচার বিভাগের ভূমিকা। জনগণের তাদের মতামত প্রকাশের অধিকার রয়েছে এবং তাদের মত প্রকাশ ও অধিকার আদায়ের হত্যা করার কোন ম্যান্ডেটই ক্ষমতাসীনদের নেই। যারা আইন ভঙ্গ করেন তাদের মোকাবিলার পদ্ধতি রয়েছে।

তিনি বলেন, কেউ আন্দোলন করলে, এলোমেলোভাবে হত্যা করতে হবে – এমনটি কোথাও বলা নেই। বিশ্বে এটিই প্রথম নয় অনেক সরকারকে বিক্ষোভের মুখোমুখি হতে হয়েছে। আমরা দেখি পুলিশ নিরপরাধ ছাত্রদের হাত তুলে গুলি করছে এবং খুব কাছ থেকে গুলি করছে কারণ তাদের গুলি করার ক্ষমতা আছে।

সার্কের সকল সদস্যদের প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ঢাকার সাম্প্রতিক ঘটনা তদন্ত করার আহ্বান জানান প্রফেসর ইউনুস। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “সব মিডিয়ার এসে দেখা উচিত কী ঘটছে। তারা (বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনরা) প্রথম কাজটি করেছিল, সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া যাতে তারা অন্ধকারের আড়ালে এমন কিছু করতে পারে যাতে কেউ বাইরে থেকে এমনকি ভিতরে থেকেও দেখতে না পারে। আজ বাংলাদেশে যা হচ্ছে তা ভারতেও ঘটতে পারে। আপনি যদি আজ কথা না বলেন, আপনি এই দিনটিকে ভারত, নেপাল, পাকিস্তান বা অন্যান্য সার্ক দেশগুলির জন্য সহজেই কাছে নিয়ে আসবেন।

হাসিনার ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার শিকার ড. ইউনুস বলেন, বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্রের প্রতি এবং গণতন্ত্রের সঙ্গে থাকার জন্য নিজেদের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করেছে।

হাসিনার দিকে ইঙ্গিত করে প্রফেসর ইউনুস বলেন, “আপনি নির্বাচিত হন বা নির্বাচিত না হন, অথবা আপনি জনগণের সম্মতি ছাড়া আপনার অবস্থানের অপব্যবহার করছেন, গণতন্ত্রে কিছু যায় আসে না। আপনি একটি সরকার যে জনগণকে রক্ষা করার জন্য দায়বদ্ধ, হত্যার জন্য নয়। বিরোধী দলের সদস্য হলেই তাকে গ্রেফতার করতে হবে, এমনটা গণতন্ত্র নয়।

ড. ইউনুস বিশ্বাস করেন যে গণতন্ত্র ব্যর্থ হলে জনগণের বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরিয়ে আনতে রাজনীতিবিদদের আবার জনগণের কাছে ফিরে যাওয়া উচিত, এই মুহূর্তে (বাংলদেশ) সরকারের কোনো বিশ্বাসযোগ্যতা অবশিষ্ট নেই।

তিনি বলেন, “গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে সব সমাধান আছে। আমাকে নতুন করে রায় দিতে হবে না। ড. ইউনুসের বিরুদ্ধে প্রায় ২০০টি অভিযোগ তুলেছেন হাসিনা। এটা কি ব্যক্তিগত আক্রমন? এমন প্রশ্নে ড. ইউনুস বলেন, এসব মামলা আইনের শাসনের ব্যর্থতা। অভিযোগগুলি আত্মসাৎ, জালিয়াতি এবং অর্থ পাচার সংক্রান্ত। যে আমি আমার নিজের প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা চুরি করেছি। এগুলো সরকারের অভিযোগ। এগুলি সম্পূর্ণ বানোয়াট গল্প। হাসিনার বিরুদ্ধে ‘ইউনূসকে হয়রানি করার অভিযোগ এনেছে অনেক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা’।

Mirror Asia